চাপে থাকা আবাহনীই সেরাটা দেয়!
অতীতের সেই আবেদন নেই- আবাহনী-মোহামেডান এখন ঐতিহ্যের কঙ্কাল! এ অবস্থার মাঝেও কিছু সমর্থক আছেন এখনো জনপ্রিয় দুটি ক্লাবকে অনুসরণ করেন, নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখেন। আজিমপুরের বাসিন্দা মাজেদ হোসেন টুটুল তেমনই একজন। শত ব্যস্ততার মাঝে আবাহনীর খবর রাখেন। সময়-সুযোগ পেলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে ওঠেন, ফিরে যান ফুটবলের সেই সমৃদ্ধ অতীতে। ধানমন্ডির ক্লাবটির এমন কট্টর সমর্থকরা গেল কয়েক মৌসুম বেশ চাপে ছিলেন। বুসন্ধরা কিংসের দাপটে মাঠের লড়াইয়ে প্রিয় ক্লাব বিবর্ণ হয়ে যাওয়ার চাপ ওটা।
চলতি মৌসুমে আবাহনীর মাঠের নৈপুণ্যে সমর্থকদের চাঙা করেছে। আবাহনীর জন্য সময় প্রতিকূল। স্রোতের বিপরীতে আকাশি-হলুদরা না কি এমন উজ্জীবিতই থাকে! ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে ক্লাব ট্যান্টে হামলা ও লুটপাট হয়েছে, হারিয়ে গেছে আবাহনী লিমিটেডের অনেক স্মৃতিচিহ্ন। ক্লাবের অধিকাংশ ডোনার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। রাষ্ট্রক্ষমতায় পটপরিবর্তনের পর যাদের অধিকাংশই স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। যে কারণে মাঠের বাইরের আবাহনী বিগত দিনগুলোর তুলনায় নড়বড়ে। সেটা অবশ্য মাঠের খেলায় বোঝা যাচ্ছে না। বরং বিগত কয়েক মৌসুমের তুলনায় বেশ উজ্জ্বল ক্লাবটি, বেশ চাঙা হয়েছেন আবাহনীর সমর্থকরাও।
‘আবাহনী লিমিটেড: দ্য স্কাই ব্লু ব্রিগেড’- ফেজবুক পেজে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ তৎপর সমর্থকরা। এমন তৎপরতা বাইরের সীমিত সাধ্যর সর্বোচ্চ প্রয়োগ মাঠে ঘটানোর কারণে। প্রাপ্তিকে মানদণ্ড ধরলে চলতি মৌসুমে আবাহনীর অর্জন এখনো শূন্য। কিন্তু মাঠের খেলা এবং নানা পরিসংখ্যানকে মানদণ্ড হিসেবে দাঁড় করালে ক্লাবটি যা করেছে তা ঈর্ষণীয়! এ কারণে মৌসুমের শুরুতে যে শঙ্কা-সংশয় ছিল, সেটা এখন নেই।
তথ্যটা হয়তো সবারই জানা যে, চলতি মৌসুমে আবাহনী খেলছে স্থানীয় ফুটবলারদের নিয়ে। তারপরও ক্লাবটির পরিসংখ্যান কিন্তু বিস্ময়কর- ১৩ ম্যাচে মাত্র একটি হেরেছে আবাহনী। এখনো পর্যন্ত খেলা ১৩ ম্যাচের প্রতিপক্ষ দলগুলো কিন্তু বিদেশি ফুটবলার সমৃদ্ধ। বিদেশিদের বিপক্ষে অধিকাংশই থাকেন আক্রমণভাগের খেলোয়াড়। যাদের বিরুদ্ধে আবাহনীর রক্ষণের পরিসংখ্যানও কিন্তু চোখ কপালে তোলার মতো- ১৩ ম্যাচে মাত্র ১ গোল হজম করেছে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় এ ক্লাবটি।
প্রিমিয়ার লিগের প্রথম পর্ব শেষ হয়েছে, ফিরতি লেগ শুরু হওয়ার কথা ২১ ফেব্রুয়ারি। ফেডারেশন কাপের গ্রুপ পর্ব শেষ হয়েছে। চলমান দুই আসরে এখনো পর্যন্ত খেলা ১৩ ম্যাচের মধ্যে আবাহনী একমাত্র গোল হজম করেছে ১৪ নভেম্বর, মোহামেডানের বিপক্ষে। প্রিমিয়ার লিগে ১-০ গোলে হারের বদলা অবশ্য ফেডারেশন কাপেই নিয়েছে ক্লাবটি- মোহামেডানকে হারিয়েছে একই ব্যবধানে।
মোহামেডানের কাছে ওই হারের পর খেলা ৯ ম্যাচের সবগুলো ক্লিনশিট রেখেছে আকাশি-হলুদরা- ৮১০ মিনিট কোনো গোল হজম করেনি। এ পরিসংখ্যানে কৃতিত্বটা আবাহনী গোলরক্ষক মিতুল মারমার এবং রক্ষণভাগের। জাতীয় দলের এক নম্বর কাস্টডিয়ান মিতুল মারমা লিগে ৪৩৬ মিনিট গোলপোস্ট অক্ষত রেখেছেন। ফেডারেশন কাপে চার ম্যাচের তিনটি খেলেছেন, সবগুলোই ক্লিনশিট। দুই আসরে ৭০৬ মিনিট কোনো গোল হজম করেননি এ গোলরক্ষক।
এ পরিসংখ্যানের কৃতিত্বটা গোটা দলকেই দিচ্ছেন মিতুল মারমা, ‘ফুটবল দলগত খেলা, আমরা দলগতভাবে চেষ্টা করছি। আমাদের রক্ষণভাগ তো বটেই, গোটা দলই সহায়তা করেছে। এ কারণেই মৌসুমে এখন পর্যন্ত এক গোল হজম করেছে আবাহনী। দলের প্রতিটি সদস্য কঠোর পরিশ্রম করছেন। দৃঢ় সংকল্প নিয়ে কাজ করলে অনেক সীমাবদ্ধতা ঢেকে দেয়া যায়। আমরা সে চেষ্টাই করে যাচ্ছি।’
প্রিমিয়ার লিগে ৯ ম্যাচে ২৪ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে আছে মোহামেডান। ৯ ম্যাচের একটি হেরেছে সাদা-কালো জার্সিধারীরা। আবাহনী ৯ ম্যাচের একটি হারলেও ড্র করেছে আরও দুই ম্যাচ। ২০ পয়েন্ট নিয়ে লিগ টেবিলের দ্বিতীয় স্থানে আছে ধানমন্ডির ক্লাবটি। টানা পাঁচ লিগ শিরোপাজয়ী বসুন্ধরা কিংস ১৭ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় স্থানে আছে। ফেডারেশন কাপে ‘বি’ গ্রুপে ৪ ম্যাচের সবগুলো জিতেছে আবাহনী। কোনো ম্যাচে গোল হজম না করেই শতভাগ জয় এসেছে!
আবাহনীর দারুণ যাত্রায় ইয়াসিন খানের পুনর্জন্ম দেখছেন সমর্থকরা। ৩০ বছর বয়সী সেন্টার ব্যাক লিগে ৯ ম্যাচের সবগুলোই আগাগোরা খেলেছেন। লিগের পরিসংখ্যান তো আগেই দেয়া হয়েছে- প্রথম পর্বের ৯ ম্যাচে মাত্র ১ গোল হজম করেছে আবাহনী। যার কৃতিত্ব গোটা রক্ষণভাগ এবং গোলরক্ষকের। রক্ষণে আবাহনীর আস্থার প্রতীক হয়ে আছেন ইয়াসিন খান। ঘরোয়া আসরে যেভাবে খেলছেন, তাতে এ সেন্টার ব্যাক জাতীয় দলে ফিরবেন- এমন বিশ্বাস জন্মাচ্ছে সমর্থকদের মনে।
আবাহনীর হয়ে মৌসুমটা দারুণ উপভোগ করছেন ইয়াসিন খান নিজেও। জাতীয় দলের সুযোগ এলে তা লুফে নিতে নিজেকে প্রস্তুত রেখেছেন। এ প্রসঙ্গে ইয়াসিন খান বলছিলেন, ‘মারুফুল হক স্যার দারুণ মোটিভেটর। তিনি আমাদের সবাইকে উজ্জীবিত করেছেন যে, তোমরা বিদেশি ফুটবলারদের চেয়ে কম কিসে? টিম অফিসিয়ালরাও ক্রমাগত আমাদের উজ্জীবিত করে যাচ্ছেন। গোটা দল একটা ইউনিট হিসেবে খেলছে। যা আমরা উপভোগ করছি। জাতীয় দলের কোচ যদি আমাকে যোগ্য মনে করেন, আমি হয়তো আবার লাল-সবুজ জার্সি পরব। এ জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখছি।’
স্থানীয় ফুটবলারদের নিয়ে মাঠে দারুণ ধারাবাহিকতা দেখাচ্ছে আবাহনী, সমর্থকরা তাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আবেগ নিংড়ে দিচ্ছেন উজ্জীবিত সমর্থকরা। ক্লাবটির সমর্থকদের ফেজবুক পেজ ‘আবাহনী লিমিটেড: দ্য স্কাই ব্লু ব্রিগেড’-এ কেএইচ এমডি বদিউল আলম লিখেছেন, ‘পরিশ্রম, শৃঙ্খলা এবং জয়ের আকাঙ্ক্ষা কখনো বৃথা যায় না। আবাহনী এবং মারুফুল হক আবারও এই সত্য প্রমাণ করেছেন। এগিয়ে যাও আবাহনী। দ্বিতীয় লেগে আরও ভালো পারফরম্যান্স আশা করছি।’ স্থানীয় ফুটবলার নিয়ে দারুণ নৈপুণ্য দেখিয়ে যাওয়া আবাহনী বিদেশি ফুটবলার নিয়েও ভাবছে।
সে ভাবনার কথা জানিয়ে কেএইচ এমডি বদিউল আলম আরেক পোস্টে লিখেছেন, ‘হয়তো বিদেশি আসবে, বা আসবে না টাকার জন্য। যদি আসে ভালো; কিন্তু আমরা চাই ছন্দে থাকা আবাহনী খেলে যাক একই ছন্দে, রেজাল্ট যাই হোক। ভালো খেলে হারলেও আমরা অখুশি না। জয়-পরাজয় খেলারই অংশ।’ এমডি বায়োজিদ মোস্তফা লিখেছেন, ‘আবাহনীর প্রতিটি হার কিংবা ড্রয়ে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। জানি না কেন এমন লাগে।’ মো. মানিক নামের আরেক সমর্থক লিখেছেন, ‘যারা ১৯৯৪ সালের লিগে আবাহনীর খেলা দেখেননি, তারা এবারের আবাহনীর খেলা দেখলে বুঝবেন এই টিম সেই টিম, একটি জেদি টিম।’
হিরো মোসলেহ উদ্দিনের পোস্টে আবাহনীকে নিয়ে আবেগ, স্থানীয় খেলোয়াড় ইস্যুতে গর্ব ছিল, ‘টিম আবাহনীকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। এগিয়ে যাও। আবাহনীকে দেখে শিখুন- দেশীয় প্লেয়ারদের নিয়ে গড়া টিম আবাহনী। সঙ্গে আছে প্রতিশ্রুতি এবং আত্মবিশ্বাস। আবাহনী-১ : রহমতগঞ্জ-০।’ মোহামেডানকে হারানোর অনুভূতি উঠে এসেছিল ফেজবুক পেজের এডমিন পোস্টে, ‘মোহামেডানকে হারানো সবসময়ই আনন্দের। এবার তো একটু বেশিই। জয় আবাহনী।’
আবাহনী এবং জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক মোনেম মুন্নার সেতুর নামফলকে পোস্টার লাগানোর প্রসঙ্গ উঠে এলো গ্রুপের এডমিন পোস্টে, ‘ধানমন্ডি ৮ নম্বর ব্রিজটা মোনেম মুন্নার সম্মানে নামকরণ হয়েছিল। সেই সাইনবোর্ড পোস্টার দিয়ে ঢেকে রেখেছিল। তাই নিজ দায়িত্বে আমি আর আমার কলিগরা মিলে সব পোস্টার তুলে পরিষ্কার করে দিলাম।’ এজে রাসেল নামের আরেকজন লিখেছেন, ‘লিগ শুরুর সময়ে এই অবস্থায় থাকবে আবাহনী- আমরা ভাবিনি। পুরো দেশি স্কোয়াড নিয়ে দুর্দান্ত খেলে গেছে আকাশি-নীলরা। নয় ম্যাচের মাঝে আটটাতেই ক্লিনশিট। গোল হজম মাত্র একটা ম্যাচে।’
সামাজিক মাধ্যমে আবাহনীর একাধিক প্ল্যাটফর্মকে একীভূত করা এবং দলকে সহায়তার জন্য প্রয়োজনে তহবিল গঠনের প্রস্তাব দিলেন ফেরদৌস ইকবাল শাপলা নামের এক সমর্থক, ‘আবাহনীর অনলাইন সাপোর্টার্স দুটি গ্রুপকে একটা প্ল্যাটফর্মে, এক নামে পরিচালনা করাসহ মধ্যবর্তী দল পরিবর্তনে বিদেশি খেলোয়াড় আনার ব্যাপারে একটা ফান্ড তৈরি করা যায় কিনা? এ ব্যাপারে দুই গ্রুপের এডমিনের দৃষ্টি আকর্ষণসহ সবার মতামত আশা করছি।’
সাম্প্রতিক সময়ে বসুন্ধরা কিংস উজ্জ্বল নৈপুণ্য দেখালেও অর্জনের মানদণ্ডে আবাহনী কিন্তু এখনো এগিয়ে। বাংলাদেশের ফুটবল পেশাদারি মোড়কে আচ্ছাদিত হওয়ার পর প্রিমিয়ার লিগে সর্বোচ্চ ৬ বারের চ্যাম্পিয়ন আবাহনী। যদিও ক্লাবটি নিকট অতীত বিবর্ণ। ২০১৭-১৮ মৌসুমের পর প্রিমিয়ার লিগের শিরোপার নাগাল পাওয়া হয়নি। আবাহনী সর্বশেষ ফেডারেশন কাপ শিরোপা জিতেছে ২০২১-২২ মৌসুমে। ট্রফি কেবিনেটে ওটাই ছিল সর্বশেষ সাফল্যের স্মারক।
সেই আবাহনী চলতি মৌসুমে আদৌ ব্যর্থতা ঝেড়ে ফেলতে পারবে কি না- উত্তরটা সময়ই দেবে। এখন পর্যন্ত আবাহনীর অভিযান সমর্থকদের আশাবাদী করে তুলেছে। প্রিমিয়ার লিগ এবং ফেডারেশন কাপ- দুই আসরেই শিরোপা রেসে আছে মারুফুল হকের স্কাই-ব্লু ব্রিগেড।
মাহবুব সরকার: ক্রীড়া সাংবাদিক ও ক্রীড়া বিশ্লেষক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে