ঢাকার কলেজগুলোতে অস্থিরতার আদ্যোপান্ত
আধিপত্য বিস্তার ও নিজেদের ‘সেরা’ প্রমাণে ঢাকার কয়েকটি কলেজের ছাত্ররা নিজেদের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষে। এসব সংঘর্ষ তাদের ক্যাম্পাসে সীমাবদ্ধ না থেকে ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীর ব্যস্ততম সড়কগুলোতে। এসব আক্রমণ এবং পাল্টা আক্রমণের ঘটনায় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হওয়া ছাড়াও ক্ষতি হয় সরকারি এবং কলেজের নিজস্ব সম্পদের। রাজপথে দেখা দেয় অসহনীয় যানজট, ভাঙচুরের শিকার হয় যানবাহনও। সম্প্রতি কয়েকটি সংঘর্ষের ঘটনার আদ্যোপান্ত নিয়ে ভিউজ বাংলাদেশের এ প্রতিবেদন।
তিতুমীরে অস্থিরতা
১৮ নভেম্বর মহাখালীর তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবি আদায়ে রাস্তায় নামেন শিক্ষার্থীরা। ‘ক্লোজডাউন তিতুমীর’ কর্মসূচিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন এবং তাদের সড়ক, রেলপথ অবরোধের জেরে আহত হন সাধারণ মানুষ এবং রেলযাত্রীরা। তিন দিনের টানা আন্দোলনের পর তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে কমিটি গঠনের আশ্বাস পেয়ে আপাতত কর্মসূচি স্থগিত রেখেছেন শিক্ষার্থীরা। পর্যায়ক্রমে ফুঁসে ওঠে আরও কয়েকটি কলেজ। শিক্ষার্থীরা যার যার দাবিতে আন্দোলনে নামলে অস্থির হয়ে ওঠে শিক্ষাঙ্গন এবং এর রেশ গিয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের ওপর।
ঢাকা কলেজ-সিটি কলেজ সংঘাত
গত কয়েক বছর ধরে স্লেজিং, কথা কাটাকাটি, কটূক্তির মতো তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামান্য কারণেই বড় ধরনের সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ এবং আইডিয়া কলেজের শিক্ষার্থীরা। ২০ নভেম্বর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন ধানমন্ডির ঢাকা সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যেই ২১ নভেম্বর পাশের ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন তারা। রণক্ষেত্রে পরিণত হয় সায়েন্সল্যাব থেকে নিউমার্কেট এলাকা। সংঘর্ষে আহত হন দুই কলেজের দুই শতাধিক শিক্ষার্থী।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘অবৈধভাবে’ চেয়ার বাগানো ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পদে টিকে থাকতে শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণ করেননি। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়াতে উসকানিও দেন শিক্ষকরাই বলে দাবি করেন তারা। এ ঘটনার পর ঢাকা কলেজ এক দিন ও সিটি কলেজ তিন দিন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ সংঘর্ষের কারণ হিসেবে জানা যায়, ঢাকা কলেজের ১৮৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান শেষে বাসযোগে সব শিক্ষার্থী একে একে বের হয়ে যায়। তিনটি বাস সায়েন্স ল্যাব মোড়ে পৌঁছালে সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা বাসগুলো থামিয়ে কয়েকজনকে মারধর করে। তবে কী কারণে এ ঘটনা ঘটেছে তা এখনো স্পষ্ট জানা যায়নি। এরপর সায়েন্সল্যাব মোড়ে চলে সংঘর্ষ।
গত ১০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর সায়েন্সল্যাব এলাকায় ঢাকা কলেজ ও ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ১৮ জন আহত হন, যার মধ্যে বেশিরভাগই ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী।
তিন কলেজে হামলা, সংঘর্ষ
ভুল চিকিৎসায় অভিজিৎ হাওলাদার নামের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর অভিযোগের জের ধরে রোববার পুরান ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ এবং সোহরাওয়ার্দী কলেজে ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। চিকিৎসকদের ‘অবহেলা’য় সহপাঠী মৃত্যুর অভিযোগ তুলেছিলেন যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইলের ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা। এর সুষ্ঠু তদন্ত এবং জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে ২৪ নভেম্বর আন্দোলন শুরু করেন তারা। ২৪ নভেম্বর দুপুরে রাজধানীর প্রায় ৩৫টি কলেজের শিক্ষার্থীরা একজোট হয়ে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের ফটক অবরোধ ও ভাঙচুর করেন।
একই সময় পাশের সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজেও হামলা-ভাঙচুর চালান শিক্ষার্থীরা। সোহরাওয়ার্দী কলেজের মূল ফটক ভেঙে ক্যাম্পাসে ঢুকে মাইক্রোবাস, অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেটকার, দুটি মোটরসাইকেলসহ শ্রেণিকক্ষগুলোতে ব্যাপক ভাংচুর-লুটপাট চালান তারা। সোহরাওয়ার্দী কলেজের প্রিন্সিপাল অধ্যক্ষ ড. কাকলী মুখোপাধ্যায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা আমাদের ওপর হামলা করে।’
অন্যদিকে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, সেদিন তাদের আন্দোলন দমনে হামলা চালান কবি নজরুল কলেজ ও সোহরাওয়ার্দী কলেজ ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। এতে তাদের ২০ জন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন।
‘প্রতিশোধের হামলা’ মোল্লা কলেজে
২৪ নভেম্বরের হামলার ‘প্রতিশোধ’ নিতে পর দিন ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে পাল্টা হামলা, ভাঙচুর ও শিক্ষার্থীদের বেধড়ক পিটিয়ে আহত করেন সোহরাওয়ার্দী ও কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা এমন করতে পারে, আমরা ভাবিনি উল্লেখ করে মোল্লা কলেজের অধ্যক্ষ ওবায়দুল্লাহ নয়ন বলেন, ‘আমাদের সব ধ্বংস করে দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের পুঁজি করে কুচক্রী মহল কাজ করছে। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে দেশ অন্যদিকে চলে যাবে।’
বুটেক্স ও ঢাকা পলিটেকনিক্যালে সংঘর্ষ
২৪ নভেম্বর রাতে কথা কাটাকাটির মতো তুচ্ছ ঘটনার জেরে সংঘর্ষে জড়ান তেজগাঁওয়ের বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (বুটেক্স) ও ঢাকা পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। দফায় দফায় সংঘর্ষের পর মাঝরাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর একাধিক টিম মোতায়েন করতে হয়।
৭ ও ৩৫ কলেজের আধিপত্য বিস্তার
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর কলেজগুলো দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। তার মধ্যে ৩৫টি কলেজের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সাতটি কলেজের নেতৃত্বে রয়েছে আরেকটি গ্রুপ। নেতৃত্ব এবং আধিপত্য বিস্তারে কলেজগুলোকে অস্থির করে রেখেছে তারাই।
গুজবে সংঘর্ষ-সংঘাতের বিস্তার
২৪-২৫ নভেম্বর ঢাকার কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে ছড়ানো হয় নানা ধরনের গুজব। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে উসকানিমূলক পোস্টসহ দেয়া হয় ‘ছাত্রহত্যার’ মিথ্যা সংবাদও। এতে আরও সহিংস হন ছাত্ররা।
শিক্ষা উপদেষ্টার আহ্বান
শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘অনেকবার বলা হয়েছে, আন্দোলন করছেন শ্রমিক-শিক্ষার্থীরা। শুধু তারাই নন, ঢাকা নগরীতে কথায় কথায় আন্দোলন করছে বহু সংগঠন। তারা সড়ক আটকাচ্ছেন। এগুলোর সমাধান কী করে হবে, আমি তো একা সমাধান করতে পারছি না।’ শিক্ষার্থীদের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তোমাদের ন্যায্য দাবি আমার কাছে নিয়ে এসো, সেগুলো পূরণ করা হবে।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে