Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

কোটা আন্দোলন

মেধা নিয়ে কম মেধাবীর ভাবনা

Zeauddin Ahmed

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

শনিবার, ১৩ জুলাই ২০২৪

রকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে সারা দেশে শিক্ষার্থীরা ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে আন্দোলনের একটি কর্মসূচির বাস্তবায়ন শুরু করেছেন। ‘বাংলা ব্লকেড’ হচ্ছে অবস্থান কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশকে অচল করে দেয়া। ২০১৮ সালেও বিক্ষোভ এবং মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করছেন তারা এবং ২০১৮ সালেই প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে আওয়ামী লীগ সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে। ২০২১ সালে সরকারের মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন করেন; সেই রিটের রায়ে চলতি বছরের ৫ জুনে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংরক্ষিত কোটা বাতিলকে অবৈধ ঘোষণা করে আদালত। কোটা ব্যবস্থা আওয়ামী লীগ সরকার চালু করেছে, আবার তারাই তা বাতিল করেছে।

কোটা পদ্ধতি বাতিল ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের পরিপত্র বহাল রাখার জন্য শিক্ষার্থীরা রাজপথে আন্দোলন করছেন, আর আওয়ামী লীগ সরকার লড়ছে আদালতে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থী এবং আওয়ামী লীগ সরকারে লক্ষ্য এক ও অভিন্ন। অবশ্য শিক্ষার্থীরা এখন বলছেন, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও বিদ্যমান কোটা নীতি বাতিল করতে হবে, ওখানেও নাকি মেধার দরকার। এত মেধা, অথচ দেশে কোন আবিষ্কার নেই, উদ্ভাবন নেই; এমন কী অফিসের কর্ম সম্পাদনেও মেধা কোটার চেয়ে জেলা কোটার মেধা ঢের বেশি বলে প্রতিপন্ন হচ্ছে। জ্ঞানের কোনো সীমা নেই, একজন ব্যক্তির পক্ষে পৃথিবীর সব জ্ঞান ধারণ করা সম্ভব নয়। একটি গল্প জানি, সত্যতা যাচাই করার প্রয়োজন বোধ করিনি। ব্রিটিশ আমলে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের মৌখিক পরীক্ষায় নেতাজি সুভাষ বসু পরপর তিনটি প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হন; পরীক্ষা বোর্ডের এক ইংরেজ সদস্য অনেকটা রেগে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি দেখি কিছুই জান না’। উত্তরে নেতাজি বলেন, ‘আমি বহু কিছু জানি, সম্ভবত আপনাদের করা তিনটি প্রশ্নের উত্তর ছাড়া’। মেধা যাচাইয়ে অনুসৃত পদ্ধিতির ত্রুটি-বিচ্যুতি বিবেচনায় নেয়া দরকার।

স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বা চাকরির পরীক্ষায় উত্তরপত্র মূল্যায়নে সব শিক্ষক একই চিন্তা-চেতনায় সমৃদ্ধ নন। রক্ষণশীল শিক্ষকের হাতে উত্তরপত্র পড়লে যে নম্বর পাওয়া যায়, উদার শিক্ষকের মূল্যায়নে একই উত্তরপত্রে আরও বেশি নম্বর পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকে। এই বাস্তবতা মেনেই মেধার অবৈজ্ঞানিক তালিকা প্রণয়ন বাতিল করে গ্রেডিং পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছে; এই গ্রেডিং পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট গ্রেডের সকল শিক্ষার্থীকে সম মেধার অধিকারী বলে গণ্য করা হয়। এই বিবেচনায় সকল কোটার উত্তীর্ণ প্রার্থী সম মেধার অধিকারী। মেধাবীরাও নিশ্চয়ই জানেন, চাকরির জন্য সব কোটার প্রার্থীকেই লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নিয়ে যে প্যানেল হয়, সেখান থেকেই মেধা কোটা, মুক্তিযোদ্ধা কোটা, জেলা কোটা ইত্যাদি নির্ধারণ করা হয়। তাই মেধা কোটা এবং মুক্তিযোদ্ধা কোটার সকলে একই প্যানেলের উত্তীর্ণ প্রার্থী, তারা আকাশ থেকে প্যারাস্যুটে নেমে প্যানেলভুক্ত হননি, তাদের নিয়োগ দেওয়া হলে অফিস-আদালত মেধা শূন্য হয়ে যাবে- এমন প্রচার মূর্খতার পরিচায়ক।

বর্তমানে সকল মেধার চারণভূমি বিসিএস পরীক্ষার মাঠ। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সাবজেক্টে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় হয়েছেন তাদের অনেকেই কিন্তু পাকিস্তান আমলের সিএসএস বা বাংলাদেশ আমলের বিসিএস পরীক্ষায় পাস করেননি। কারণ সাবজেক্টে মেধাবীরা চাকরির পরীক্ষায় পাস করবেন এমন নিশ্চয়তা নেই। একজন লোকের জানার বাইরে কোটি কোটি জ্ঞান রয়েছে, প্রশ্নকর্তারা কোন সময় কোন প্রশ্ন করবেন তা আন্দাজ করাও কঠিন। জানার শেষ নেই বলে মেধার পরিপূর্ণতা বলতে কিছু নেই, বিশেষ বিশেষ জন বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবী, মেধার সামাণ্যীকরণ করে মেধাবী অভিধায় অভিজাত হওয়ার সুযোগ নেই। চাকরি সংশ্লিষ্ট পরীক্ষার ক্ষেত্রে কমন পড়লেই মেধাবী হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়, নতুবা অচ্যুত।

অসীম জ্ঞানের জগতে তাই নিয়তি বা ভাগ্যকে অবহেলা করা যাবে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক জীবনে যা লিখেছেন তা পড়ে শেষ করতে কয়েক জীবন লাগবে। মেধার পরিচয় ও প্রয়োজন গবেষণায়, আবিষ্কারে আর শিক্ষকতায়, প্রশাসনে নয়। কোন প্রশাসক পৃথিবীর মানুষের জন্য কিছু আবিষ্কার করেছেন বলে শোনা যায়নি। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্র পরিচালনায় আইন প্রণয়ন করেন সাংসদগণ এবং নীতি নির্ধারণ করেন মন্ত্রী পরিষদ, আমলা বা প্রশাসক নয়। মেধা থাকা দরকার আইন প্রণেতার, মন্ত্রীর; তাই মেধা যাচাইয়ের প্রয়োজন হলে সেই যাচাই করা দরকার রাজনৈতিক নেতাদের ওপর। জাতীয় স্বার্থেও আমরা কোটার সমর্থক। সর্মথক বলেই বাংলাদেশ তার রপ্তানির ক্ষেত্রে জিএসপি বা শুল্কমুক্ত অগ্রাধিকারমূলক রপ্তানির সুযোগ চায়। ব্রিটিশ আমলেও কোটা ছিল, বিভিন্ন উন্নত দেশেও এখনো কোটা প্রথা অনুসৃত হচ্ছে। যে আমেরিকা সারা পৃথিবী থেকে মেধা কিনে নেয় তারাও রেড ইন্ডিয়ানদের জন্য কোটা সংরক্ষণ করে রেখেছে। অস্ট্রেলিয়াও তাদের আদিবাসীর জন্য সুযোগ-সুবিধার সব দুয়ার খুলে রেখেছে, তারা বংশ পরম্পরায় শতাব্দীব্যাপী পরীক্ষা না দিয়েই চাকরি পাচ্ছে; কিন্তু আমাদের দেশে মুক্তিযোদ্ধারা কোণঠাসা, এখন নতুন করে মেধাবীরা কোণঠাসা করছেন।

মেধাবীদের জানা দরকার, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগপ্রাপ্তরাও সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী। তাদের মেধা, বুদ্ধ্যঙ্ক বা আইকিউ বরং অনেকের চেয়ে একটু বেশি, বেশি না হলে তাদের বাপ-দাদা মুক্তিযুদ্ধে যেতেন না; তারা প্রাগ্রসর চিন্তক ছিলেন বলেই বিজয়ী দলে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তাই মুক্তিযোদ্ধা কোটায় যারা চাকরি পান তাদের মেধা নেই, এমন ভাবা আহাম্মকের পরিচায়ক। মেধাবীরা মুক্তিযোদ্ধা কোটা মানেন না; কিন্তু কোটা মানেন ক্রিকেট খেলায়, ভোট প্রদানে, বৃত্তি আহরণে। ভারত ভালো ক্রিকেট খেললেও পাকিস্তান সমর্থক মেধাবীরা ভারতকে সমর্থন করেন না, এই ক্ষেত্রে পাকিস্তানের কোটা মেইনটেইন করেন। একই চিত্র পাকিস্তানের ভালো খেলার ক্ষেত্রেও দেখা যায়। মেধাবীরা কি দলমত নির্বিশেষে যোগ্য লোককে ভোট দেন? দেন না। ভোট দেন দলীয় প্রতীককে, মেধাহীন ব্যক্তির অর্থবিত্তকে। কারণ আমাদের বেশিরভাগ লোকের মানসিকতাই কোটায় আবদ্ধ।

উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশের বৃত্তি পাওয়ার ক্ষেত্রেও কোটা আছে; আছে বলেই বাংলাদেশের মেধাবীদের অনেক ক্ষেত্রে সারা পৃথিবীর মেধার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয় না, অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের জন্য বৃত্তি আলাদাভাবে বরাদ্দ থাকে বলেই তাদের মেধার এত বড়াই। সমুদ্রসমান জ্ঞানের পরিধিতে একটু সাঁতার কেটে মেধাবী দাবি করা কতটুকু সঙ্গত তাও বিচার্য। মেধার বিকাশে সরকার প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা দেশের সব অঞ্চলের সবাই সমানভাবে ভোগ করতে পারছে না। সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে শুধু মেধা একমাত্র বিচার্য হতে পারে না। যতদিন রাষ্ট্র তা করতে পারবে না ততদিন কোটা থাকা বাঞ্ছনীয়। কারণ কোটা না থাকলে প্রতিবন্ধীদের কেউ স্বেচ্ছায় ডেকে নিয়ে চাকরি দেবে না।

কোটা না থাকলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজন শুধু চাকরি নয়, ঢাকা শহরও দেখার সুযোগ পেত না। জীবন বাজি রেখে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তাদের অনেককে এক সময় স্বাধীন দেশে ভিক্ষা করে জীবনধারণ করতে হয়েছে। এই করুণ চিত্র নতুন প্রজন্মের মেধাবীরা দেখেননি। ১৯৯৬ সনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের পরিচয় দেওয়ার ক্ষেত্রে সাহসী হয়েছেন। দুঃখজনক হচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান শুধু মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা করছে না, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ও করছে; এই মন্ত্রণালয়ে গতিহীন, অকেজো, নির্জীব লোকের সমাবেশ, মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে নেতিবাচক খবরের জবাব দেওয়ার সাহসও এই মন্ত্রণালয়ের নেই।

মুক্তিযোদ্ধা কোটার হার ২০১৮ সালের আগেই কমানো উচিত ছিল। কারণ প্রার্থী না থাকায় মুক্তিযোদ্ধার কোটা দীর্ঘদিন মেধাবীরাই খেয়েছে। কোটা প্রথা বাতিল হলে দেশ মেধা শূন্যতা কাটিয়ে উঠবে, ঘুষ আর দুর্নীতিরও উচ্ছেদ হবে- এই প্রত্যাশা আমাদের সকলের। সর্বশেষে মেধাবীদের জন্য একটি উপদেশ, ‘সবাই সিংহের প্রশংসা করলেও পছন্দ করে গাধাকে।’

জিয়াউদ্দীন আহমেদ: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাবেক এমডি, টাকশাল

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ