Views Bangladesh Logo

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস: কল্পনার শক্তি

বেঁচে থাকলে এই ১২ ফেব্রুয়ারিতে তিনি হতেন ৮২ বছরের তরুণ। তরুণই বলব, কারণ মনের দিক থেকে তিনি ছিলেন চিরনবীন। আশপাশে সব কিছুতে তার যেমন আগ্রহ আর কৌতূহল ছিল, সবকিছুকে যেমন প্রথম দেখার আনন্দ নিয়ে দেখতেন, তাতে তো বলাই যায় বয়সের ভারে তিনি ন্যুব্জ হননি, ছিলেন সজীব, নতুন, এমনকি ৫৪ বছর বয়সে ক্যান্সারে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেও তিনি হতোদ্যম হননি। কলকাতার ক্লিনিকে অপারেশনে ডান-পা’টি বাদ গেলে তিনি ক্রাচে ভর করে পার্ক স্ট্রিটের ফুটপাতে হাঁটা প্র্যাক্টিস করছিলেন। আমি পেছন থেকে দেখতাম তার চওড়া কাঁধ আর ক্রাচে ভর করা দুই বাহু মূল একটা ছন্দ বজায়ে রেখে ওঠানামা করছে। দীর্ঘকাল কেমো নেয়ার ফলে মাথার চুল একবার পড়ে আবার ছোট ছোট কাঁচাপাকা চুল গজাচ্ছিল। দেখতাম ক্রাচে হাঁটতে গিয়ে তার খুব পরিশ্রম হচ্ছে এবং মাথায়, কাঁধে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে। তিনি এই যে প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তির জোরে হাঁটছিলেন এর উদ্দেশ্য ছিল একটাই- যেন দেশে ফিরে মহাস্থানগড় যেতে পারেন এবং সেখানকার উঁচুনিচু লাল পথে হেঁটে তার শেষ উপন্যাসের রসদ সংগ্রহ করতে পারেন। তার লেখার ধরন ছিল ওই রকমই; চেয়ার-টেবিলে পুরোনো টাইপরাইটারের সামনে রাতের পর রাত বসে লেখার আগে যে প্রেক্ষাপটকে তিনি উপন্যাসের প্রায় একটি চরিত্র হিসেবে তৈরি করবেন সেখানকার মানুষ, প্রকৃতি, জীবজন্তু সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে, সেখানকার ইতিহাস এবং প্রচলিত গল্পগাথা জানতে সেই জায়গায় গিয়ে ঘুরে বেড়াতেন, লোকজনের সঙ্গে মিশতেন, তাদের বাচনভঙ্গি খেয়াল করতেন এবং সেসব নোটবইয়ে টুকে রাখতেন; এমনকি জায়গাটার একটা নক্সাও করে ফেলতেন। একজন বড় উপন্যাস লেখককে তার লেখার স্থান-কাল-পাত্র সম্পর্কে সব দিক থেকে একটা খাঁটি ধারণা পেতে হলে বোধ হয় এভাবেই কাজ করতে হয়। এভাবে তার ভাষার জাদুতে ভিটেমাটি-ঘরবাড়ি-গাছপালা-পশুপাখি-লোকাচার-ইতিহাস-কল্পকাহিনি নিয়ে স্বয়ং স্থান এবং কাল হয়ে উঠতো দুই স্বতন্ত্র, জীবন্ত চরিত্র।

তার আয়ুস্কাল ছিল চুয়ান্ন বছর। একজন সৃজনশীল, গবেষক-লেখকের জন্য চুয়ান্ন বছর বেশ কমই। তবে এর চেয়েও কম জীবৎকালে লিখে বিশ্বসাহিত্যে অমর হয়ে আছেন এমন লেখকের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। আমাদের বাংলা সাহিত্যেই অন্তত দুজন আছেন- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ- যারা ইলিয়াসের চেয়েও কম বয়সে মারা যান। অনেকে বলেন তার রচনার সংখ্যা বেশি নয়- মাত্র দুটি উপন্যাস, দুজনেরও কমসংখ্যক ছোটগল্প নিয়ে পাঁচটি গল্পের বই, একটি প্রবন্ধের সংকলন, আর শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা দুটি বই- এদের একটি বিশ্বসাহিত্যের কয়েকটি চিরায়ত কাহিনিকে আমাদের স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্য গল্পের ছলে বলা; আর অন্যটি ওই বয়সের শিক্ষার্থীদের জন্য লেখা দুচারটি প্রবন্ধের সংকলন। এই প্রবন্ধগুলোর একটি হলো ‘বই পড়ার আনন্দ’। আজকাল মোবাইল আর ইন্টারনেটের যুগে ছেলেমেয়েরা বই বিমুখ হয়ে যাচ্ছে; কিন্তু আমাদের ছেলেবেলায় আমরা বই পাঠেই আনন্দ পেতাম বেশি। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বাবা-মা দুজনেরই ছিল বই পড়ার শখ। বাবা যখনই বগুড়া থেকে ঢাকায় আসতেন সঙ্গে কিনে নিয়ে ফিরতেন কয়েকটা বই। এভাবে বাসার দুটো আলমারি ক্রমে ভরে ওঠে এবং তাতে ছোটখাটো একটা পাঠাগারই তৈরি হয়ে যায়। সেখানে ছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষীরের পুতুল, শকুন্তলা, বিভূতিভূষণের আম আঁটির ভেঁপু, পথের পাঁচালী, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথা, পদ্মা নদীর মাঝি, দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদারের ঠাকুরমার ঝুলি, ঠান দিদির থলে, রাশিয়ার রূপকথার সংকলন, বাংলা অনুবাদে দস্তয়েভস্কির লাঞ্ছিত যারা, পার্ল বাকের লেখা মাদার, গুড আর্থ; সুকুমার রায়ের আবোল তাবোল, হযবরল, খাই খাই, পাগলা দাশু, দেবীপ্রসাদ চট্টপাধ্যায় সম্পাদিত দশ খণ্ডে জানবার কথা, বিজ্ঞানের বই সাগর তলের জগৎ, আকাশের রহস্য, মহাকাশের ঠিকানা আরও কত কি! এ ছাড়া বঙ্কিম রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্র তারাশঙ্কর, মুজতবা আলি তো ছিলই। এসব বই পড়ে ইলিয়াসের মনোজগৎ গড়ে ওঠে, কল্পনা বিস্তৃত হয়, কীভাবে মনের ভাব প্রকাশ করতে হয়, কী কায়দায় একটা কিছু বর্ণনা করতে হয় সে সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা জন্মে। আসলে বই পড়ার মধ্য দিয়েই ছেলেমেয়েরা কল্পনা করতে শেখে এবং সেই কল্পনা কীভাবে লেখার মাধ্যমে বলতে হয় তাও শেখে। এজন্যই সম্ভবত আইনস্টাইন বলতেন, যে ব্যক্তি যত কল্পনাপ্রবণ সে তত উন্নত পর্যায়ের মানুষ। এই কল্পনা সে যে কেবল কবিতা লিখতে কি সাহিত্য করতেই ব্যবহার করে তা নয়, বিজ্ঞান সমাজতত্ত্ব-রাজনীতি-অর্থনীতি সব বিষয়েই সৃষ্টিশীলতার প্রমাণ রাখতে গেলে থাকতে হয় অদম্য কৌতূহল, কল্পনা করার এবং স্বপ্ন দেখার শক্তি। একই সঙ্গে নতুন কিছু সৃষ্টিতে- সে সাহিত্য হোক কি সংগীতই হোক, কি শিল্প প্রতিষ্ঠান, শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে হোক- থাকতে হয় কল্পনা, করতে হয় প্রচুর পড়াশোনা এবং গবেষণা।

কল্পনা শক্তির সেরা নিদর্শন ইলিয়াস দেখিয়েছেন তার দুটো উপন্যাসে- চিলেকোঠার সেপাই এবং খোয়াবনামা। দুটোই রাজনৈতিক উপন্যাস। তিনি বেঁচে থাকতে আমাদের জাতীয় জীবনে যে রাজনৈতিক ঘটনাগুলো ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, যেমন ১৯৪৭-এর পাকিস্তান আন্দোলন, ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণআন্দোলন, ১৯৭১-এর স্বাধীনতা আন্দোলন, ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন- সেসব থেকে একটি পাকিস্তান আন্দোলন নিয়ে তিনি লেখেন খোয়াবনামা; আর স্বাধীনতা আন্দোলনের দুই বছর আগের ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখেন চিলেকোঠার সেপাই। এই দুই উপন্যাসেই তিনি কল্পনাশক্তির যে পরিচয় দিয়েছেন এবং কল্পনা খাটিয়ে যে বিশাল প্রেক্ষাপটে আমাদের জাতীয় জীবনের দুটো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলনকে শিল্পে ধারণ করেছেন তা আসলেই বিরল। এজন্য বলা যায়, বিশ্বমানের এই দুই উপন্যাসের কল্যাণেই আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে থাকবেন। মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত না হলে তিনি প্রস্তুতি নিয়েছিলেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ভিত্তি করে পুন্ড্র-বাংলার মহাস্থানগড়কেন্দ্রিক আরও একটি উপন্যাস লেখার; নামও ঠিক করেছিলেন- করতোয়া মাহাত্ম্য- কারণ তার গল্পের পটভূমি হতো এই করতোয়া নদীর তীরবর্তী অঞ্চল। পাল বংশের রাজত্বকালে একাদশ শতকে এই অঞ্চলে জেলে আর চাষিদের একটা বিদ্রোহ হয়েছিল যাকে কৈবর্ত বিদ্রোহও বলা হয়; এবং তাতে ২য় মহিপালকে পরাজিত করে কৈবর্ত নেতা ভীম, দিব্যক কয়েক বছর রাজত্বও করেছিলেন। তো ইলিয়াস চেয়েছিলেন যে এই শেষ উপন্যাসে তিনি বৃহত্তর রাজশাহী, বগুড়া, দিনাজপুরের বরেন্দ্রভূমির সাধারণ মানুষের হাজার বছরের নানা ধরনের বিদ্রোহ-প্রতিবাদ-প্রতিরোধের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের একটা ধারাবাহিকতা বজায়ে রেখে তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস বা মাস্টারপিসটি রচনা করবেন এবং এভাবে আমাদের রাজনীতিপ্রবণ এই দেশের তিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, জীবন পাল্টানো ঘটনা নিয়ে একটি ট্রিলজির শেষ কাহিনিটি লিখবেন। এই অঞ্চলের ইতিহাস তো কেবল হাজার নয়, আড়াই তিন হাজার বছরের পুরোনো। মহাস্থানগড়ে মাটি খুঁড়ে ইতিহাসের দু-তিন স্তরের সভ্যতার, বিশেষ করে অশোক ও মৌর্য যুগের নিদর্শনও পাওয়া গেছে বলে শোনা যায়। বাংলাদেশের এই প্রাচীনতম মাটির ইতিহাস খুঁড়ে এখানকার মানুষের জীবনযাপনের সংগ্রামের ধারাবাহিকতার সঙ্গে তিনি যুক্ত করতে চেয়েছিলেন একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামকে। কিংবা অন্যভাবে বলা যায় আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামকে ধারণ করতে চেয়েছিলেন এই অঞ্চলের দুই হাজার বছরের প্রেক্ষাপটে এবং সেভাবে মর্যাদা দিতে চেয়েছিলেন শুধু মানুষের নয়, সামগ্রিকভাবে স্থান ও কালেরও। এজন্য বাঁচতে চেয়েছিলেন আরও দুটি বছর; কিন্তু প্রকৃতি তাকে সেই সময়টুকু দেয়নি। আর আমাদেরও দুর্ভাগ্য, এই সময়টিতেই ইলিয়াস ছিলেন তার সৃজনশীলতার তুঙ্গে।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ওপর বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে। আমাদের দেশে এবং পশ্চিমবঙ্গে, আসামের বিশ্ববিদ্যালয়ে, কলকাতায়, যাদবপুরের বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ কেউ তার ওপর স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি থিসিস লিখেছেন এবং কলকাতা ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং আমাদের এখানেও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে রয়েছে তার গল্প উপন্যাস। তার উপন্যাস নিয়ে হয়েছে নাটক, গল্প নিয়ে সিনেমা; কিন্তু কোনোটাই তেমন সাড়া জাগাতে পারেনি। এক শিল্পমাধ্যমের সার্থক সৃষ্টি অন্য মাধ্যমে সমান সাফল্য লাভ করেছে এমন নজির যে নেই তা নয়; আছে, যেমন উপন্যাস জোরবা দ্য গ্রিক, পথের পাঁচালী, লাস্ট টেম্পটেশন, ছোটগল্প “রাসোমন” চলচ্চিত্র মাধ্যমে দারুণ সাফল্য পেয়েছে; কিন্তু এ ধরনের সফলতা পেতে গেলে বোধহয় দৃশ্যকলা মাধ্যমের পরিচালককেও হতে হয় ঔপন্যাসিকের সমমানের।

অনেকে বলেন তিনি কম লিখেছেন, নিজে যদিও তিনি সেরকম ভাবতেন না এবং বলতেন যে তার ছোটগল্পগুলো যেমন অনেক জনপ্রিয় গল্পকারের জন্য, বিশেষ করে যারা ঈদসংখ্যার তাগিদে সপ্তাহ-দুসপ্তাহেই একটা তথাকথিত উপন্যাস লিখে ফেলেন তাদের জন্য ছোটখাটো উপন্যাসেরই শামিল, তেমনি তার একটি উপন্যাস থেকে সে ধরনের ঔপন্যাসিক আট-দশটা উপন্যাসের খোরাক পেয়ে যেতে পারেন। যে পরিশ্রম করে তিনি লিখতেন, গল্পের চরিত্রকে তাদের যথাযথ সামাজিক প্রেক্ষিতে স্থাপন করতে এবং তাদের জীবন্ত করতে যেসব যুৎসই সংলাপ তাদের বচনে জুড়ে দিতেন, কাহিনির নানা চড়াই-উতরাই পেরোতে, দৃশ্যপট নির্মাণ করতে যেসব ইঙ্গিত, ইশারা ব্যবহার করতেন এবং এসব কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে নিজের মতামত লুকিয়ে রেখে যে নির্মম নির্মোহে গল্পের মানুষগুলোকে সৃষ্টি করতেন তাতে এসব পড়তে গিয়ে কিংবা পড়ে ভাষার জাদুতে মনে সৃষ্ট নানা উপমা উৎপ্রেক্ষা, কাহিনির জটাজাল, চরিত্রের জটিল মনস্তত্ত্ব ইত্যাদি অনুধাবন করতে পাঠককে প্রচুর সময় দিয়ে একটা কষ্টকর কিন্তু আনন্দময় যাত্রায় অংশ নিতে হয়- এতই যে পড়া শেষে পাঠকেরও মনে হয় ইলিয়াস নেহায়েত কম লেখেননি।

বাংলা ভাষায় বিশ্বমানের লেখা নেহায়েত কম নয় এবং এই ভাষাতে লিখেই একজন নোবেল পেলেন ১৯১৩ সালে। তা সত্ত্বেও বাংলা এখনো একটি আঞ্চলিক ভাষা হিসেবেই পরিচিত। এজন্য পৃথিবীর প্রধান ভাষাগুলোতে আমাদের সেরা রচনাসমূহ সেভাবে অনূদিত হতে দেখি না। পৃথিবীতে লিখিত ও মৌখিক ভাষার সংখ্যা ৬ হাজারের মতো। এর মধ্যে অনেক ভাষায় কথা বলার শেষ মানুষটি মারা গেলে সে ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। অনেক ভাষার কোনো লিখিত বর্ণমালা নেই। তারা একটি প্রধান ভাষার বর্ণমালা ধার করে নিজেদের সাহিত্যকর্মে নিয়োজিত রয়েছেন। এ ক্ষেত্রে রোমান বর্ণমালারই জয়জয়কার, যেহেতু ওই বর্ণমালা ব্যবহার করেই বিশ্বের সর্বোচ্চসংখ্যক সাহিত্যকর্ম রচিত হয়েছে। আমার প্রাক্তন সহকর্মী বিশিষ্ট লেখক-অনুবাদক অধ্যাপক আব্দুস সেলিমের কাছে শুনে অবাক হলাম যে, পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম ভাষা বাংলায় লেখা একটি বইও নেই যা অন্তত বিশটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কয়েকটি ছোটগল্পের ইংরেজি অনুবাদ আমাদের এখানে এবং ভারতের বিভিন্ন গল্পসংগ্রহ ও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তার উপন্যাস খোয়াবনামার ইংরেজি অনুবাদ বেরিয়েছে ভারতের পেঙ্গুইন র‍্যান্ডম হাউস থেকে। অরুনাভ সিনহার অনুবাদ যথেষ্ট মূলানুগ হলেও এ দেশের মাটি ও মানুষের নাড়িস্পন্দে সম্পৃক্ত হতে না পারায় তা যান্ত্রিক মনে হয়। ইংরেজি জানা বিশ্বে কিংবা ভারতের অবাঙালি রাজ্যগুলোয় এই ইংরেজি অনুবাদের পাঠক প্রতিক্রিয়া কিছুই জানা গেল না। চিলেকোঠার সেপাই-এর অনুবাদ কার্যক্রম চলছে যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। যদিও তাকে অনুবাদ করা একরকম অসম্ভব ব্যাপার, তবু আমাদের সাহিত্যের স্বার্থে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতো বিশ্বমাপের একজন লেখকের কাজের ভালো অনুবাদ হওয়া প্রয়োজন। আমাদের সাহিত্য সম্পর্কে বাইরের বিশ্বের আগ্রহ কম কেন সেটাও গবেষণার বিষয়। আসলে রাজনৈতিকভাবে জরুরি না হলে কিংবা অর্থনীতিতে চমক দেখাতে না পারলে বোধ হয় সে দেশের শিল্পসাহিত্য সম্পর্কেও অন্যের আগ্রহ সৃষ্টি হয় না। উপরন্তু আমরা বহুভাষী জাতি নই। ঔপনিবেশিক ইংরেজি ভাষায় আমাদের অভিজ্ঞতা দুইশ বছরের; কিন্তু এই ভাষাটিও সেভাবে শেখা হয়নি। ফলে প্রথম ভাষা বা মাতৃভাষাতুল্য দক্ষতা এই ভাষায় আমাদের হয়নি; কিন্তু ইউরোপীয় ভাষায় না হোক, ভারতেই তো রয়েছে দুইশর মতো ভাষা। হিন্দি, উর্দু, তামিল, মালায়েলাম, তেলেগু, গুজরাটি- কোনো ভাষাতেই ইলিয়াস অনূদিত হয়েছেন বলে অন্তত আমার জানা নেই; কিন্তু এসব ভাষায় অনুবাদ করতে গেলেও তারা সরাসরি বাংলা থেকে করতে পারবেন বলে মনে হয় না। তাদেরও হয়তো ইংরেজি থেকেই করতে হবে। বাংলাদেশে বসবাসরত প্রয়াত সাংবাদিক জয়নুল আবেদীন খান উর্দু ভাষায় খোয়াবনামা অনুবাদ করে পাণ্ডলিপি রেখে গেছেন। ঢাকায় বাংলা-উর্দু সাহিত্য ফাউন্ডেশন আছে এবং বাংলা জানা শিক্ষিত উর্দু ভাষী জনগোষ্ঠীও রয়েছেন। এ ধরনের যৌথ ভাষাভিত্তিক সংগঠন কিন্তু অনুবাদ কার্যক্রম হাতে নিতে পারেন। বিভিন্ন ভাষায় ব্যাপক অনুবাদ ছাড়া বাংলায় লেখা আন্তর্জাতিকমানের সাহিত্যকর্ম বিশ্বে পরিচিত করার অন্য কোনো উপায় নেই।

খালিকুজ্জামান ইলিয়াস: অধ্যাপক ও অনুবাদক

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ