প্রস্তাবিত বাজেটে টেলিযোগাযোগ খাত
বাড়তি করের বোঝা স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করবে
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের যে কর বিন্যাস, তা একটি জটিল প্রশ্নের মুখে ফেলে দিচ্ছে বিশ্লেষকদের। এ বাজেটকে ওই দুটি খাতের জন্য ইতিবাচক বলব না নেতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করব? এটা ঠিক, কোনো বাজেটই কাউকে শতভাগ সন্তুষ্ট করতে পারবে না; কিন্তু সন্তুষ্টি-অসন্তষ্টির মাত্রায় কতটা ব্যবধান সেটাই একটা বাজেটকে ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক হিসেবে মূল্যায়নে মূল নির্দেশক হিসেবে বিবেচিত হয়। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কর অব্যাহতির মেয়াদ বাড়ানোর ঘোষণা স্বস্তি দিলেও টেলিযোগাযোগ খাতে বাড়তি করের বোঝা স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করবে।
আসুন প্রথমেই প্রস্তাবিত বাজেটে টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের জন্য ইতিবাচক দিকগুলো খুঁজে দেখি। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে গত ২৫ বছর ধরে বিদ্যমান থাকা কর অব্যাহতি সুবিধা আরও তিন বছর বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এটা খুবই ইতিবাচক। তবে ২০২৭ সালের পরিবর্তে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হলে সেটা তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী ও ভোক্তা-সবার জন্য স্বস্তির হতো। কারণ, আমরা এখন স্মার্ট বাংলাদেশের যাত্রাপথে। এই যাত্রাপথের চূড়ান্ত সাফল্য অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০৪১ সাল পর্যন্ত। এই বিস্তৃত যাত্রাপথে তথ্যপ্রযুক্তির নতুন অনেক রূপান্তরের মধ্য দিয়েই আমাদের যেতে হবে। সেই রূপান্তরগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়েই এ খাতের উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের টিকে থাকতে হবে। যে কারণে কর অব্যাহতির মেয়াদের দাবি ২০৪১ সাল পর্যন্ত রাখার দাবি উঠেছিল। সেই দাবির বিপরীতে অন্তত, ২০৩০ সাল পর্যন্ত কর অব্যাহতি রাখা হলে সেটাই হতো যৌক্তিক।
বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের যে গতিপ্রকৃতি সেখানে একটু গভীরভাবে চোখ রাখলে বোঝা যায়, তথ্যপ্রযুক্তির স্মার্ট রূপান্তরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের বাজারে ভারসাম্য রাখতে হলে কর অব্যাহতির মেয়াদ কমপক্ষে আরও ১০ বছর বাড়ানো যৌক্তিক। কারণ বর্তমানে বিশ্ব তথ্যপ্রযুক্তির বাজারে একটি সন্ধিক্ষণ চলছে। এতদিন তথ্যপ্রযুক্তির রূপান্তরের যে মাত্রা ছিল, এই সন্ধিক্ষণ থেকে তা আরও বেশি দ্রুতগতির ও রোমাঞ্চকর হবে। সে গতি ও রোমাঞ্চের সঙ্গে আমাদের দেশের তরুণ উদ্যোক্তা, ফ্রিল্যান্সার এবং উদ্ভাবকদের একাত্ম হওয়ার সুযোগ্য অব্যাহত রাখার দায়িত্ব সরকারেরই।
বিগত দিনগুলোতে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কর অব্যাহতি সুবিধা ছিল বলেই আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিপুল পরিমাণ ফ্রি-ল্যান্সার এসেছেন, বড় সংখ্যায় উদ্যেক্তা তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। কম দামে তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য পাওয়া গেছে বলেই অনেক কম সুবিধার মধ্যেও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্ভাবনে আমাদের তরুণরা প্রত্যাশার চেয়ে বেশিই সাফল্য এনেছেন। এখন কর অব্যাহতি সুবিধা তুলে দেয়া হলে তথ্যপ্রযুক্তির খাতের তরুণ উদ্যোক্তা- উদ্ভাবকরা বড় হোঁচট খেতেন। আপতত ১৯টি উপ-খাতে ২০২৭ সাল পর্যন্ত কর অব্যাহতির সুবিধা বহাল রাখার ফলে সেই হোঁচট খাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। ২০২৭ সালেও সেই হোঁচট-খাওয়ার বাস্তবতার পরিবর্তন হবে না। আমার মনে হয়, তখন আবারও কর অব্যাহতির মেয়াদ বাড়ানোর ঘোষণা নতুন করে দিতে হবে। আরও একটা কথা, কর অব্যাহতির জন্য ক্যাশলেস ট্রানজেকশনের কথা বলা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে এমএফএস এবং ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেনকে সম্পূর্ণ জটিলতামুক্ত করার দায়িত্বও অর্থমন্ত্রীকেই নিতে হবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে মোবাইল টেলিযোগাযোগের নতুন সংযোগের (সিমকার্ড) ক্ষেত্রে ভ্যাট ২০০ থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করা হয়েছে। এর পাশাপাশি মোবাইল ফোনে কথা বলা এবং মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে মোট ২০ শতাংশ করা হয়েছে। এ ছাড়া মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদনে ভ্যাট আরও ৫ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে সার্বিকভাবে মোবাইল ফোন ব্যবহারের খরচ বাড়বে। কথা বলা, ইন্টারনেট ব্যবহার এবং হ্যান্ডসেট ক্রয়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে খরচ বাড়বে। উচ্চ আয়ের মানুষের জন্য এই খরচ বৃদ্ধি ‘ম্যাটার’ না হলেও মধ্যবিত্ত থেকে স্বল্প আয়ের মানুষের কাঁধে এটা হবে বড় বোঝা। বিষয়টি বেশ অদ্ভূত। আপনি তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উৎকর্ষের জন্য বাজেটে কর অব্যাহতির সুবিধা বাড়াচ্ছেন। অন্যদিকে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের জন্য অপরিহার্য ডিভাইস এবং ইন্টারনেটের দাম বাড়াচ্ছেন। যদিও বলতেই পারেন, এবারের বাজেটে ল্যাপটপ আমদানিতে করভার ৩১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে ল্যাপটপের দাম কমবে। ২০২৩-২৪ সালের অর্থবছরে ল্যাপটপ আমদানিতে ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত ছিল বড় একটা ভুল। এ বছরের বাজেটে সেই ভুল থেকে বের হয়ে আসার জন্য ধন্যবাদ; কিন্তু মনে রাখতে হবে, বর্তমান দুনিয়া স্মার্টফোনের। এখনকার তরুণরা ল্যাপটপের চেয়ে স্মার্টফোনেই যতটা সম্ভব প্রয়োজনীয় কাজ সারতে উৎসাহী বেশি। যারা বাজেট প্রণয়ন করেছেন, তারা নিজেদের অভিজ্ঞতার দিকে তাকান, কতক্ষণ স্মার্টফোনে থাকেন, আর কতক্ষণ ল্যাপটপ বা ডেস্কটপে? উত্তরটা পেয়ে গেলে এবার ভাবুন, কমদামে স্মার্টফোনের উৎপাদন ও সরবরাহ নিশ্চিত করা কতটা জরুরি? অতএব, উৎপাদন পর্যায়ে যে ৫ শতাংশ ভ্যাট বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন, তা প্রত্যাহার করুন। এই ৫ শতাংশ ভ্যাট স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনকে পিছিয়ে দেবে; কিন্তু সরকারি রাজস্ব আদায়ে বড় কোনো ভূমিকা রাখবে না।
বিটিআরসির সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে বর্তমানে ১৩ কোটি ৮৫ লাখ ৯০ হাজার ইন্টারনেট গ্রাহক আছেন। এর মধ্যে ১২ কোটি ২৫ লাখ ১৫ হাজারই মোবাইল ইন্টারনেট গ্রাহক। এই ১২ কোটি গ্রাহকের মধ্যে মধ্যবিত্ত এবং স্বল্প আয়ের মানুষই বেশি। এর মধ্যে সেই চা শ্রমিকরাও আছেন, যারা ৫০ টাকা মজুরি বাড়ানোর জন্য ১৯ দিন ধর্মঘট করেছেন। এই মানুষগুলোর কাছে এখনো ১ টাকার হিসাব অনেক মূল্যবান। তাদের ঘাড়ের ওপর সম্পূরক শুল্ক, ভ্যাটের বাড়তি বোঝা কেন? দেশের যে বিপুলসংখ্যক তরুণ বিশ্ব তথ্যপ্রযুক্তি বাজারে ফ্রিল্যান্সিং করছেন, সামাজিক যোগোযোগ মাধ্যমের কনটেন্ট ক্রিয়েটর হিসেবে কাজ করছেন, তাদের ৯০ শতাংশই স্মার্টফোন ব্যবহার করেন, মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। তাদের ঘাড়ে কর-ভ্যাটের বাড়তি বোঝা কেন? আপনি ভ্যাট বাড়িয়েছেন, অতএব, স্মার্টফোন কম বিক্রি হবে, মোবাইল কম ইন্টারনেট প্যাকেজ বিক্রি হবে, ফলে বিদায়ী অর্থবছরের চেয়ে নতুন অর্থবছরে রাজস্ব আয় যে বাড়বে, সেটা মনে করার কোনো কারণ নেই। বরং সহজে বাড়তি ভ্যাট আদায়ের কৌশলের কারণে এ খাত থেকে রাজস্ব আদায় কমেও যেতে পারে।
বর্তমান অর্থমন্ত্রী অর্থশাস্ত্রে পণ্ডিত মানুষ। আশা করব, তিনি প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাত সংশ্লিষ্টদের উদ্বেগ তার বিচক্ষণতা দিয়ে বুঝবেন এবং বাড়তি ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্কের বোঝা চাপানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবেন এবং স্মার্ট বাংলাদেশে অগ্রযাত্রার পথকে গতিশীল করতে কার্যকর ভূমিকা নেবেন।
রাশেদ মেহেদী: টেলিযোগাযোগ খাত বিশ্লেষক ও প্রেসিডেন্ট, টেলিকম অ্যান্ড টেকনোলজি রিপোর্টার্স নেটওয়ার্ক, বাংলাদেশ (টিআরএনবি)।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে