Views Bangladesh Logo

এক গরিব পিতার স্বপ্ন

Mahmud  Jalal

মাহমুদ জালাল

টা কল্পকাহিনি না। তবে অনেকটা উপন্যাসের মতোই। আমি এমন এক বাস্তব গল্পের সাক্ষী যা একদিন হয়তো ফুটবল ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠবে। গল্পটি শহিদুলের। শহিদুল বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামের গবির এক তরুণ। বুকভরা আগুন ছাড়া তার আর কিছুই নেই। তার সমস্ত স্বপ্ন ফুটবলকে ঘিরে। সে পণ করেছে তার সাড়ে তিন বছরের ছেলে পিটার ডনকে একদিন বিশ্বসেরা ফুটবলার বানাবে।

তার গল্প শুরুটা মাঠে নয়, এক বেদনার দিনে- যেদিন জার্মানি কাতার বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড থেকেই বাদ পড়ে যায়। পৃথিবীর অন্য সব জার্মানি ভক্তরা হয়তো হতাশ হয়েছিল; কিন্তু শহিদুল একেবারেই ভেঙে পড়েছিল। কয়েকদিন কাজে যায়নি। আমি যখন ফোনে তাকে খুঁজে পেলাম, সে কথা বলতে পারছিল না। শুধু কান্নার শব্দ, বুকভাঙা আর্তনাদ। তখন আমি বুঝলাম, কেবল যে জার্মানির প্রতি টান থেকেই ও এরকম করছে তা না, এটা ছিল একটা বিশেষ দলের প্রতি উন্মুত্ত ভালোবাসা প্রকাশ। যার সঙ্গে সে আত্মিকভাবে জড়িয়ে পড়েছে।

শহিদুল সাধারণ কোনো ফুটবলভক্ত না। সে যেন চলন্ত এক বিশ্বকোষ। হাঁটতে-চলতে, প্রতিটা নিঃশ্বাসের সঙ্গেই তার ফুটবল। অথচ সে লেখাপড়া করেছে খুব অল্প। ঢাকায় ম্যাসেঞ্জার হিসেবে কাজ করে। আয় যৎসামান্য; কিন্তু ফুটবল নিয়ে তার জ্ঞানের পরিধি বিস্ময়কর। বুন্দেসলিগা থেকে লা লিগা, উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে কোপা আমেরিকা- সবকিছুই তার নখদর্পণে। লোথার মাথাউস, মিরোস্লাভ ক্লোজে, ফিলিপ লামের মতো কিংবদন্তিদের নিয়ে সে একটানা কথা বলতে পারে। আজকের যত সব বিখ্যাত তারকা- মুসিয়ালা, হাভার্টজ, কিমিচ, সানে, গুনদোয়ান- নিয়ে বিশ্লেষণ করেন। এমনকি ভবিষ্যতের সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়- পাভলোভিচ, দারভিচ, মৌকোকো- নিয়েও তার নজরদারি একজন স্কাউটের মতো।

শুধু পরিসংখ্যান মুখস্থ করেই খ্যান্ত না সে। সে এগুলোর মধ্যেই বেঁচে থাকে। ম্যাচের সূচি, ইনজুরি রিপোর্ট, কোচদের রেটিং, ট্রান্সফার আপডেট- সব কিছু তার হাতের তালুতে থাকে সবসময়। কোচিং কৌশল নিয়েও তার রয়েছে তীক্ষ্ণ সমালোচনা। ফর্মেশন ও ট্যাকটিকস এমনভাবে বিশ্লেষণ করে যেন নিজেই সাইডলাইনে দাঁড়িয়ে আছন। তার ফোনে ফুটবল অ্যাপ সারাদিন শব্দ করে আর প্রতিদিন সকালে সে আমাকে হাইলাইটস, বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যদ্বাণী পাঠায়। আমরা প্রতিদিন ফুটবল নিয়ে কথা বলি। আমিও জার্মান ফুটবলের ভক্ত, তাই শহিদুলের সঙ্গে আমার ভালো একটা বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে; কিন্তু শহিদুলের আগুনের কাছে নিজেকে আমার ফিকে লাগে।

এই গল্পের সবচেয়ে অসাধারণ অধ্যায় ফুটবল নিয়ে শহিদুলের জ্ঞান নয়- তার স্বপ্ন। নিজে কখনো ফুটবল খেলতে পারেনি শহিদুল। জীবন তাকে সেই সুযোগ দেয়নি। তাই এখন নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে চায় সন্তানের মাধ্যমে। রোদ-বৃষ্টি বা শীতের কুয়াশা যাই থাকুক না কেন, পুরোনো সাইকেলে করে তাকে ছুটতে হয়, ঢাকা শহর ঘুরে ঘুরে মানুষের বাড়ি বাড়ি সে পার্সেল পৌঁছে দেয়। দিনে দুই শিফটে কাজ করে। চোখ জ্বালাপোড়া করে, শরীর ক্লান্ত হয়ে যায়; কিন্তু মনোবল সবসময়ই থাকে অটুট। সাইকেল চালাতে চালাতে সে স্বপ্ন দেখে। মনের ভেতর কথাটা স্বপ্নটা সব সময় গুনগুন করে, ‘পিটার একদিন পারবেই।’

সামান্য আয় দিয়েই পিটারের জন্য খেলোয়াড়দের উপযোগী খাবার জোগাড় করে শহিদুল। একজোড়া ছোট্ট বুট কিনে দিয়েছে। একটা ছোট বল কিনে দিয়েছে। ছেলেকে প্রতিদিন পাড়ার এক কোণায় প্রাকটিস করাতে নিয়ে যায়। ছেলেকে শেখায় ব্যালান্স, ফুটওয়ার্ক ও ভিশন। এখন হয়তো ছেলেখেলা মনে হয়; কিন্তু শহিদুলের বিশ্বাস- এটি এক বিশাল যাত্রার শুরু।

শহিদুলের স্বপ্ন একদিন পিটারকে জার্মানি নিয়ে যাবে। বিশ্বমানের একাডেমিতে প্রশিক্ষণ দিবে। তাকে বুন্দেসলিগার কোনো ক্লাবে খেলতে দেখবে। এমন এক মুহূর্তের স্বপ্ন যেখানে ঘোষক চিৎকার করে বলে উঠবে, ‘পিটার! আবার পিটার- ওহ, কী গোল!’

এটা হয়তো এখন অসম্ভব শোনাচ্ছে। এমনকি বোকামিও মনে হতে পারে। ইউরোপ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের এক দরিদ্র মানুষ, এমন বিশাল স্বপ্ন দেখছে? কিন্তু ইতিহাস তো অনেক সময় সাহসীদের দিয়েই লেখা হয়েছে। যারা স্বপ্ন দেখে তারাই তো ইতিহাস রচনা করে। শহিদুল কেন পারবে না?

তবুও আমি মাঝে মাঝে চিন্তা করি। ভাগ্যের ওপর শহিদুলের তেমন আস্থা নাই। কখনো কখনো মনে হয় এই জগৎও তাকে করুণা করেনি। আমি তার ওপর আস্থা রাখছি। আমি বিশ্বাস করি তার আগুনে। সেই বিশ্বকাপ রাতের কান্না বিফলে যেতে পারে না। যে নির্জন সন্ধ্যাগুলোতে শহিদুল ছেলেকে প্রাকটিস করায় রাস্তার ম্লান আলোতে সেই সন্ধ্যাগুলো একদিন উজ্জ্বল আলো হয়ে ফুটে উঠবে। আমি নিজেও স্বপ্ন দেখি, একদিন তাকে দেখতে পাব জার্মানির কোনো উল্লুসিত স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে, যেখানে তার ছেলে রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তার স্বপ্নের তারকাদের মতোই প্রবল বিক্রমে।

যদি সেই দিন আসে, আমি থাকব আমার টিভির সামনে- চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে দেখব পিটার ছুটে যাচ্ছে বল নিয়ে। গর্বে আমার বুক ভরে যাবে। ঘোষকের কণ্ঠে শোনা যাবে: ‘পিটার ডন! জার্মানির গর্ব- বাংলাদেশে জন্ম, যে গড়ে উঠেছে পিতার গভীর ভালোবাসায়, আর জ্বলে উঠেছে অপরিসীম স্বপ্নে!

মাহমুদ জালাল: লেখক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ