ক্রিকেটে স্বস্তির জয়
‘হোয়াট এ ওয়ান্ডারফুল কাম ব্যাক’। আর এটি কাঙ্ক্ষিত এবং সময় অনুযায়ী। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের জন্য বড় প্রয়োজন ছিল। ক্রিকেটের আকাশ মেঘমুক্ত হয়েছে। আলোর আভা লক্ষণীয় হচ্ছে। আমরা সবাই তাকিয়ে সেই আলোর দিকে। আমাদের প্রত্যাশা আগেও যা ছিল, তাই আছে। আমরা চাই ভালো খেলা। মাঠে ভালো প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি করা।
যুক্তরাষ্ট্র আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের যৌথ উদ্যোগে নবম বিশ্বকাপের ‘ডি’ গ্রুপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে (যারা একবার বিশ্বকাপ জিতেছে, দুইবার রানার্সআপ হয়েছে) খেলতে নেমে প্রথম খেলায় ২ উইকেটে জয় শুধু দেশের ক্রিকেটে গুমোট পারিপার্শ্বিক অবস্থা পাল্টে দেয়নি- অনেক স্বস্তি এনে দিয়েছে।
বুঝে না বুঝে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যক্তি এবং সমষ্টির স্বার্থ উদ্ধারের খেলায় এত নেতিবাচক সমালোচনা এবং ব্যক্তি বিশেষের পেছনে লেগে থাকার নোংরা খেলা আপাতত বন্ধ হবে মনে করছি। দেশের ক্রিকেট কিন্তু কখনো কয়েকজন ব্যক্তি মানুষকে নিয়ে নয়- ক্রিকেট দেশের ১৭ কোটি মানুষের আবেগ এবং ভালোবাসা। জাতীয়তাবাদী বড় শক্তি হিসেবে চিহ্নিত।
বিজয় শুধু আত্মবিশ্বাস বাড়ায় না, অনুপ্রাণিত করে না, সাহস এবং মানসিক শক্তি বৃদ্ধি করে না- নিজের সামর্থ্যের ওপর আস্থা রাখার মনোবল দৃঢ় করে। লক্ষ্যে পৌঁছানোর সংকল্পকে মজবুত করে। মনের মধ্যে জন্ম দেয় ইতিবাচক ধারণা তা হলো সবাই মিলে গুছিয়ে দায়িত্বশীল ক্রিকেট খেলতে পারলে অনেক কিছুই সম্ভব- সময় মতো সামর্থ্যের প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হলে টি-টোয়েন্টি সংস্করণে কোনো দলই অপ্রতিরোধ্য নয়। অতএব, দিনের খেলায় অমিল।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ভীষণ চাপ নিয়ে (ক্রিকেটে চাপ থাকবেই। সেই চাপ সামাল দিয়ে খেলতে হবে। খেলা উপভোগ করতে হবে) খেলতে নেমেছিল বাংলাদেশ দল। কারণ হলো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে মাঠে নামার আগে বাংলাদেশ দল নিয়ে বড় বেশি নেতিবাচক সমালোচনা হয়েছে। তারপরও খেলোয়াড়রা কিন্তু মানুষের প্রত্যাশাকে (ভালো খেলা) সম্মান করতে সক্ষম হয়েছেন ২ উইকেটে জয় নিশ্চিত করে। তবে সহজ ম্যাচটাকে কঠিন করে জিতেছে টিম বাংলাদেশ। তারপরও এই জয় মধুর। এই জয় অন্য এক ধরনের অভিজ্ঞতা। ক্রিকেট দলীয় খেলা, সবাই জয়-পরাজয়ের ভাগীদার। তারপরও বলতে হবে এই জয়ের বড় কৃতিত্বের ভাগীদার বোলারদের আক্রমণাত্মক বোলিং এবং দুর্দান্ত ফিল্ডিং।
বলতেই হবে এখনো টপ-অর্ডারের কেউ কেউ এলোমেলো এবং ‘অফ ফর্মে’ আছেন। এটি উদ্বেগের কারণ সন্দেহ নেই। আপাতত বাংলাদেশ দলের জন্য এটা মেনে নেয়া বা হজম করা ছাড়া তো উপায় নেই। ভালো খেলোয়াড়ের প্রকট অভাবে ভুগছে আমাদের ক্রিকেট। সিলেকটাররা বলছেন ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে ২৫ জন খেলোয়াড় খুঁজে পাওয়া যাবে না, যারা স্কোয়ার্ড স্থান পেতে পারেন। এই যে খেলোয়াড় নেই, এটি নিয়ে তো কাজ করা দরকার হয়ে পড়েছে।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে খেলায় আমরা লক্ষ্য করলাম লিটন দাস আস্থার সঙ্গে খেলে ৩৬ রান করেছেন। ভাবতে ভালো লাগছে তিনি তার অফ ফর্ম কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছেন। এটি দলের জন্য ইতিবাচক। সৌম্য সরকার, নাজমুল হাসান, সাকিব আল হাসান প্রমুখকে তাদের দলে অবস্থান এবং দায়িত্ব পালন নিয়ে ভাবতে হবে। ‘ব্যাড প্যাচ’ থেকে বের হতেই হবে। নাজমুল হাসান অধিনায়ক হিসেবে মাঠে বোলার ব্যবহারের ক্ষেত্রে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। প্রথম খেলায় উন্নতমানের ফিল্ডিং লক্ষণীয় হয়েছে। ভালো লেগেছে মাঠে অবস্থানরত খেলোয়াড় শারীরিক ভাষা লক্ষ্য করে। অধিনায়ক নাজমুল বুঝতে হবে যে তাকে পারফর্ম করতেই হবে পুরো দলকে অনুপ্রাণিত করার জন্য। বাংলাদেশ দল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বিজয়কে কাজে লাগাতে পারে আগামীতে কতটুকু এটি দেখার বিষয়।
শ্রীলঙ্কার ৯ উইকেটে ১২৪ রানের জবাবে খেলতে নেমে বাংলাদেশ দল ১৯ ওভারে ৮ উইকেটে ১২৫ রান করে খেলায় জিতেছে। আগেই উল্লেখ করেছি সহজ খেলাকে কঠিন করা হয়েছে। ব্যাটারদের যে সামর্থ্য আছে, তার প্রতিফলন ঘটাতে পারলে কিন্তু এত উইকেট বিলিয়ে জয় পেতে হতো না। এটি কিন্তু ব্যাটসম্যানদের একটি শিক্ষা। তৌহিদ হৃদয় খুব ভালো ব্যাট করেছেন। (৪০ রান)। দাপটের সঙ্গে উইকেটে ছিলেন। তিনি ফর্মে আছেন অনেক দিন ধরে তার সুফলও পাচ্ছে দল। অভিজ্ঞ ক্রিকেটার মাহমুদউল্লাহ। তার কাজটি সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছেন। ১৩ বলে অপরাজিত ১৬ রান। সবচেয়ে বড় কথা হলো এই জয়ে তার অভিজ্ঞতা অনেক বেশি কাজে লেগেছে। তার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ক্রিকেট পণ্ডিতরা মাহমুদউল্লার অবদানের কথা বার বার উল্লেখ করেছেন।
বোলিংয়ে মোস্তাফিজ তার আইপিএলের ছন্দ ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। ১৭ রানের বিনিময়ে প্রতিপক্ষের তিন ব্যাটারকে সাজ ঘরে পাঠিয়ে দলকে লড়াইয়ে রেখেছেন। অন্য দুই পেশার তাসকিন ও তানজিম গুছিয়ে বল করেছেন। নিয়েছেন যথাক্রমে ২ ও ১টি উইকেট। এদিকে লেগ স্পিনার রিশাদ হোসেন নিয়েছেন ৩টি উইকেট মাত্র ২২ রানে। রিশাদ হোসেন পেয়েছেন ম্যাচসেরা পুরস্কার। তরুণ লেগ স্পিনার রিশাদ হোসেনকে নিয়ে ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা অনেক আগে থেকেই কথা বলেছেন। বলেছেন তার সামর্থ্যের কথা। বলেছেন রিশাদ হোসেন কিছু কিছু উইকেটে ‘ম্যাচ উইনার’ হিসেবে চিহ্নিত হবেন।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশ দলের জয়টা ছিল পরিকল্পনা, তার বাস্তবায়ন এবং প্রোসেসের। ক্রিকেটকে কখনো মনোসংযোগের বাইরে নেয়ার সুযোগ নেই। ‘মোমেন টাম’ এবং একাগ্রচিত্ত তারা ব্যাঘাত ঘটলেই বিপদ আসবেই। ক্রিকেট অল্প কয়েকদিনের জন্য এটি শেষ হলেই দুনিয়ার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে কোনো সমস্যা নেই।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট সংস্করণে দল পুনর্গঠনের কাজ চলছে। ভালো লাগছে কিছু তরুণ খেলোয়াড় এই ক্রিকেটে তাদের দায়িত্বশীল খেলার মাধ্যমে তাদের সামর্থ্য তুলে ধরতে সক্ষম হচ্ছেন। এটি বিষয় ইতিবাচক। সবাই ক্রিকেটে এগিয়ে চলেছে বিশেষ করে টি-টোয়েন্টি সংস্করণে। সেখানে কেন ১৭ কোটি মানুষের দেশের প্রতিনিধিরা মাঠে নেমে এলোমেলো ক্রিকেট খেলবেন। টি-টোয়েন্টি যেভাবে খেলতে হয় সেভাবে পারবেন না।
লেখক: কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে