Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

কিংবদন্তির পরিবারই শঙ্কায়- এ লজ্জা কোথায় রাখি!

Mahbub  Sarkar

মাহবুব সরকার

শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

দেশের সবচেয়ে বেশি রেটিংধারী খেলোয়াড়। সর্বোচ্চ শিরোপা জিতেছেন জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে। বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি অলিম্পিয়াড খেলেছেন। সর্বোপরি বাংলাদেশের সেরা দাবাড়ু ছিলেন প্রয়াত জিয়াউর রহমান। গত জুলাইয়ে অনন্তলোকের পথে হাঁটা দাবাড়ুর পরিবারই এখন দুস্থ! উদীয়মান দাবাড়ুদের খেলাটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার জন্য আগের লাইনটিই যথেষ্ট!

জিয়াউর রহমানের সংসার চলছে বটে; কিন্তু একটা পরিবার পরিচালনার জন্য যে রসদ থাকা চাই বা দরকার, তা নেই। প্রয়াত গ্র্যান্ডমাস্টারের পরিবারের নিরাপত্তার একটা ব্যবস্থা দরকার।  তাহসিন তাজওয়ার জিয়াকে সুপার গ্র্যান্ডমাস্টার  হিসেবে গড়ে তুলতে প্রয়াত বাবার যে স্বপ্ন ছিল, তা পূরণ করতে চাই পৃষ্ঠপোষকতা।

বাংলাদেশই বোধকরি বিশ্ব মানচিত্রে একমাত্র রাষ্ট্র- যেখানে ক্রীড়াবিদরা দুস্থ ভাতার জন্য অসহায়ভাবে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ান! যে কারণে বিগত সরকার ঘটা করে ‘বঙ্গবন্ধু ক্রীড়াসেবী কল্যাণ ফাউন্ডেশন’ থেকে দুস্থ ভাতা প্রদান করেছে। ভাতার জন্য একে-ওকে ধরা, বিভিন্ন দপ্তরে তদবির করতে দেখা গেছে সাবেক-বর্তমান অনেক ক্রীড়াবিদকে। সে ভাতার অর্থ নিয়ে ‘নয়-ছয়’ গল্প শোনা গেছে। ‘বঙ্গবন্ধু ক্রীড়াসেবী কল্যাণ ফাউন্ডেশন’ থেকে নামে-বেনামে অর্থও হাতিয়ে নিয়েছেন অনেক কর্মকর্তা। এ কারণেই বোধকরি বাংলাদেশকে সব সম্ভবের দেশ বলা হয়।

আবারও আসল প্রসঙ্গে ফিরি- জিয়াউর রহমানের যে গল্পটা এখন শুনছেন, সেটা কিন্তু ভিন্ন চিত্রনাট্য দিয়ে সাজতে পারত। স্ত্রী তাসমিন রহমান লাবণ্য বিসিএস দিয়েছিলেন, চাকরিও হয়ে গিয়েছিল; কিন্তু স্বামীর দাবাচর্চায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে- আশঙ্কায় সরকারি চাকরির মোহ ত্যাগ করেছেন। ছায়ার মতো জিয়াউর রহমানের পাশে ছিলেন। পেশাদার দুনিয়ায় ক্রীড়াবিদদের ম্যানেজার যে দায়িত্ব পালন করেন, সেটা করে গেছেন তাসমিন রহমান লাবণ্য। ঘরে-বাইরে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় নাম নিবন্ধন, ফ্লাইট টিকিট নিশ্চিত করার মাধ্যমেই দায়িত্ব শেষ করেননি। দেশের বাইরের প্রতিযোগিতায় সঙ্গী হিসেবে গিয়েছেন। বাইরের সব বিষয় সামলাতেন তাসমিন রহমান লাবণ্য, জিয়াউর রহমানের কাজ ছিল কেবল বোর্ডে মনোযোগ দিয়ে খেলা।

তাসমিন রহমান লাবণ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। ২০০২ সালে ২২তম বিসিএসে সম্মিলিত মেধাতালিকায় চতুর্দশ স্থানে ছিলেন; নারীদের মধ্যে হয়েছিলেন দ্বিতীয়। ২২তম বিসিএসের অনেকেই এখন যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার। সরকারি চাকরির প্রলোভন উপেক্ষা না করলে তার পরিবারকে বর্তমান সময়ের মতো কঠিন পরিস্থিতির সমানে হয়তো দাঁড়াতে হতো না। কে জানে, এ দম্পতির জীবনের গতিপথ হয়তো বদলে যেত; নিশ্চিত হতো ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা; কিন্তু জিয়াউর রহমান নামের উজ্জ্বল নক্ষত্র যে বাংলাদেশের দাবার আকাশ আলোকিত করে গেছে, সে অধ্যায়টা হয়তো বড্ড সাদামাটা হয়ে থাকত। ইট-পাথরের বস্তি হয়ে ওঠা অস্বাস্থ্যকর শহরে থেকেও দাবার মতো তীক্ষ্ণ মনোযোগের খেলায় নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার ভিত্তিটা যিনি গড়ে দিয়েছিলেন; সেই তাসমিন রহমান লাবণ্য দিন কাটছে ভবিষ্যৎ সংক্রান্ত এভারেস্ট-সম ভাবনা নিয়ে!

জিয়াউর রহমান নিজেকে কেবল খেলার মধ্যে বন্দি রাখেননি। আন্তর্জাতিক দাবা সংস্থার (ফিদে) ট্রেইনার লাইসেন্সও নিয়েছিলেন। বলাটা হয়তো অনাবশ্যক; তারপরও বলছি, বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে দাবার কোচিং করাতে হলে ফিদে ট্রেইনার লাইসেন্স থাকা চাই। ফিদে ট্রেইনাররা সাধারণত ১৭০১ থেকে ২২০০ রেটিংধারী দাবাড়ুদের নিয়ে কাজ করেন। সে লাইসেন্স নেওয়া জিয়াউর রহমানের কোচিং কার্যক্রম দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও বিস্তৃত ছিল। জিয়াউর রহমানকে দেশসেরা দাবাড়ু এবং মেধাবী কোচ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে শ্রম দিয়ে, ঘাম ঝরিয়ে যিনি ভূমিকা রেখেছেন; সেই তাসমিন রহমান লাবণ্যকে এখন বাসা ভাড়া ইস্যুতে বিব্রত হতে হচ্ছে। ভাবতে হচ্ছে সন্তানের পড়াশোনার বিষয় নিয়ে।

বাংলাদেশ ক্রীড়াঙ্গনে এমন চিত্র যে হুট করেই সামনে এসেছে; বিষয়টি কিন্তু তা নয়। বরং এ দেশের ক্রীড়াঙ্গনের প্রকৃত চিত্র এটি। হাতে গোনা দু-একটা ক্রীড়া ডিসিপ্লিন বাদ দিলে বাকি ক্রীড়াঙ্গনের গল্পটা একই- ক্রীড়াবিদরা মায়ের প্রেসক্রিপশন পকেটে গুঁজে, বাবার ঋণ-সংক্রান্ত ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে খেলতে নামেন। সাফল্য-পরবর্তী সময়ে কিছুটা বাহবা পান, অবসরের পর ভাত-কাপড়ের কষ্ট করতে হয়। ছুটতে হয় দুস্থ ভাতার পেছনে। জিয়াউর রহমানের মতো কিংবদন্তি দাবাড়ুর পরিবারের করুণ গল্পটা নিষ্ঠুর বাস্তবতা হয়ে সামনে এসেছে। তাতে কি টনক নড়বে ক্রীড়াঙ্গনের অভিভাবকদের!

আন্তর্জাতিক মাস্টার আবু সুফিয়ান শাকিল জিয়াউর রহমানের পরিবারের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। প্রয়াত গ্র্যান্ডমাস্টারের পরিবারের বর্তমান অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে কণ্ঠ ভারী হয়ে আসছিল এ দাবাড়ুর, ‘সব মানদণ্ডে জিয়া (জিয়াউর রহমান) ভাই দেশসেরা দাবাড়ু। তার ধ্যান-জ্ঞান ছিল এ খেলাটি। তার কোনো সঞ্চয় নেই, যা আয় করতেন পরিবারের পেছনে ব্যয় হয়ে যেতেন। জিয়া ভাইয়ের পরিবারকে এমন কঠিন পরিস্থিতির সামনে দাঁড়াতে হবে- কল্পনাও করতে পারিনি।’ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) নিবন্ধিত এ কোচ আরও বলেন, ‘জিয়া ভাইয়ের মৃত্যুর পর অনেকেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ভাবছিলাম পরিবারের চলার একটা ব্যবস্থা হবে; কিন্তু কিছুই তো হচ্ছে না। জিয়া ভাইয়ের পরিবারের বর্তমান চিত্র উদীয়মান দাবাড়ুদের কিন্তু নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছে। দেশসেরা দাবাড়ুর পরিবারকে যদি এ পরিস্থিতির মুখে দাঁড়াতে হয়, সঙ্গত কারণেই ভবিষ্যতের কথা ভেবে বাচ্চারা দাবায় আসতে চাইবে না।’

আবু সুফিয়ান শাকিল যে বললেন জিয়াউর রহমানের ধ্যান-জ্ঞান ছিল দাবা। সেটা কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই। বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদ; দাবা ছাড়াও কিন্তু তার নানা বিষয়ে সংশ্লিষ্টতা আছে। দেশের তৃতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার রিফাত বিন সাত্তার ছাড়াও অন্যান্য দাবাড়ুদেরও ভিন্ন জগত রয়েছে। জিয়াউর রহমানের কিন্তু তেমনটা ছিল না। এ কারণে সন্তান তাহসিন তাজওয়ার জিয়াকে দাবাড়ু হিসেবে গড়ে তুলেছেন নিজ হতে। ফিদে মাস্টার টাইটেলধারী এ দাবাড়ু আছেন প্রয়াত বাবার পথেই।

জিয়াউর রহমান খেলাটা জীবনে এমনভাবে ধারণ করেছিলেন যে, খেলতে খেলতে মৃত্যু নামক অমোঘ সত্যটা মেনে নিয়েছেন। ৫ জুলাই বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের দাবা কক্ষে চলছিল জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়নশিপের দ্বাদশ রাউন্ডের খেলা। আরেক গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেনের বিপক্ষে খেলছিলেন জিয়াউর রহমান। খেলার একপর্যায়ে চেয়ার থেকে মেঝেতে ঢলে পড়েন। দ্রুতই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল; কিন্তু তার আগেই জীবন প্রদীপ নিভে গেছে। খেলতে খেলতেই দুনিয়া ছাড়লেন জিয়াউর রহমান, ছায়াসঙ্গী তাসমিন রহমান লাবণ্য পাশেই ছিলেন।

জিয়াউর রহমানের বাবা পয়গাম উদ্দিন আহমেদও ছিলেন জাতীয় দাবাড়ু। বাবার সঙ্গে নিয়মিত দাবা অঙ্গনে যাতায়াত ছিল শিশু জিয়াউর রহমানের। এভাবেই কোমলহৃদয়ে দাবার বীজ রোপিত হয়েছিল। অঙ্কুরিত সে বীজ জিয়াউর রহমানকে পরিপূর্ণ দাবাড়ু হিসেবে গড়ে তুলেছিল। জীবনাবসানের আগে জিয়াউর রহমানই সন্তান তাহসিন তাজওয়ার জিয়ার হৃদয়ে দাবার বীজ বপন করে দিয়ে গেছেন। বাবার প্রয়াণে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া উদীয়মান তাহসিন তাজওয়ার জিয়া হারিয়ে যাবেন না তো! উত্তরটা সময়ই দিতে পারে।

লেখাটা শেষ করার আগে জিয়াউর রহমানের হাইলাইটসে চোখ বোলানো যাক। জন্ম ঢাকায়, ১৯৭৪ সালের ১ মে। ১০ বছর বয়সে খেলাটির চর্চা শুরু করেছিলেন। শৈশব গুরু বাবা পয়গাম উদ্দিন আহমেদ। জিয়াউর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরির পেছনে ছুটতে যাননি। ১৪ বছর বয়সে ঘরোয়া সর্বোচ্চ দাবা আসর ‘জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ’ শিরোপা জিতেছেন। ১৯৯৩ সালে আন্তর্জাতিক মাস্টার এবং ২০০২ সালে গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব লাভ করেন। জিয়াউর রহমান চারবার দাবা বিশ্বকাপে খেলেছেন- ২০০৭, ২০১১, ২০১৩ এবং ২০১৫ সালে।

১৯৮৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত জাতীয় দাবায় ১৪ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন জিয়াউর রহমান, যা বাংলাদেশের পুরুষ দাবাড়ুদের মধ্যে সর্বোচ্চ সাফল্যের রেকর্ড। ১৯৮৮, ১৯৯৪, ১৯৯৬, ১৯৯৮, ১৯৯৯, ২০০১, ২০০২, ২০০৪, ২০০৫, ২০০৮, ২০০৯, ২০১১, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন প্রয়াত এ দাবাড়ু। জাতীয় আসরে সাফল্যর দিক থেকে জিয়াউর রহমানের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আরেক গ্র্যান্ডমাস্টার রিফাত বিনা সাত্তার; যিনি শিরোপা জিতেছেন ৬ বার। ১৫ বার বিশ্ব দাবা অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন জিয়াউর রহমান।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ