সিজারিয়ান পদ্ধতিতে সন্তান জন্মদানের ব্যয় কমাতে দ্রুত পদক্ষেপ নিন
সিজারিয়ান ডেলিভারি নামে বাংলাদেশে বিশেষ করে ঢাকা শহরের হাসপাতালগুলোতে কী হয়, তা কারও জানার বাকি নেই। এগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনা নিয়ে এরই মধ্যে বহু প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
গত শনিবার (৩০ ডিসেম্বর) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ঢাকায় সন্তান জন্মে উচ্চ ব্যয়, ঋণগ্রস্ত বাবা-মা। অস্ত্রোপচারে সন্তান জন্ম হলে ঋণ করতে হয় নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোকে। শহর এলাকায় অস্ত্রোপচারে জন্ম হচ্ছে প্রায় ৬০ শতাংশ শিশু।
খবরে প্রকাশ, খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণ অস্ত্রোপচার। যা সি সেকশন, অর্থাৎ সিজারিয়ান ডেলিভারি নামে পরিচিত। জটিলতার ভয়ে অনেক পরিবার অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেয়। চিকিৎসকগণ অনেক সময় অকারণে সেই ভয় দেখান। প্রথম হাসপাতাল থেকে বলা হয়, অস্ত্রোপচারের প্যাকেজ ১৩ হাজার টাকা থেকে ১৫-২০ হাজার টাকা। পরে দেখা যায় ওষুধপত্রসহ নানা বিল মিলে তা ৩০-৪০ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়। নিম্নআয়ের অনেক পরিবারের কাছেই এত টাকা থাকে না। ফলে তাদের ঋণ করতে হয়।
অস্ত্রোপচারের কারণে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের সন্তান জন্মের ব্যয়ই বাড়ছে। অবস্থাভেদে এ খরচ কয়েক হাজার থেকে লাফিয়ে ওঠে কয়েক লাখেও। স্বাভাবিক প্রসবে খরচ থাকলেও তা অনেক কম। তবু অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার ও খরচ দুটিই বাড়ছে। অতিরিক্ত খরচ হলেও অস্ত্রোপচারে শিশু জন্মের হার কমছে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের (এসভিআরএস-২০২৩) তথ্য অনুযায়ী, দেশের শহর এলাকায় অস্ত্রোপচারে প্রায় ৬০ শতাংশ শিশুর জন্ম হচ্ছে।
২০২১ সালের চেয়ে এ হার ৬ শতাংশ পয়েন্ট বেশি। সর্বশেষ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ প্রতিবেদন ২০২২-এ বলা হয়েছে, গত এক যুগে দেশে অস্ত্রোপচারে শিশু জন্মের হার বেড়েছে ২৭ শতাংশ। অস্ত্রোপচারের সংখ্যা কেন বাড়ছে, তা নিয়েও অনেক গবেষণা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রসূতির কিছু জটিলতা থাকে সত্য, তা ছাড়া ভয়ও থাকে; কিন্তু তার চেয়ে বেশি দেখা যায় ডাক্তারাই অযথা ভয় ধরিয়ে দেন, প্রয়োজন না হলেও অস্ত্রোপচারের কথা বলেন।
এসব নিয়ে অনেক গবেষণা-প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, সামাজিকভাবে অনেক সমালোচনা হলেও কোনো আইনগত প্রতিকার নেয়া হয়নি এবং অহেতুক অস্ত্রোপচারের হারও কমেনি। ঢাকার আশপাশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা হাসপাতালগুলো দেখা যায় প্রসূতি নারীদের জন্য মুখিয়েই থাকে। তাদের আয়ের একটা বেশির ভাগ অংশই আসে এ ধরনের অপ্রয়োজনীয় সিজার থেকে। এ হাসপাতালগুলোর আশপাশেই গড়ে ওঠে অনেক ফার্মেসি। তাদেরও ওষুধের ব্যবসা রমরমা। তাদের হাত থেকে রেহাই পায় না বস্তি এলাকার নারীরাও। কারণ সন্তান জন্মদানে সবাই চায় নিরাপদ ও যত্নশীল থাকতে।
অস্ত্রোপচার মা ও শিশুর নিরাপত্তা অনেকটা নিশ্চিত করে সত্য, বিশেষ করে জটিলতায় আক্রান্ত হলে অস্ত্রোপচারই কাম্য; কিন্তু অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার কোনোভাবেই কাম্য নয়। এতে করে মা ও শিশুর ভবিষ্যৎ জীবনের ওপর নেতিবাচক প্রভাবই পড়ে। দ্বিতীয়ত, অস্ত্রোপচার বাড়ার কারণ শুধু অসচেতনতা নয়, শহর অঞ্চলের মানুষের অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, ১০-১৫ শতাংশ প্রসবে অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হয়। অথচ শহরে এর অন্তত চারগুণ বেশি হচ্ছে।
স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ও সচেতনতা থেকেই স্বাভাবিক সন্তান জন্মদান সম্ভব। তাতে মা ও শিশু যেমন নিরাপদ থাকবে, বাবা-মাও ঋণের হাত থেকে বাঁচবে। এ বিষয়ে প্রতিটি পরিবারের যেমন সচেতনতা দরকার, তেমনি রাষ্ট্রেরও আরও সচেতন হওয়া দরকার। মা ও শিশুর নিরাপত্তা দানের মধ্য দিয়ে, চিকিৎসা ব্যয় কমিয়ে, চিকিৎসাগত বিশৃঙ্খলা দূর করে বাবা-মাকে ঋণমুক্তি রাখার ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে