সড়ক দুর্ঘটনা
যেভাবে ব্যক্তির সঙ্গে লুটিয়ে পড়ে পরিবার
মাস পাঁচেক আগে স্বামী-সন্তান-শাশুড়িকে নিয়ে সুখের সংসার ছিল কাজলীর। দিন কেটে যাচ্ছিল স্বাচ্ছন্দ্যে। কাজলীর স্বামী ছিলেন ট্রাকচালক। অর্থনৈতিকভাবে ছিলেন স্বাবলম্বী; কিন্তু হঠাৎ তাদের জীবনে নেমে আসে আঁধার। একটি দুর্ঘটনায় এক নিমিষেই হারিয়ে গেছে বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার সাজাপুর ফকিরপাড়া গ্রামের কাজলী ও তার পরিবারের জীবনের সব সুখ।
গত ২২ মে বিকেলে বাড়ি থেকে বের হয়ে বাজারের দিকে যাচ্ছিলেন কাজলীর স্বামী আমিনুল ইসলাম। হেঁটে ঢাকা-বগুড়া মহাসড়ক পার হতে গিয়ে সাজাপুরে দ্রুতগতির একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা তাকে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যায়। এতে গুরুতর আহত হন আমিনুল। স্থানীয়রা উদ্ধার করে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে নিলেও চিকিৎসা শুরুর পরপরই তার মৃত্যু হয়।
এ মৃত্যুতেই পাল্টে যায় নিহত আমিনুলের স্ত্রী কাজলী ও মা আঙ্গুরী বেওয়ার জীবনের গতিপথ। কেউ খোঁজ রাখেনি তাদের। সরকারিভাবে কোনো সহায়তাও পায়নি অসহায় পরিবারটি। সড়কে মৃত্যুর দায় যেন তাদেরই! তাই তো তারা সাজা ভোগ করছেন, আর নীরবে ফেলেছেন চোখের পানি।
সাজাপুর ফকিরপাড়া গ্রামে ৩৭ বছরের কাজলী আক্তারের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, ক্ষেত থেকে তোলা কচুরমুখি পরিষ্কার করছেন তিনি। তবে নিজেদের খাওয়ার জন্য নয়। একমণ কচুরমুখি পরিষ্কার করলে ১০০ টাকা মজুরি তার। কাজলী একাই নন, তার সঙ্গে কাজে হাত লাগিয়েছেন মেয়ে আম্বিয়া আক্তারও। বেপারি এসে বসে আছেন। তাই কাজে খুব তাড়াহুড়ো করছিলেন মা-মেয়ে।
সেখান থেকে কিছুদূর যেতেই দেখা মেলে কাজলীর শাশুড়ি আঙ্গুরী বেওয়ার। মেয়ের বাড়ির উঠানে কাস্তে দিয়ে খড় কাটছেন তিনি। পরিবারে অভাব দেখা দেয়ায় একই গ্রামে মেয়ে-জামাইয়ের বাড়িতেই থাকেন আঙ্গুরী। করে দেন পরিবারের নানা কাজও।
অথচ দুর্ঘটনায় আমিনুল নিহত হওয়ার আগে এক বাড়িতেই থাকতেন কাজলী আক্তার ও আঙ্গুরী বেওয়া। ওই দুর্ঘটনাই পরিবারটিকে ঠেলে দিয়েছে এমন করুণ পরিণতির মাঝে।
আমিনুলের মা বলেন, ‘আমার এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলের মৃত্যুর পর মেয়ের বাড়িতে এসে থাকি। আমার জামাই জাকেরুল ইসলাম কৃষক। শুধু আমাকেই নয়, ছেলের পরিবারকেও জামাই খরচ দেয়।’
আমিনুলের স্ত্রী বলেন, ‘আমার দুই সন্তান। মেয়ের বিয়ে দিয়েছি সাড়ে তিন বছর আগে। ছেলে রাকিবুল হাসান সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। সংসারে আগে অভাব ছিল না; কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর কোনোরকমে খেয়ে-পরে বেঁচে আছি। অন্যর ক্ষেতের কচুরমুখি পরিষ্কার করে কিছু টাকা পাই। পাশাপাশি এক খুঁটি কারখানায় কাজ করি। খুঁটির এক হাজার রিং বেঁধে দিলে ৯০ টাকা পাই। এতে সপ্তাহে ২০০-৩০০ টাকা আয় হয়। অথচ বছর সাতেক আগে আমাদেরই নিজস্ব খুঁটি কারখানা ছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার ননদ মাহমুদা বেগমের স্বামী জাকেরুল সংসারে কিছু খরচ দেন। বাকিটা আমি কাজ করে আয় করি। স্বামীর বাড়ি থেকে আমার মেয়ে বেড়াতে এসেছে। মেয়ে যখন আসে, তখন আমার কাজে সেও সহযোগিতা করে।’
কাজলী ও তার মেয়ে আম্বিয়া আক্তার জানান, আমিনুলের মৃত্যুর ঘটনায় কোনো মামলা করা হয়নি। পুলিশের কেউ তাদের খোঁজ নিতেও আসেননি। সরকারি সহায়তা পেলে পরিবারের অভাব মেটানোর চেষ্টা করবেন তারা।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে