সিলেটে পাথর উত্তোলন করে মাজার ধ্বংসের পাঁয়তারা!
পাথর উত্তোলনে টিলাভূমির লিজ আনার অপচেষ্টায় একের পর এক ধ্বংসযজ্ঞ চলছে সিলেটের পাথররাজ্যে। এই ধ্বংসযজ্ঞের নেপথ্যে রয়েছে প্রভাবশালী চক্র। প্রশাসনিক ভূমিকা নির্বিকার থাকায় এই চক্র এখনো অপ্রতিরোধ্য। ফলে একদিকে যেমন ধ্বংস হচ্ছে টিলাভূমি অন্যদিকে এর প্রভাব পড়ছে বাড়ি-ঘর, বাজার, মসজিদ এবং মাজারগুলোতে। ধ্বংসযজ্ঞের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না খেলার মাঠ ও কবরস্থানও।
এবার পাথর লুটপাটের ঘটনায় অস্তিত্ব হারাতে বসেছে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ৭০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী হযরত শাহ আরেফিনের (রহ.) মাজার। এর আগে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার বিছানাকান্দি এলাকার প্রভাবশালী চক্রের হাতে লুট হয়েছে শত কোটি টাকার পাথর। দুটি লুটপাটের ঘটনাই শুরু হয় গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর থেকে। স্থানীয়রা বলছেন, দুটি ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ। তবে বিছানাকান্দির ঘটনায় মামলা হওয়ায় দুই আসামি ধরা পড়লেও মূল হোতাদের এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
জানা গেছে, সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে ৭০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী হযরত শাহ আরেফিনের (রহ.) মাজার রক্ষায় চারপাশে কালো পাথর দিয়ে বেড়িবাঁধ তৈরি করা হয়, যা প্রায় কয়েক শ বছরের পুরোনো। যেখানে রয়েছে ২০০ বছরের পুরোনো একটি বটবৃক্ষ। রয়েছে শত শত ফলদ বনজ ও ঔষধি গাছ। কিন্তু এখন আর সেই অবস্থা নেই। অবাধে চলছে ধ্বংসযজ্ঞ। মাজারের চারপাশে কয়েক শ বছরের পুরোনো বেড়িবাঁধের কালো পাথরগুলো লুটপাট করা হয়েছে। মাজারে শত শত ফলদ বনজ ও ঔষধি গাছ ইতোমধ্যে কর্তন করা হয়েছে। ২০০ বছরের পুরাতন বটগাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। মূল মাজার খুঁড়ে এখন পাথর উত্তোলনের হিড়িক চলছে। নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হচ্ছে শাহ আরেফিনের (রহ.) স্মৃতিবিজড়িত এই স্থানকে।
ঐতিহ্যবাহী এই স্থানে লুটপাট ও ধ্বংসযজ্ঞ চললেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। জানা গেছে, ১৩৭ দশমিক ৫ একর টিলার মধ্যে ১০ একর জায়গা শাহ আরেফিন (রহ.) ও বিন্দিয়া মাজারের নামে ওয়াকফ করা। এই ১০ একর জায়গায় মাজার, মসজিদ, কবরস্থান ও একটি মাঠ ছিল। মাঠ ও কবরস্থান থেকে পাথর উত্তোলন করে ইতোমধ্যে বিলীন করে দেয়া হয়েছে। ২ বছর ধরে মসজিদের কার্যক্রমও নিয়মিত পরিচালিত হচ্ছে না। মসজিদের চারদিকে পাথর উত্তোলন করায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সম্প্রতি গত এক মাস ধরে মাজারের মূল অংশের পাথর লুটপাট করা হচ্ছে। এক সপ্তাহে শুধু মাজারের বেড়িবাঁধ থেকে প্রায় ২ কোটি টাকার পাথর লুটপাট করা হয়েছে। তাছাড়া মাজারের মূল অংশ থেকে প্রায় ৪০-৫০ ফুট গর্ত করে পাথর উত্তোলন চলছে। মাঠ, মসজিদ ও কবরস্থান হয়ে মাজারে যাওয়ার রাস্তা বিলীন করে দেয়া হয়েছে। ফলে এখন মাজারের ভেতরে গর্ত করে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে।
মাজারের দায়িত্বে থাকা মহিত শাহ ওরফে লালু শাহ জানান, ২০০৭ সালের পর যখন পাথর উত্তোলন করে মাজার ধ্বংসের পাঁয়তারা শুরু হয় তখন আমি সরকারি ওয়াকফ এস্টেট থেকে নিবন্ধন করি। এরপর ২০১৯ সাল পর্যন্ত আমি মাজার সংরক্ষণ করে রাখতে পেরেছি। সে সময় মাজার রক্ষায় ডিসি, পরিবেশ, খনিজ মন্ত্রণালয়, এসপি, বেলা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরে কোর্ট ফি যুক্ত অভিযোগ করি। পরে মাজারের জায়গা থেকে পাথর উত্তোলন করার জন্য ঢাকায় গিয়ে নতুন একটি কমিটি গঠন করে নিয়ে আসা হয়।
বিষয়টি নিয়ে আমি সচিবের কাছে লিখিত অভিযোগ করলে মাজার কমিটির সব কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। বর্তমানে মাজারকে নিশ্চিহ্ন করতে মাজারের বেড়িবাঁধের সব পাথর লুটপাট করা হয়েছে। এই পাথরগুলো কয়েক শ বছরের পুরোনো ছিল। একেকটি পাথর ২০ কেজি থেকে প্রায় ১০০ মণ ওজনের ছিল। বড় বড় পাথর হাঁতুড়ি দিয়ে ভেঙে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মাজার ধ্বংসকারীরা জানিয়েছে, এই মাজারের জন্য নাকি তারা টিলা লিজ আনতে পারছে না। তাই তারা মাজার ধ্বংস করতে শুরু করেছে। এজন্য মাজার রক্ষায় আমি শিগগিরই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ করব।
খান বাহাদুর এহিয়া ওয়াকফ এস্টেটের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. ইসলাম উদ্দিন জানান, মাজার ধ্বংসের বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। শাহ আরেফিনের মাজার ও ওয়াকফের জায়গা রক্ষায় আমরা পদক্ষেপ নিব। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে আমি দেখছি।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. আনোয়ার উজ জামান বলেন, সংশ্লিষ্ট ইউএনওকে আমি বিষয়টি জানাচ্ছি। এ বিষয়ে তাকে পদক্ষেপ নিতে বলব।
এদিকে গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তন এর পর বিছানাকান্দির ভারত সীমান্তবর্তী স্থান থেকে প্রায় শত কোটি টাকার পাথর উধাও হয়ে গেছে। যে পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া স্বচ্ছ পানির স্রোত পর্যটকদের আকৃষ্ট করত, সেই জায়গায় এখন গভীর গর্ত ছাড়া কিছুই নেই। বিছানাকান্দি থেকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনকারীরা নো-ম্যানস ল্যান্ডের কয়েক মিটার ভেতর পর্যন্ত অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করছে। ঘটনা পরিদর্শনকালে গোয়াইনঘাট উপজেলার তোয়াক্কুল ভূমি অফিসের উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা হুসেইন মোহাম্মদ সজীবের নেতৃত্বে ভূমি অফিসের একটি টিম একটি পাথরবোঝাই নৌকাসহ পাথর উত্তোলনকালে দুই শ্রমিককে আটক করেন। কিন্তু তার কিছুক্ষণ পর অন্তত ২৫ থেকে ৩০ জন শ্রমিক ৭-৮টি নৌকা নিয়ে পাথর উত্তোলন শুরু করে। এমনকি অবৈধভাবে নো-ম্যানস ল্যান্ড থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধে বিজিবির কোনো তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি।
গোয়াইনঘাট ইউএনও মো. তৌহিদুল ইসলাম জানান, নো-ম্যানস ল্যান্ড বিজিবির আওতাধীন। সেখানে আমাদের কিছু করার নেই। আমরা বিজিবিকে বিষয়টি অবগত করেছি। বিজিবির পক্ষ থেকে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।
স্থানীয় কয়েকজন যুবক জানান, ৫ আগস্টের পর স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির সহযোগিতায় দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা এখান থেকে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার পাথর উত্তোলন করা হয়।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে