সালতামামি ২০২৪
বছরজুড়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নানা দুর্ঘটনা
প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্ঘটনায় বিপর্যস্ত বাংলাদেশের জন্য ২০২৪ সাল ছিল চ্যালেঞ্জিং বছর। তীব্র তাপপ্রবাহ থেকে নজিরবিহীন শিলাবৃষ্টি, স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’, পাহাড়ধস ও বজ্রপাতের মতো নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং সড়ক, নৌ ও রেলপথে ক্রমবর্ধমান দুর্ঘটনায় অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ঘটে। দুর্যোগে দেশজুড়ে ফসল ও অবকাঠামোর মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। জলবায়ুর এই বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় সচেতনতা বাড়ানো, উন্নত পূর্বাভাস ব্যবস্থা এবং কার্যকর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
তীব্র তাপপ্রবাহে বিপর্যস্ত জনজীবন
বিদায়ী বছরে তীব্র গরমে দেশে একাধিকবার দুর্যোগ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। মৌসুমি বৃষ্টিপাত আগস্টে কিছুটা স্বস্তি এনে দিলেও বছরের অন্য সময়টাতে তীব্র তাপপ্রবাহে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকার জনজীবন চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ২১ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত ‘হিট অ্যালার্ট’ এবং দেশের সব স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে টাঙ্গাইল, যশোর, পাবনা, নীলফামারী, রাজশাহী সিরাজগঞ্জ ও চুয়াডাঙ্গাসহ কয়েকটি অঞ্চলে আরও একবার মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যায়, যা কোথাও কোথাও জুন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ২৩ জুন রাজশাহীতে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়।
জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে নতুন করে তাপপ্রবাহের কবলে পড়ে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬ জেলা এবং টাঙ্গাইল, সিলেট ও চুয়াডাঙ্গা। সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে সিলেটে বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৮ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। এ সময় ঢাকার তাপমাত্রাও ছিল ৩৭ ডিগ্রির ওপরে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, বছরের বিভিন্ন সময়ে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ এবং পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের অভাব জনজীবনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে।
সিলেটে নজিরবিহীন শিলাবৃষ্টি
মার্চের শেষ দিকে পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে তীব্র শিলাবৃষ্টি আঘাত হানে। ৩১ মার্চ সিলেটে নজিরবিহীন শিলাবৃষ্টিতে ঝরেপড়া কোনো কোনো বরফখণ্ডের ওজন ২০০ গ্রামেরও বেশি ছিল। বরফ ও শিলাখণ্ডের আঘাতে আহত হয়ে কয়েকজনকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়, ভেঙে যায় গাড়ি ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার উইন্ডশিল্ডও। ২০ এপ্রিল ভোলার লালমোহন এবং ২৯ এপ্রিল হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলায় কালবৈশাখী ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
ফেনী ও নোয়াখালীতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা
আগস্টের শেষ ১০ দিনে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে পূর্বাঞ্চলীয় ১১ জেলার ৭৩টি উপজেলা। কমপক্ষে ৫৯ জনের মৃত্যুসহ ফসল, গবাদিপশু ও অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি হয়। বন্যায় ফেনীতে ২৩ জন, কুমিল্লায় ১৪ জন, নোয়াখালীতে নয়জন, চট্টগ্রামে ছয়জন, কক্সবাজারে তিনজন এবং খাগড়াছড়ি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর ও মৌলভীবাজারে একজন করে মারা যান। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা অক্সফামের তথ্য মতে, এই দুর্যোগে ফেনী ও নোয়াখালী জেলার প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং ধ্বংস হয় ৪৮ শতাংশ বাড়িঘর।
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে নেমে আসা ঢল এবং টানা ভারি বর্ষণে সৃষ্ট এই এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে দেশের উত্তর-পূর্ব, দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্বাঞ্চলের আরও পাঁচ জেলার নিম্নাঞ্চল। বিশেষত ত্রিপুরার ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ আকস্মিকভাবে খুলে দেয়ায় ফেনীতে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়।
রেমালের আঘাতে লন্ডভন্ড উপকূল
২০২৪ সালে বঙ্গোপসাগর থেকে দুটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে। পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দরে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত ঘোষণার মাঝেই ২৬ মে দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূল অতিক্রম করে ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’। রেমালের তাণ্ডবে বিভিন্ন এলাকায় জলোচ্ছ্বাসসহ দক্ষিণাঞ্চলের ১৯টি জেলার ১১৯টি উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রাণ হারান ১৬ জন এবং নিখোঁজ বা আহত হন ২২ জন। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় ফসল, সম্পদ এবং অবকাঠামোরও।
পাহাড় ধসে প্রাণ ঝরে ১৫ জনের
বিদায়ী বছরে এখন পর্যন্ত কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলায় তিনটি পাহাড় ধসে নিহত হন ১৫ জন। জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুসারে, জুনের এসব ঘটনায় নিহতদের মধ্যে আটজন রোহিঙ্গা এবং একজন গর্ভবতী নারীও রয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পার্বত্য এলাকায় রাস্তা-ঘরবাড়ি করতে গিয়ে সৃষ্ট খাড়া পাহাড়ের পাশে আধুনিক প্রকৌশল ব্যবস্থায় দেয়াল গড়া এবং বেলেপাথরের নরম পাহাড়ে পানির জমাট ঠেকাতে সঠিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন।
বজ্রপাতে নিহত ২৯৭ জন, আহত ৭৩
জানুয়ারিতে বজ্রপাতে কোনো মৃত্যুর খবর পাওয়া না গেলেও পরের আট মাসে প্রাণ হারিয়েছেন ২৯৭ জন, আহত হয়েছেন ৭৩ জন। নিহতদের মধ্যে ২৪২ জন পুরুষ, ৫৫ জন নারী এবং ১১ জন শিশু। কৃষিকাজ করতে গিয়ে প্রাণ হারান ১৫২ জন কৃষক, যার মধ্যে গরু আনতে গিয়ে মারা যান ১৮ জন।
সংবাদ সম্মেলনে সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরাম (এসএসটিএফ) জানায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, জয়পুরহাট ও হবিগঞ্জে সবচেয়ে বেশি ১৩ জন করে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
বজ্রপাতে মৃত্যু কমাতে পাঁচটি দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। দাবিগুলো হলো: পাঠ্যপুস্তকে বজ্রপাত সচেতনতার অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করা, আধা ঘণ্টা আগেই সরকারি তথ্যের (গভ. ইনফো) মাধ্যমে বজ্রপাতের পূর্বাভাস জানানো, কৃষক ও জনসাধারণের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়াতে সভা, সেমিনার ও প্রশিক্ষণ, মাঠে মাঠে শেল্টার সেন্টার স্থাপন এবং আহতদের ফ্রি চিকিৎসা দেয়া।
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৫৫৯৮, আহত ৯৬০১
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে জানা গেছে, জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশজুড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৫ হাজার ৫৯৮ জন এবং আহত হয়েছেন ৯ হাজার ৬০১ জন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই নয় মাসে দেশে মোট ৫ হাজার ৪৮৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ৬৭৭ জন নারী এবং ৭২৯ জন শিশু।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানায়, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় এক হাজার ৯২৪ জন প্রাণ হারান, যা মোট নিহতের ৩৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এসব দুর্ঘটনার হার ৩৭ দশমিক ২১ শতাংশ। সড়ক দুর্ঘটনায় পথচারী নিহত হয়েছেন এক হাজার ১২১ জন, যা মোট নিহতের ২০ শতাংশ। এ ছাড়া যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৬৮৮ জন, যা মোট নিহতের ১২ দশমিক ২৯ শতাংশ।
প্রতিবেদন অনুসারে, নয় মাসে ৮৩টি নৌ-দুর্ঘটনায় ১২৪ জন নিহত এবং ১২৫ জন আহত হন। আর নিখোঁজ রয়েছেন ১৯ জন। পাশাপাশি ২৪৩টি রেল দুর্ঘটনায় ২২৭ জন নিহত এবং ২২৩ জন আহত হন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে