Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

BD cricket 2023

সাকিবদের সাদামাটা বছরে জ্যোতি-রাব্বিদের চমক

Mir Mahbubur Rahman

মীর মাহবুবুর রহমান

মঙ্গলবার, ২ জানুয়ারি ২০২৪

‘২০২৩ সালটা বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা বছর হবে’–২০২২ সালের শেষ দিকে এক সাক্ষাৎকারে এমনটিই জানিয়েছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের ‘পোস্টারবয়’ সাকিব আল হাসান। তবে সাকিবের কথা সত্য প্রমাণিত হয়নি। দ্বিপক্ষীয় সিরিজে কিছু সাফল্য এলেও বছরটা ছিল হতাশারই। যেহেতু ২০২৩ সালটা ছিল বিশ্বকাপের বছর, তাই দল ব্যর্থ হলো নাকি সফল, তা নির্ভর করবে বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সের ওপরই। ভারতের মাটিতে ৫০ ওভারের বিশ্বকাপে ভরাডুবি হয়েছে বাংলাদেশের। তবে পুরুষ দল তেমন আলো না ছড়াতে পারলেও দুর্দান্ত খেলেছে নারী ক্রিকেট দল। বছরজুড়েই নিগার সুলতানা জ্যোতিরা অর্জন করেছেন নতুন নতুন মাইলফলক। তবে সাফল্যের বিচারে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল। যুবাদের কল্যাণেই বছরের শেষ দিকে দেশ মেতেছে এশিয়া বিজয়ের উল্লাসে।

সকালটা যে সবসময় দিনের ঠিক পূর্বাভাস দেয় না, সেটা আবারও প্রমাণিত হলো বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের বেলায়। বছরের শুরুটা দারুণ হলেও, পরে সেটি আর ধরে রাখতে পারেননি সাকিব আল হাসানরা। মার্চে বাংলাদেশের মাটিতে খেলতে আসে ইংল্যান্ড। ইংলিশরা সে সময় টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডে দুই ফরমেটেই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। প্রথম দুই ওয়ানডে হেরে সিরিজ হাতছাড়া করলেও তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে ৫০ রানে জয়লাভ করে বাংলাদেশ। এই জয় বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মাঝে এনে দেয় আত্মবিশ্বাস। পরে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশের লজ্জায় ফেলে লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা।

মার্চে বাংলাদেশে খেলতে আসে ইউরোপের আরেক দল-আয়ারল্যান্ড। ঘরের মাঠে আইরিশদের বিপক্ষে টাইগাররা ওয়ানডে সিরিজ জেতে ২-০ ব্যবধানে। এরপর টি-টোয়েন্টি সিরিজও নিজেদের করে নেয়, ব্যবধান ২-১। সফরের একমাত্র টেস্টেও জয়ী দলটির নাম বাংলাদেশ। টেস্টের দাপট অব্যাহত থাকে আফগানদের বিপক্ষে হোম সিরিজেও। বাংলাদেশ ক্রিকেটের অধিকাংশ সুখস্মৃতি রয়েছে যে মিরপুরের ‘হোম অব ক্রিকেটে’, সেখানেই ফের নতুন ইতিহাস লিখে টাইগাররা। নাজমুল হোসেন শান্তর নৈপুণ্যে আফগানদের বিপক্ষে রেকর্ড ৫৪৬ রানের বিশাল ব্যবধানে জয়লাভ করে বাংলাদেশ। উভয় ইনিংসেই শতক হাঁকান শান্ত (১৪৬ ও ১২৪)।

জুলাইয়ে আফগানদের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজটা ছিল বাংলাদেশের জন্য লজ্জার। ঘরের মাঠে রশিদ খানদের হাতে নাকাল হয় বাংলাদেশ, সিরিজ হারে ২-১-এ। এই সিরিজের মাঝখানে হঠাৎ করেই সব ধরনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন তৎকালীন ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবাল খান। টিম ম্যানেজমেন্টের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ইঙ্গিত দিয়ে চট্টগ্রামে সংবাদ সম্মেলনে চোখের জলে ক্রিকেটকে বিদায় জানান দেশসেরা ওপেনার। তামিমের ফিটনেস নিয়ে বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের মন্তব্যই নাকি তামিমের অবসরের সিদ্ধান্তের কারণ। তবে তামিম কোনো কিছুই স্পষ্ট করেননি। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত গড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত। ক্রীড়ামোদী প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে পরে অবসর থেকে সরে আসেন তামিম।

নাটকটা শেষ হতে পারতো সেখানেই; কিন্তু তা হয়নি। বরং বোর্ড-তামিমের মতপার্থক্যের জেরে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে ফেলা হয় তামিমকে। সাকিব আল হাসানকে অধিনায়ক বানিয়ে বিশ্বকাপের দল ঘোষণা করে বিসিবি। প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু তামিমের ইনজুরির অজুহাত দেখালেও, তামিম নিজে ভিডিও-বার্তায় জানিয়েছিলেন তিনি ফিট। এদিকে, বিশ্বকাপ শুরুর আগমুহূর্তে এক টিভি সাক্ষাৎকারে তামিমকে নিয়ে বেশ কিছু মন্তব্য করেন সাকিব, যা মেনে নিতে পারেননি অনেক ক্রিকেটপ্রেমীই। তাই, সাকিবের কারণেই তামিম বাদ পড়েছেন–বিশ্বব্যাপী এমন আলোচনায় তোলপাড় ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।

বিশ্বকাপের আগে আগস্টের শেষ দিকে শুরু হয় হাইব্রিড মডেলের এশিয়া কাপ। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের মাটিতে অনুষ্ঠিত এই আসরেও বাংলাদেশ দলের পারফরম্যান্স বলার মতো ছিল না। আফগানদের হারিয়ে সুপার ফোরে উঠলেও এই আসরে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশ হেরেছে দুবার। শোচনীয় হারের শিকার হয়েছে পাকিস্তানের বিপক্ষেও। তবে ভারতের বিপক্ষে ৬ রানে জয়লাভ করে বাংলাদেশ। যদিও এই জয়টাও এসেছে নিয়মরক্ষার ম্যাচে। আগেই ফাইনাল নিশ্চিত হওয়া ভারত এই ম্যাচে খেলেছে মূল একাদশের অনেককেই বাইরে রেখে। তাই এই জয় মন ভরাতে পারেনি বাংলাদেশের ক্রিকেটভক্তদের।

৫ অক্টোবর ক্রিকেট পাগল দেশ ভারতে শুরু হয় ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপের আসর। চরম হতাশার একটি বিশ্বকাপ কাটায় বাংলাদেশ। ২০০৭, ২০১১, ২০১৫ ও ২০১৯ সালে ৩টি করে জয় পেলেও ২০২৩-এ এসে বাংলাদেশ পেয়েছে মাত্র ২টি জয়। একটি আফগানিস্তানের বিপক্ষে, অপরটি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। লঙ্কানদের বিপক্ষে জিতে আসন্ন চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলা নিশ্চিত করলেও বাংলাদেশ সমালোচিত হয়েছে অ্যাঞ্জেলা ম্যাথুজকে ‘টাইমড আউট’ করে। এ ছাড়া ভারত, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দাঁড়াতেই পারেনি বাংলাদেশ। এমনকি শোচনীয়ভাবে হারতে হয়েছে নেদারল্যান্ডসের মতো খর্বশক্তির দলের কাছেও।

বিশ্বকাপের পর শান্তর নেতৃত্বে যেন নতুনভাবে শুরু করে বাংলাদেশ। ঘরের মাঠে (সিলেটে) পরাশক্তি নিউজিল্যান্ডকে টেস্টে হারায় তরুণ দলটা। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এমন নজির এই প্রথম। পরে ঢাকা টেস্টে হারলেও সিরিজ ভাগাভাগি করে শান্তর দল। এরপর বছরের শেষ দিকে বাংলাদেশ ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলতে নিউজিল্যান্ডে যায়। সেখানেও দারুণ ফল-ওয়ানডে সিরিজ হারলেও নিউজিল্যান্ডের মাটিতে স্বাগতিকদের বিপক্ষে ওয়ানডে জয়ের স্বাদ পায় বাংলাদেশ। এরপর তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচেই জয় পেয়ে সিরিজ জয়ের আশা জাগিয়ে তোলে লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। তবে দ্বিতীয় ম্যাচ পরিত্যক্ত ও শেষ ম্যাচে হারের ফলে সিরিজ ভাগাভাগি করে বছর শেষ করে শান্তবাহিনী।

এদিকে, দারুণ একটা বছর কাটিয়েছে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। বছরের শুরুতে বিশ্বকাপ ব্যর্থতার পর দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়ায় নিগার সুলতানা জ্যোতির দল। নারীদের ক্রিকেটের অন্যতম পরাক্রমশালী দল ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ ভাগাভাগি করে বাংলাদেশ। এরপর এশিয়ান গেমসেও সাফল্য আসে। পাকিস্তানকে হারিয়ে অর্জন করে ব্রোঞ্জ পদক। এশিয়াডের পর ঘরের মাঠেও পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডে সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশের মেয়েরা। অক্টোবরে চট্টগ্রামে পাকিস্তানকে নাস্তানাবুদ করে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জেতে টাইগ্রেসরা। জ্যোতিরা ওয়ানডে সিরিজও জেতে একই ব্যবধানে।

বছরের শেষ দিকে তিন ম্যাচের ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলতে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গিয়েছিল নারী দল। চমক দিয়ে সফর শুরু করে টাইগ্রেসরা। তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম টি-টোয়েন্টিতে ইতিহাস গড়ে প্রোটিয়া মেয়েদের হারিয়ে দেয় নিগার সুলতানা জ্যোতির দল। এটি প্রোটিয়াদের মাটিতে বাংলাদেশের প্রথম জয় ছিল। সিরিজের দ্বিতীয় টি-২০ ম্যাচটি বৃষ্টি বাধায় ভেস্তে যায়। ফলে সিরিজের ভাগ্য গড়ায় তৃতীয় ও শেষ টি-টোয়েন্টিতে। যেখানে স্বাগতিকদের কাছে হেরে যায় টাইগ্রেসরা। এতে ১-১ সমতায় শেষ হয় সিরিজটি। ওয়ানডেতেও ঝলক দেখায় বাংলার মেয়েরা। তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতেই প্রোটিয়া মেয়েদের বিপক্ষে জয় তুলে নেয় তারা। তবে সিরিজের বাকি দুটি ম্যাচ হেরে যায় টাইগ্রেসরা। এতে ২-১ ব্যবধানে সিরিজটি হাতছাড়া হয় জ্যোতিদের।

দলীয় অর্জনের পাশাপাশি বছরজুড়ে ব্যক্তিগত অর্জনও ছিল নারী ক্রিকেটারদের। গত জুলাইয়ে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি করেন ফারজানা হক পিংকি। পরে প্রোটিয়াদের বিপক্ষে ওই সিরিজেই ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেঞ্চুরির দেখা পান তিনি। অন্যদিকে গত নভেম্বরে পাকিস্তানের বিপক্ষে দুর্দান্ত সিরিজ জয়ে বল হাতে অবদান রাখেন নাহিদা আক্তার। ওই সিরিজের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জেতেন তিনি। তিন ম্যাচে স্রেফ ১৪.১৪ গড়ে তিনি নিয়েছিলেন ৭ উইকেট। এখানেই থেমে থাকেননি নাহিদা, ঘরের মাঠে পাকিস্তানের বিপক্ষে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করে আইসিসির মাসসেরা ক্রিকেটারও নির্বাচিত হন তিনি। বাংলাদেশের প্রথম নারী ক্রিকেটার হিসেবে এ কীর্তি গড়েন ২৩ বছর বয়সী তারকা।

বছরের শেষ দিকে পুরো লাইমলাইট কেড়ে নেয় বাংলাদেশ যুব দল। পাকিস্তান-ভারত-শ্রীলঙ্কা-আফগানিস্তানের মতো দলগুলোকে টপকে বাংলাদেশের তরুণ ছেলেরা জিতে নেয় অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপের শিরোপা। ১৭ ডিসেম্বর দুবাইয়ের ফাইনালে স্বাগতিক সংযুক্ত আরব আমিরাতকে একেবারে উড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ। যুব দল এর আগে বিশ্বকাপ জিতলেও, এশিয়া কাপ জয় এবারই প্রথম। এশিয়া বিজয়ের উচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়ার অবশ্য সুযোগ নেই যুবাদের। জানুয়ারিতেই অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ। ১৯ জানুয়ারি থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবে এ আসর। এই প্রোটিয়াদের মাটিতেই ২০২০ বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেছিল জুনিয়র টাইগাররা। আসন্ন আসরেও যুবারা দেশের সম্মান বৃদ্ধি করবে–এমনটিই প্রত্যাশা।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ