Views Bangladesh Logo

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ফলদায়ক ফলাফল কাম্য

পমহাদেশে বৈশ্বয়িক ক্রিকেটের আসরের আলাদা এক ধরনের আবেদন এবং আকর্ষণ আছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আসর মানেই কোটি কোটি মানুষ অনির্ধারিত একটি উৎসবে নিজেদের ভাসিয়ে দেয়া। আর এই আনন্দঘন উৎসব ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এমনকি মানুষের এই দিন প্রতিদিনের জীবন প্রবাহ পাল্টে দেয়। যে খেলাটা অনিশ্চয়তার রাজা সেই খেলার প্রতি এত আকর্ষণের কারণ হলো জীবনের সঙ্গে বড্ড মিল। জীবন তো অনিশ্চয়তার জন্য সুন্দর, তেমনি সুন্দর ক্রিকেট।

সুসাহিত্যিক অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত তার ‘মৃগ নেই মৃগয়া’ (প্রথম প্রকাশ ফাল্গুন ১৩৭২) বইয়ে ‘অভাবিত ক্রিকেট’ অধ্যায়ে লিখেছেন ‘অনিশ্চয়তার রাজা ক্রিকেট। অঘটনের সম্রাট, যা কিছু ঘটে যেতে পারে যে কোনো সময়ে। পাড়ের কাছে এসে হতে পারে ভরাডুবি। আবার উত্তাল নদী শুকিয়ে গিয়ে দিতে পারে পথ ছেড়ে, মানুষের জীবনের সঙ্গে এত মিল খায়। কখনো দিন বড় কখনো রাত বড়। কখনো সিংহাসন কখনো বনবাস।’ ক্রিকেট সত্যি সুরসিক। মজা করতে ভীষণ ভালোবাসে। খেলাটির মধ্যে অভাবনীয়ের স্পর্শ আছে বলেই ক্রিকেট এত রসে ভরপুর।

মানুষকে ভীষণভাবে টানে। এই খেলা খেলে যেমন আনন্দ, দেখেও তেমনি সুখ। বাংলাদেশের ক্রিকেট সাহিত্যিক বদরুল হুদা চৌধুরী তার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘তবু ক্রিকেট ভালোবাসি। (প্রথম প্রকাশ অক্টোবর ১৯৬৬) বইয়ে লিখেছেন (পৃষ্ঠা ২৮)’ জীবনের সব কিছুর মতো ক্রিকেটেও আছে মালিন্য তবু ক্রিকেট খেলার জগতে উজ্জ্বল এক আনন্দধারা। সত্যি ক্রিকেট খেলার রাজা তাই তো ক্রিকেট এতো ভালবাসি।’ ক্রিকেট সাহিত্যিক বদরুল হুদা চৌধুরী তার বইয়ে আরও লেখেন ক্রিকেট দেখার জন্য তিনি কিউ দিতে রাজি আছেন- যদি সবার শেষে দাঁড়াতে হয় তবুও।

২০১৭ সালে ইংল্যান্ডে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি মাঠে গড়ানোর আট বছর পর আবার মাঠে আসছে ১৯ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের করাচিতে নিউজিল্যান্ড ও পাকিস্তানের মধ্যে ম্যাচের মাধ্যমে। এবার স্বাগতিক দেশ পাকিস্তান। ২০১৭ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে টাইগাররা দুর্দান্ত ক্রিকেট খেলে সেমিফাইনালে পৌঁছে ছিল। ইংল্যান্ডের কন্ডিশনে এটি অসাধারণ সাফল্য। এখন পর্যন্ত আইসিসির কোনো বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে ওয়ানডেতে বাংলাদেশ দলের এটি সেরা সাফল্য। বাংলাদেশ দল পরাজিত হয়েছে ভারতের কাছে। এবার বাংলাদেশ প্রথম ম্যাচ খেলবে ভারতের বিপক্ষে দুবাইয়ে ২০ ফেব্রুয়ারি।

এরপর পাকিস্তানে ফিরে এসে গ্রুপ পর্বের বাকি দুটি ম্যাচ খেলবে ২৪ ও ২৭ ফেব্রুয়ারি যথাক্রমে নিউজিল্যান্ড এবং পাকিস্তানের বিপক্ষে রাওয়ালপিণ্ডিতে। এর আগে টাইগাররা দুবাই এবং রাওয়ালপিণ্ডিতে খেলেছে এবং এই জায়গার উইকেট সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল। আর তাই সমস্যা হবে না। কন্ডিশন নিয়ে বেশি ভাবার দরকার নেই। স্বাগতিক পাকিস্তানে করাচি, লাহোর ও রাওয়ালপিণ্ডিতে খেলা ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের দুবাইয়ে খেলা অনুষ্ঠিত হবে। এর কারণ হলো তারা ‘হাইব্রিড মডেলে’ দুবাইয়ে খেলবে। এর আগে ২০২৩ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপে ভারত খেলতে না যেয়ে ‘হাইব্রিড মডেলে’ খেলেছে শ্রীলঙ্কায়।

ভারত ২০০৮ সালের পর আর কখনো পাকিস্তানে খেলতে যায়নি। পাকিস্তান কিন্তু আইসিসির ক্রিকেট ইভেন্টে ভারতে গিয়ে খেলেছে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ক্ষেত্রে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড প্রথম থেকে ভারতের অযৌক্তিক আবদারের বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নিলেও শেষ পর্যন্ত ভারতের দাবি মেনে নিয়েছে। এতে করে ভারত যদি ফাইনালে যায় তা হলে ৯ মার্চ দুবাইয়ে ফাইনাল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে। ক্রিকেট একটা মর্যাদাপূর্ণ আচরণ। ক্রিকেট একটা জীবনবোধ। এ সবাই পালিয়ে যায় যখন অসুস্থ আন্তর্জাতিক রাজনীতি পেছন থেকে খেলতে শুরু করে। বারবার ভারতের অনঢ় অবস্থান ক্রিকেট চেতনার পরিপন্থি। আইসিসি ভারতের বিষয়ে সব সময় চুপ।

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে আট দল লড়াইয়ে নামবে। ২০১৭ সালের বিজয়ী পাকিস্তান কি শিরোপা ধরে রাখতে পারবে? ৮ দেশের মধ্যে চারটি দেশ এশিয়া থেকে- ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান। আর এর জন্যই উপমহাদেশের ক্রিকেট রসিকদের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিকে ঘিরে জন্ম হয়েছে বিশেষ উৎসাহ এবং আবেদনের। ক্রিকেট অনিশ্চয়তায় ভরপুর- যেটা আগেই উল্লেখ করেছি। দলকে ঘিরে আমার নিজস্ব মতামত ইতিমধ্যেই মিডিয়াতে জানিয়েছি। সেই অবস্থান থেকেই নিচে সেটি উল্লেখ করছি সংক্ষেপে।

উপমহাদেশের মাটিতে ক্রিকেট পণ্ডিতদের দৃষ্টিতে এগিয়ে আছে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান এবং ইংল্যান্ড। কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন আফগানিস্তানে ভারসাম্যময় শক্তির কথা। বাংলাদেশ ইংল্যান্ডের অনুষ্ঠিত ট্রফিতে সেমিফাইনালে খেলেছে। বাংলাদেশ দল এখন পুনর্গঠন, পরিবর্তন এবং নতুন সংযোজনের মধ্যে দিয়ে চলেছে। তা সত্ত্বেও তরুণ খেলোয়াড়রা সম্ভাবনাময়ী। অভিজ্ঞ এবং তরুণদের নিয়ে গঠিত দলটি ভারসাম্যময়। একটি ইউনিট হিসেবে দ্য টাইগাররা খেলতে পারে, তাহলে তাদের পক্ষে অনেক দূর যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। ভাবছি না বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন্স হবে- এটি এই সময় অবাস্তব চিন্তা।

আমরা চাইছি সবাই মিলে টাইগাররা সাহস এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ইতিবাচক ক্রিকেট খেলুক। তারা সময় মতো মাঠে জ্বলে উঠুক। দলগত সামর্থ্য এখন কিন্তু আগের তুলনায় বেশি। পেস আক্রমণ আগের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী। স্পিন আক্রমণে কার্যকারিতা বেড়েছে। আগে রিস্ট স্পিনার দলে ছিল না এখন আছে। বেশ কয়েকজন ব্যাটার দারুণ ছন্দে আছেন। ব্যাটিং তরুণদের সঙ্গে অভিজ্ঞ সিনিয়র ক্যামপেইনারদের বোঝাপড়া খুব ভালো। এটি একটি প্লাস পয়েন্ট। পরিকল্পনামাফিক দায়িত্বশীল ক্রিকেট সবাই মিলে খেলতে পারলে টাইগারদের ভালো না করার কোনো কারণ নেই। সবকিছুই নির্ভর করছে সাহস, আত্মবিশ্বাস দৃঢ় মানসিকতার ওপর। প্রথম ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে চমৎকার শুরু করতে পারলে টাইগাররা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি থেকে অন্য স্বাদ পাবে।

দুবাই এবং পাকিস্তানের উইকেট নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে এর জন্য ভারতসহ অন্যান্য দলের স্কোয়াডেও স্পিনারদের প্রাধান্য। ক্রিকেট ইতিহাস কি বলছে? আফগান স্পিনারদের কথা সবাই কী ভাবছে। নাজমুল হাসান শান্তর নেতৃত্বে নির্বাচকগণ যে স্কোয়াড ঘোষণা করেছেন- এর বাইরে ফর্মে থাকা কোনো ক্রিকেটার কি আছেন? শুধু বাংলাদেশ নয় সব দেশেই দল গঠন নিয়ে প্রশ্ন উঠে। এবারও উঠেছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো টিম কম্বিনেশন এবং মাঠে ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে লড়াই। খেলার মধ্যে মনোসংযোগ ধরে রাখা।

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে অংশ নেওয়ার জন্য লম্বা সময় ধরে উপমহাদেশের বাইরের দলগুলো ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং দুবাইয়ে ওয়ানডে, ত্রিদেশীয় সিরিজ এবং টেস্ট ম্যাচ খেলেছে নিজেদের ঝালাই করে নেয়া এবং কন্ডিশনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য। বাংলাদেশ ছাড়া সব দেশই এই ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে। বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা অবশ্য খেলার মধ্যে ছিলেন, এটি গুরুত্বপূর্ণ। তারা বিপিএল টি-টোয়েন্টি খেলেছেন। স্কোয়াডে যাদের স্থান হয়েছে এদের মধ্যে দুই একজন ছাড়া সবাই ছন্দে ছিলেন। বিপিএলে সুবিধা করতে পারেননি দুই তিনজন ঠিকই ওয়ানডে অনুশীলন করেছেন। সময় পাওয়া যায়নি ওয়ানডে প্রস্তুতির জন্য।

দুবাইয়ে টাইগাররা একটি প্র্যাকটিস ম্যাচ খেলেছেন এবং পরাজিত হয়েছে। টি-টোয়েন্টি থেকে ওয়ানডেতে ‘সুইচওভার’। ছন্দে থাকা পেশাদারি ক্রিকেটারদের জন্য এটি এখন আর বড় সমস্যা নয়। প্রয়োজন মানসিক পরিবর্তন এবং খেলার মনোসংযোগ। দেশ তো তাদেরকেই প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দেয় যাদের সম্ভাবনা এবং সামর্থ্য আছে। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের সবচেয়ে প্রিয় সংস্করণ হলো ওয়ানডে। এই ক্রিকেটে তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আশা করি তারা ভালো ক্রিকেট উপহার দেবেন।

লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ