বান্দরবানের পাহাড়ে সুপেয় পানির তীব্র সংকট
বান্দরবানের পাহাড়ি গ্রামগুলোতে তীব্র সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। বনাঞ্চল উজাড়, পাথর উত্তোলন ও অপরিকল্পিত জুম চাষের কারণে পাহাড়ে সুপেয় পানির উৎসগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে বলে ধারণা করছেন পরিবেশবিদরা। এর ফলে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের। এতে দূর-দূরান্ত থেকে এক কলসি পানি আনতে তাদের সময় লাগছে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। আবার বাধ্য হয়ে পাহাড়ি অনেক পরিবার কিনে খাচ্ছে সুপেয় পানি এবং কেনা পানিতে সংসারের অন্যান্য কাজকর্ম সারছেন। এ পরিস্থিতিতে ঝিরি-ঝরনার পানি স্থানীয়ভাবে ২-৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বান্দরবান সদর ও থানচি উপজেলার মধ্যে কোরাং পাড়া, ক্রাপুং পাড়া, সিতা পাড়া, বাগান পাড়া, ম্রলং পাড়া, গেতসিমনি পাড়া, বসন্তপাড়াসহ মোট ৩৫টির অধিক পাহাড়ি গ্রাম বা পাড়া আছে। এসব গ্রাম বা পাড়ায় প্রায় পাঁচ শতাধিক বিভিন্ন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বসবাস।
এদিকে গেতসিমনি পাড়ায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, পাহাড় থেকে অনেক নিচে ঝিরির শেষ প্রান্তে একটি গর্ত রয়েছে। সেই গর্তে অল্প অল্প করে পড়া পানি পাড়ার মোট ৭৫টি পরিবার সংগ্রহ করছে।
পাহাড়ে বসবাসরত বাসিন্দারা জানায়, তাদের গ্রাম বা পাড়াগুলো পাহাড়ের চূড়ায় হওয়ায় পাড়া থেকে প্রায় ৮০০/১৫০০ ফুট নিচে নামলে ছোট ঝিরি বা ঝরনার দেখা মেলে। ঝিরিগুলোতে এখন পানি নেই বললেই চলে। তবুও পানির উৎসগুলোর ওপর ভরসা করে জীবন কাটছে তাদের। পাহাড়গুলোয় আগের মতো বড় বড় গাছ ও পর্যাপ্ত পরিমাণে পাথর না থাকায় শুষ্ক মৌসুমে ছোট ছোট ঝিরি-ঝরনাগুলো ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে।
বান্দরবানের পাহাড়ে সুপেয় পানির তীব্র সংকট
চিম্বুক এলাকার ব্যবসায়ী রেং রোয়াং ম্রো বলেন, ‘বান্দরবান-থানচি সড়কের আশেপাশের ছোট ছোট বাজারগুলোতে যাদের দোকান রয়েছে, তারা সকলেই কেনা পানি ব্যবহার করছেন। কিন্তু পাড়াতে বসবাসকারীদের পক্ষে এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘তীব্র তাপদাহে পাহাড়ে মানুষের জীবনযাপন অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তীব্র পানির সংকট পাহাড়িদের জীবনযাপনকে আরও দুর্বিসহ করে তোলেছে।’
লম্বাইতং পাড়ার দোকানদার রিয়োং ম্রো বলেন, স্থানীয় কয়েকজন যুবক জীপগাড়ীতে করে দূর-দূরান্ত থেকে পানি সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। তাদের কাছ থেকে এক হাজার ও দেড় হাজার লিটার ড্রামের পানি হাজার ও দেড় হাজার টাকায় কিনতে হয় দোকানদের। এতে সড়কের দুপাশে গড়ে উঠা ছোটছোট টং দোকানগুলোর ব্যবহারের পানির চাহিদা পূরণ হয়। পানি কিনে ব্যবহারের কারণে খরচ বেড়ে গেলেও তাদের বিকল্প কোনো উপায়ও নেই বলেন তিনি।
পাড়াবাসী লিং কিয়াম ও চিংহ্লাও বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুমে পাহাড়ে সুপেয় পানির সংকট তীব্র হয়ে উঠে। এ সময় পাহাড়িদের জন্য খাবারের চাইতে সুপেয় পানির সংকট চরমে পৌঁছায়। পাড়ার নারীরা প্রতিদিন পাড়া থেকে প্রায় ৮০০/১৫০০ ফুট নিচে নেমে খাবার পানি এবং রান্না ও সংসারের কাজে ব্যবহৃত পানি সংগ্রহ করে। দুই-চার দিনে একবারই সংগ্রহ করা পানি দিয়ে কোনোরকমে গোসল করা যায়।’
স্থানীয় যুবক লুলাইং ও সানথিয়াম বলেন, শুস্ক মৌসুমে পাহাড়ি গ্রামগুলোতে পানির সংকট দেখা দেয়। সংকট নিরসনে মিশ্র ফলের বাগানে কাজের ফাঁকে তারা একটি জীপ গাড়ি ভাড়া করে দূর-দূরান্তের বড় ঝিরিগুলো থেকে পানি সংগ্রহ করে এনে বিক্রি করেন। এতে তাদেরও কিছু টাকা আয় এবং বান্দরবান-চিম্বুক-থানচি সড়কের দুই পাশে বিভিন্ন পাড়ার মুখে গড়ে উঠা টং দোকানগুলোর পানির চাহিদাও পূরণ হয়।
তারা আরও বলেন, পাহাড়ের মানুষদের বিনোদন, আড্ডা ও চা-নাস্তা খাওয়ার একমাত্র ভরসা হলো টং দোকানগুলো। এক হাজার লিটার ড্রামের পানি ১ হাজার টাকা এবং দেড় হাজার লিটার ড্রামের পানি দেড় হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। কখনো কম-বেশিও হয়।
এদিকে বিশুদ্ধ পানি সংকটের কারণে জেলা সদরের ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় থানচি সড়কের কয়েকটি গ্রামে পানি বিতরণ করছে স্থানীয় কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী।
বিশুদ্ধ পানি বিতরণের অন্যতম উদ্যোক্তা সাংবাদিক বাটিং মারমা জানান ‘শুষ্ক মৌসুমে পাহাড়ে গ্রামগুলোতে পানির সংকট দেখা দেয়। পেশাগত কাজে গিয়ে পানি সমস্যার কথা জানতে পেরে মানবিক কারণে গত দুই বছর ধরে চিম্বুক-নীলগিরি এলাকায় বিশুদ্ধ পানি বিতরণ করে আসছি। এ বছরও আমরা দুই-তিনজন মিলে পানি বিতরণের কাজ শুরু করেছি। পরে জেলা রেড ক্রিসেন্ট ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিস ৫ লিটারের ১০০টি পানির জার দিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে।’
এ ব্যাপারে গ্যালেঙ্গা ইউনিয়নের ইউপি সদস্য (মেম্বার) রেংওয়াই ম্রো জানান, পাহাড়ি নারীদের দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে হাজার ফুট পাহাড়ের নিচের ঝিরি থেকে পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। তাও পর্যাপ্ত নয়, দেড়-দুই ঘণ্টার চেষ্টায় দুই-এক কলসি পানি আনতে পারে তারা। পানির সংকট দিন দিন আরও তীব্র হচ্ছে। পরিস্থিতি এতটাই চরম আকারে পৌঁছাচ্ছে যে, শুস্ক মৌসুমে পাহাড়ে বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়ছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের।
সুপেয় পানির সংকটের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বান্দরবান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী অনুপম দে। তিনি জানান, সংকট নিরসনে চিম্বুক পাহাড়ে পানি বিতরণের খবর পেয়েছি। তাদের কাজে সহযোগিতার অংশ হিসেবে জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসের পক্ষ থেকে ১০ লিটারের ১০০টি জার দিয়েছি।
অনুপম দে বলেন, জেলায় সুপেয় পানির সংকট নিরসনে বান্দরবান সদর ও লামা পৌরসভায় এডিবির অর্থায়নে দুটি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আরও দুটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। প্রকল্পগুলো অনুমোদন পেলে বান্দরবান পার্বত্য জেলায় সুপেয় পানির সংকট কমে যাবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে