Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

অ্যারন বুশনেলের আত্মহনন ও আমাদের বিবেকের দায়

Zeauddin Ahmed

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

শনিবার, ২ মার্চ ২০২৪

য়াশিংটনে ইসরায়েলি দূতাবাসের সামনে গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহনন করেছেন মার্কিন বিমানবাহিনীর সদস্য অ্যারন বুশনেল। গাজায় ইসরায়েলের সশস্র বাহিনীর চলমান হত্যাযজ্ঞে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ পঁচিশ বছর বয়সী বুশনেল অকালে প্রাণ বিসর্জন দিলেন। শরীরে যখন আগুন জ্বলছিল তখন তিনি চিৎকার করছিলেন, ফ্রি ফিলিস্তিন, ফ্রি ফিলিস্তিন। আত্মহননের ভিডিওটি আমি দেখেছি শুধু একবার।

পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যতবারই ভিডিওটি নজরে এসেছে ততবারই এড়িয়ে গেছি। না বুঝে প্রথমবার দেখেছি। বিমানবাহিনীর পোশাক পরা এক লোক ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছেন, কিছুদূর গিয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজের গায়ে পেট্রোল ঢাললেন, তারপর আগুন ধরিয়ে দিলেন। ফিলিস্তিন ফিলিস্তন বলে চিৎকার করতে করতে তরতাজা প্রাণটি ঝরে গেল। এই দৃশ্য কোনো সুস্থ্ মানুষের পক্ষে দুবার দেখা সম্ভব না। ইসরায়েলের হুমকিতে উত্তর গাজা থেকে সরে যেতে যেতে গাজার প্রায় অর্ধেক মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে মিশরের সীমান্তবর্তী রাফাহ শহরে। ওখানেও বোমা ফেলা হচ্ছে।

যুদ্ধের মধ্যে গাজায় পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। গাজার প্রায় সব হাসপাতাল গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইসরায়েল। আহতদের চিকিৎসার জন্য বিছানা নেই, ওষুধ নেই, অপারেশন-থিয়েটার নেই, অস্ত্রোপচারের সরঞ্জাম নেই। গাজায় আক্রমণের শুরুতেই ইসরায়েল বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। খাবারের অভাবে অপুষ্টিতে ভুগছে গাজাবাসী। আমেরিকার নির্দেশে কাতার আর মিশর যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য বৈঠকের পর বৈঠক করে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলো আমেরিকার রাজনৈতিক দাবার গুটি। আমেরিকা যেভাবে চাল দিচ্ছে সেভাবে নড়াচড়া করছে।

মুসলিম খেলাফতের নব্য-সুলতান তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বোবা হয়ে গেছেন। মিসকিন হলেও বাংলাদেশের মুসলমানরা অতিরিক্ত উষ্মা ভক্ত। তাদের মুখেও এখন আর জিহাদের স্লোগান শোনা যায় না। মিশর আর কাতারের দুতিয়ালি না থাকলেও যুদ্ধ যখন থামার তখন থামবে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী যেদিন বলবেন, ‘যুদ্ধ বন্ধ’, শুধু সেদিনই যুদ্ধ থামবে। ইতোমধ্যে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী রোজার আগে যুদ্ধ থামানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন। ৩০ হাজার গাজাবাসীর মৃত্যু মুসলিম দেশগুলোকে বিচলিত করেনি, বিচলিত করেছে শুধু একজন আমেরিকার বিমানবাহিনীর সদস্যকে।

সারা পৃথিবীতে মানুষ অহরহ আত্মহত্যা করছে। প্রতি বছর প্রায় দশ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। তীব্র হতাশা, অবহেলা, প্রেমে ব্যর্থতা, নেশায় আসক্তি, বেকারত্ব, দারিদ্র্য, গৃহহীনতা ইত্যাদি কারণে চরম মানসিক বিপর্যয়ে মানুষ আত্মহত্যা করে। এ ছাড়াও ধর্ষণের লজ্জা থেকে মুক্তি পেতেও অনেকে আত্মহত্যা করে। নিরাময় অযোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত আমার এক নানি শারীরিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ফাঁস দিয়েছিলেন। পরাজয়ের গ্লানি থেকে মুক্তি পেতে হিটলার আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ডেপুটি গভর্নরের পদাবনতি হলে তিনি মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন।

পরীক্ষায় ফেল করার পর পরিবারের সদস্যদের ভর্ৎসনা সহ্য করতে না পেরে অনেক ছাত্রছাত্রী আত্মহত্যা করে। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে ধরা পড়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে ভারতবর্ষের অনেক বিপ্লবী আত্মহত্যা করেছেন। নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে কিছু কয়েদি বিদ্যুতায়িত বেড়া স্পর্শ করে নিজেদের হত্যা করেছে। মনোমালিন্যের চরম পর্যায়ে স্বামীর শারীরিক আঘাতের পর ফাঁসি দেওয়া এক নারীকে গাছের ডালে ঝুলতে দেখেছি বাল্যকালে। লসের মাত্রা বেশি হলে জুয়াড়িরাও আত্মহত্যা করে। শেয়ারে বিপুল অর্থ খুইয়ে জাপানের এক ব্যবসায়ী হারিকিরি করে আত্মাহত্যা করেছিল; কিন্তু এ সব আত্মহত্যার তুলনায় অ্যারন বুশনেলের আত্মহত্যার ওজন ও মহিমা অনেক বেশি।

অন্যের জীবনহানি ঘটানোর উদ্দেশ্যে আজকাল রাজনৈতিক কারণে অনেকে আত্মঘাতী বোমা ফাটিয়ে নিজেকে নিজে মেরে ফেলছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী এক আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে মারা যান। পাকিস্তানে প্রায় প্রতিদিন আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণে অসংখ্য লোক মারা যায়। নাইজেরিয়ার জিহাদি জঙ্গি সংগঠন বোকো হারামের কিশোর-কিশোরীরাও আত্মঘাতী হয়ে থাকে। ২০০১ সনে আমেরিকার টুইন টাওয়ারে যারা বিমান হামলা করেছিল, তারাও ছিল আত্মঘাতী। খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে রোমান দার্শনিক ও নাট্যকার সেনেকা এবং প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। নোবেলজয়ী সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তার ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ উপন্যাসে জীবনযুদ্ধে হার না মানার প্রত্যয় তুলে ধরলেও তিনি আত্মহত্যা করতে হয়েছিল। উল্লিখিত আত্মহত্যাগুলোর সঙ্গেও অ্যারন বুশনেলের আত্মহত্যার কোনো মিল নেই।

অ্যারনের আত্মহত্যা মানবতার জয়গানে উদ্ভাসিত। ইউরোপসহ পৃথিবীর অধিকাংশ উন্নত দেশে আত্মহত্যা বা আত্মহত্যার চেষ্টা এখন আর অপরাধ বলে মনে করা হয় না। এর প্রধান কারণ ব্যক্তিজীবনে ধর্মের প্রভাব কমে যাওয়া। সৃষ্টিকর্তা জীবন দিয়েছেন, তাই সৃষ্টিকর্তাই জীবন নেবেন- এই তত্ত্বে বিশ্বাসী লোকেরা সচরাচর আত্মহত্যা করে না। কারণ প্রায় সব ধর্মেই আত্মহত্যা মহাপাপ। ইসলাম ধর্মমতে আত্মহত্যাকারী জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। অধিকাংশ মুসলিম দেশে আত্মহত্যার চেষ্টা করে কেউ বেঁচে গেলে তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। এতদসত্ত্বেও আমরা কিছু আত্মহত্যার যৌক্তিক কারণ খুঁজি, আত্মঘাতীর প্রতি সহানুভূতি দেখাই।

অ্যারনের আত্মহত্যাকে মহিমান্বিত করে তোলার জন্য শত শত আমেরিকান ফিলিস্তিনি তার উদ্দেশ্যে তার মৃত্যুবেদিতে ফুল দিচ্ছে, মিছিল করে তার জয়গান করছে। অ্যারন কার জন্য আত্মাহুতি দিলেন? তিনি তো ফিলিস্তিনি বা মুসলমান নন, ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কও নেই। তিনি আসলে খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী। তিনি আমেরিকার নাগরিক। তিনি মার্কিনবিমান বাহিনীর একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। মাত্র তিন বছর আগে চাকরিজীবন শুরু করেছেন। তিনি বয়সে তরুণ। বিয়ে করেছেন কি না, জানি না। স্ত্রী বা সন্তান না থাকলেও মা-বাবা তো আছেন। মৃত্যুর আগে কি একবারও তাদের কথা মনে পড়েনি?

পড়েনি হয়তো। পড়লে তিনি অন্যের জন্য আত্মাহুতি দিতে পারতেন না। তিনি তখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। ইসরায়েলের গণহত্যায় তার দেশ অন্ধ সমর্থন ও সহায়তা দিচ্ছে দেখে তিনি বাচার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। মানুষের নির্মম বর্বরতা তিনি মেনে নিতে পারেননি। তাই অ্যারন তার জীবন দিয়ে বিশ্ববিবেককে জাগ্রত করতে চেয়েছিলেন। তিনি ধার্মিক হলে এই কাজ করতেন না। তিনি রাজনীতির লোক হলেও এই কাজ করার গরজ বোধ করতেন না। তবে তিনি হয়তো অবগত ছিলেন না যে, এই গণহত্যার পেছনে শুধু আমেরিকা ইন্ধন জোগাচ্ছে না। ইন্ধন জোগাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোও। রাজা-বাদশাহ আর সেনা শাসকদের ভয় ইসরায়েলের নয়, তাদের ভয় ইরান এবং হামাস।

তাই হামাসের ডানা ভাঙতে আমেরিকার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোও একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। হলিউড অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্নের মতো দেখতে ফিলিস্তিনি তরুণী লায়লা খালেদ, ১৯৬৯ সালে রোম থেকে এথেন্সগামী একটি ইসরায়েলি বিমান ছিনতাই করে তিনি বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলেছিলেন। বিমান ছিনতাইয়ের সময় একে-৪৭ রাইফেল হাতে তার যে ছবি তোলা হয় সেই ছবিটিই সারা দুনিয়ায় বিপ্লবের প্রতীক হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। পুনরায় বিমান ছিনতাই করার অভিপ্রায়ে গণমাধ্যমে পরিচিত চেহারায় ছয়বার প্লাস্টিক সার্জারি করান। পরিবর্তিত চেহারার লায়লা হাসান ১৯৭০ সালে আমস্টারডাম থেকে নিউইয়র্কগামী আরেকটি বিমান ছিনতাই করে ধরা পড়েন, পরে বন্দি-বিনিময়ের চুক্তিতে মুক্তি পান।

আইনের চোখে তার বিমান ছিনতাইয়ের কাজ অপরাধ পদবাচ্য হলেও নিপীড়িত ও মানবতায় বিশ্বাসী মানুষের কাছে তা গর্হিত বিবেচিত হয়নি। কোনো জীবনহানি করা তার লক্ষ্য ছিল না, বিমান ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্য ছিল অসহায় ফিলিস্তিনিদের প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা। অ্যারন বুশনেলও একই কাজ করেছেন, ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার লক্ষ্যে নিজের গায়ে আগুন লাগিয়েছেন। আমেরিকার মদদে ইসরায়েল পোকামাকড়ের মতো ফিলিস্তিনির মানুষ মারছে। যুদ্ধ বন্ধের সব প্রচেষ্টায় বাধা দিয়েছে আমেরিকা। যুদ্ধ বন্ধে নিরাপত্তা পরিষদের উত্থাপিত প্রস্তাবে আমেরিকা বারবার ভেটো দিয়েছে।

গাজায় চলমান গণহত্যার জন্য অ্যারন তাই আমেরিকাকে দায়ী করেছেন। তিনি পরকালের বেহেস্তের জন্য লালায়িত ছিলেন না। নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে কবি সুকান্তের মতো পৃথিবীকে মানুষের জন্য বাসযোগ্য করার স্লোগান জানিয়ে গেছেন। লায়লা খালেদকে এক সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘আপনি যা করেছেন তার জন্য আপনি কি অনুতপ্ত’? লায়লা খালেদের উত্তর ছিল, ‘মোটেই না’। তদ্রূপ নিজের শরীরে আগুন লাগানোর পূ্র্বে অ্যারনও চিৎকার করে বিশ্ববাসীকে শুনিয়ে দিয়ে গেছেন, দখলদারদের হাতে ফিলিস্তিনিরা যেভাবে মরছে তার তুলনায় তার আত্মাহুতি কিছুই না।

লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, টাকশাল।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ