সংস্কৃতির বাতিঘর সনজীদা খাতুন এক মৃত্যুহীন প্রাণ
যে কোনো দেশ বা জাতি কিংবা সংস্কৃতির কেউ না কেউ থাকেন যারা আমৃত্যু কাটিয়ে দেন নিরলস সংস্কৃতিচর্চায়, মানবতার কল্যাণে, দেশের হিতৈষে। কাণ্ডারি হয়ে, আলোকবর্তিকা হয়ে। ফিরে তাকান না নিজের দিকে, সাময়িক সুখের দিকে। তেমনই একজন মানুষ ছিলেন ছায়ানটের সভাপতি সনজীদা খাতুন (৪ এপ্রিল ১৯৩৩-২৫ মার্চ ২০২৫)। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার বাতিঘর। তার হাত ধরে, তাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে শুদ্ধ সংগীতচর্চার ধারা। বিশেষ করে রবীন্দ্রসংগীতের প্রমিতচর্চা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে ছায়ানটের প্রযত্নে। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে সনজীদা খাতুন আত্মনিবেদিত প্রাণ। বাঙালি সংস্কৃতির এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনকে ঋদ্ধ করে বাঙালিত্বেও দৃঢ় ভিত্তি গড়ে তোলার সাধনায় ব্রতী হয়েছিলেন তিনি।
তিনি ছিলেন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী, লেখক, গবেষক, সংগঠক, সংগীতজ্ঞ, শিক্ষক। ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তন, রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, কণ্ঠশীলন, নালন্দা বিদ্যালয়, ব্রতচারীসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি। পণ্ডিত ব্যক্তি, জাতীয় অধ্যাপক ড. কাজী মোতাহার হোসেনের কন্যা সনজীদা খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। এর আগে তিনি ইডেন কলেজ, রংপুর কারমাইকেল কলেজে শিক্ষকতা করেন। সর্বশেষ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫৫ সালে ভারতের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, শান্তিনিকেতন থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
স্বীকৃতিস্বরূপ বহু পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত), দেশিকোত্তম পুরস্কার (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)। কলকাতার টেগর রিচার্স ইনস্টিটিউট ১৯৮৮ সালে তাকে রবীন্দ্র তত্ত্বাচার্য উপাধি প্রদান করে। ২০১৯ সালে ‘নজরুল মানস’ প্রবন্ধ গ্রন্থের জন্য ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্ত হন। ২০২১ সালে ভারত সরকার তাকে ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কারে ভূষিত করে। পাকিস্তানি শাসকরা মাতৃভাষা বাংলার পরিবর্তে উর্দু করার সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে বাঙালির জাতিসত্তার ওপর আঘাত হেনেছিল। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সে চেষ্টা ব্যর্থ হলেও আগ্রাসন চালাতে তারা থেমে থাকেনি। একের পর এক আঘাত হানতে থাকে এ দেশের সংস্কৃতির ওপর নানাভাবে। আরোপ করতে থাকে নানা বিধিনিষেধ।
শিল্পীরা রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে প্রতিবাদ জানাতেন। ফলত রবীন্দ্রসংগীতের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হলো। নিষিদ্ধ হলো রবীন্দ্রসংগীত। এ দেশের ওপর পাকিস্তানি আগ্রাসন সব সময়ই চলমান ছিল। এখনো তা রয়ে গেছে। পাকিস্তানে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করা হয়। ফলে এ দেশের সংস্কৃতিকর্মীরা প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের আয়োজন করা হয়। সাংস্কৃতিক আন্দোলন অব্যাহত রাখার জন্য সংস্কৃতিকর্মীরা একটি সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। সেদিনই বেগম সুফিয়া কামালকে সভাপতি এবং ফরিদা হাসানকে সম্পাদক করে ‘ছায়ানট’ নাম দিয়ে একটা কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ছায়ানট’। সনজীদা খাতুন এবং ওয়াহিদুল হক ছিলেন ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে। এক সময় ওয়াহিদুল হক একটা গানের স্কুল খোলার প্রস্তাব করেন। এভাবেই শুরু হয় ‘ছায়ানট’ সংগীত বিদ্যালয়ের যাত্রা। এই স্কুলই বাঙালিদের শিল্পসংস্কৃতিচর্চার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই তিনি রংপুর থেকে ঢাকায় আসেন। এরপর সাভারের জিরাবো গ্রাম থেকে ঢাকা হয়ে কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। তার সঙ্গে কয়েকজন সাংস্কৃতিক কর্মীও ছিলেন। তারা ভারতের আগরতলা শহরে কিছুদিন অবস্থান করেন। তারপর ১৯৭১ সালের ৫ মে কলকাতায় প্রবেশ করে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সাংস্কৃতিক কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করা শুরু করেন। তার রক্তে ছিল মানবতার বীজমন্ত্র। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। সংস্কৃতি হয়ে উঠল বিপ্লবের হাতিয়ার। মনেপ্রাণে তিনি একজন বাঙালি ছিলেন। বাঙালি সংস্কৃতিচর্চায় তিনি ছিলেন নিরলস কর্মী। জীবনভর শিক্ষক। এমন প্রমিত আচরণের একজন মানুষ পাওয়া কঠিন। কত সাধারণ সাদামাটা জীবনযাপন করতেন তিনি, তা কল্পনাই করা যায় না। তিনি হতে পারেন একজন আদর্শ মানুষের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। তার আদর্শ, তার ব্যক্তিত্ব, তার জীবনাচরণ যে কারও অনুপ্রেরণার বিষয়।
কয়েক বছর আগের কথা, তখন তার বয়স ৮৪ বা ৮৫ বছর। একদিন আমাকে ফোন করে বললেন, ‘আগামীকাল বিকেলে আমার বাসায় আসতে পারবে তোমরা? আমার খুব ইচ্ছে হয়েছে একদিন বিকেলে তোমাদের একটু নাশতা খাওয়াতে। বেশি নয় তুমি, সুমনা, তোমার মেয়ে খেয়া। আর জহির (আবৃত্তিশিল্পী)’। সানন্দ্যে রাজি হলাম। এ তো মেঘ না চাইতেই পানি। বিকেলে পৌঁছলে একটু গল্পস্বল্প করার পর যথারীতি খাবার টেবিলে ডাকলেন। নানা আয়োজন। বেশ সুস্বাদু রান্না। তিনি বললেন, ‘অনেক বছর পর আজকে রেঁধেছি। দ্যাখো খেতে পারো কি না’? আমি বললাম, ‘সে কী? আপনি রান্না করতে গেলেন কেন’? তিনি বললেন, ‘ভাবলাম তোমরা খাবে, নিজের হাতে রান্না করেই খাওয়াই।’ বিস্মিত হওয়া ছাড়া আর উপায় থাকে না। নিজ হাতে রান্না করেছেন। তাও এত বয়সে? তাছাড়া সব খাবার তিনি নিজ হাতে পরিবেশন করছেন। নিজেকে ধন্য মনে করছিলাম। আমার মেয়ে খেয়া তখন সাত-আট বছর বয়সের।
ওকে একটা রসগোল্লা তুলে দিলেন। ও খেতে চাচ্ছিল না। অর্ধেকটা খেয়ে আর পারছিল না। সনজীদা খাতুন খেয়ার প্লেটের ওই ভাঙা রসগোল্লাটুকু দুই আঙুলে তুলে নিয়ে বললেন, ‘তোমার সঙ্গে এটুকু আমিই খেয়ে নেই’। কত বড় একজন মানুষ, অথচ কত সাধারণ মানুষের মতো ব্যবহার। এত সাধারণ বলেই তিনি অসাধারণ। সনজীদা খাতুন মৃত্যুহীন প্রাণ। মরেও অমর হয়ে থাকবেন মানুষের মাঝে। তার জ্ঞানের আলো বিচ্ছুরিত হবে তার হাতে গড়া তার প্রতিটি শিক্ষার্থীর মধ্য দিয়ে। একটি প্রদীপ নিভে গেলেও তার উত্তাপ আর আলো থেকে যায় তার দ্বারা প্রজ্জ্বলিত লক্ষ প্রদীপে। তার শিক্ষা, জীবনদীক্ষা বাঙালির পাথেয়। সে আলো ও উত্তাপ বাঙালি যুগযুগ তার বুকে লালন করবে। ধরে রাখবে। উজ্জীবিত হবে।
ড. সন্তোষ ঢালী: কবি ও কথাসাহিত্যিক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে