সংবিধান সংস্কারের রিপোর্টের ভিত্তিতে হওয়া উচিত ছিল সব সংস্কার: আইনজ্ঞদের অভিমত
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত ৩ অক্টোবর নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশ ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। পরে ৭ অক্টোবর সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। এরপর দ্বিতীয় ধাপে গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য, শ্রম, নারীবিষয়ক ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন গঠন করে সরকার।
এসব কমিশনের মধ্যে গত ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশ ও জনপ্রশাসন এবং সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। যাতে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এখনো জমা দেয়া হয়নি বিচার বিভাগ, গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য, শ্রম, নারীবিষয়ক ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট। তবে আইনজ্ঞদের অভিমত- সব সংস্কারের রিপোর্ট হওয়া উচিত ছিল সংবিধান সংস্কারের রিপোর্টের ভিত্তিতে। কারণ সব বিষয়ই সংবিধান অনুযায়ী হতে হবে। তাই সংবিধান সংস্কার কীভাবে হবে তার ওপরই নির্ভর করছে বাকি সংস্কার কীভাবে হবে। আলাদা করে প্রতিটি সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করা হলে তা সংবিধান সংস্কারের সঙ্গে মিল নাও থাকতে পারে। রিপিট হতে পারে কিছু বিষয়। এতে করে দেখা দিতে পারে জটিলতা। এরই মধ্যে বিচার বিভাগের বিষয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশন বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। তা বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের করার কথা।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের রিপোর্টে বিচার বিভাগ নিয়ে বলা হয়েছে- উচ্চ আদালত বিকেন্দ্রীকরণ করে দেশের সব বিভাগে হাইকোর্ট বিভাগের সমান এখতিয়ার সম্পন্ন হাইকোর্টের স্থায়ী আসন প্রবর্তনের সুপারিশ করে কমিশন। তবে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আসন রাজধানীতেই থাকবে। এছাড়া, অধস্তন আদালতের পরিবর্তে স্থানীয় আদালত নাম ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়েছে। স্থানীয় আদালতের বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের নিয়োগ, পদায়ন, পদোন্নতি, ছুটি এবং শৃঙ্খলাসহ সব সংশ্লিষ্ট বিষয় সুপ্রিম কোর্টের কাছে ন্যস্ত থাকবে। পাশাপাশি একটি বিচারিক সচিবালয় প্রতিষ্ঠারও সুপারিশ করা হয়। এসব সুপারিশ করার কথা বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের- এমনটাই বলেছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা।
এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘সংবিধান সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট ভালোভাবে পর্যালোচনা করে তবেই বাকি সব সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করা উচিত ছিল। কারণ সব কিছুই সংবিধানের অধীন। যে যার মতো করে তাদের কমিশন সংস্কারের রিপোর্ট দিলে সংবিধান সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট কি প্রয়োজন? সব কিছুরই একটা ধারাবাহিকতা থাকা প্রয়োজন ছিল। এখন দেখা যাক সব সংস্কারের রিপোর্ট কতটা বাস্তবায়ন হয়।’
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ আহসানুল করিম ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘সব কিছুরই একটা ধারাবাহিকতা আছে। যেটা আগে প্রয়োজন এবং যার ভিত্তিতে সব কিছু করা হবে তা আগেই করতে হয়। নইলে সব এলোমেলো হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের সঙ্গে আরও তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের রিপোর্ট জমা দেয়া হয়েছে। সেগুলোর রিপোর্টও স্বতন্ত্র। অর্থাৎ সংবিধান সংস্কারের রিপোর্টের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই আলাদা। অথচ সংবিধানই দেশের সব। কোনো বিষয় সংবিধানের বাইরে না। আবার সংবিধান সংস্কার কমিশন দেখলাম বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সব গুরুত্বপূর্ণ কাজ সেরে ফেলেছে। এখন বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন আর কি রিপোর্ট দেবে? দিলেও তা হবে সংবিধান সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের বাইরে। তা জটিলতা সৃষ্টি করবে বলেই মনে করছি।’
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন, দুদক ও পুলিশ সংস্কার কমিশন তাদের মতো করে রিপোর্ট জমা দিয়েছে। আবার সংবিধান সংস্কার কমিশন আদালা রিপোর্ট করেছে। কিন্তু এসব কিছুই সংবিধানের আওতায়। তাই আগে সংবিধান সংস্কারের রিপোর্ট হওয়ার পর অন্য সব কমিশনের সংস্কার রিপোর্ট হওয়া উচিত ছিল।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘সংবিধান সংস্কার কমিশনের রিপোর্টে বিচার বিভাগ সংস্কারের রিপোর্ট মোটামোটি দিয়ে দিয়েছে। এখন বিচার বিভাগ এর বাইরে কি রিপোর্ট দেবে? দিলেও তা হবে এই রিপোর্টেরই বিস্তারিত ভার্সন। অন্যদিকে সংবিধান সংস্কার কমিশন রিপোর্ট তো হওয়া উচিত ছিল সবার আগে। সেটা বিশ্লেষণ করেই সব সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট হওয়া উচিত ছিল। তাহলে সবই হতো সংবিধান মোতাবেক ও এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এখন দেখা যাক সব সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট এলে কতটা বাস্তবায়ন হয়।
উল্লেখ্য, গত ১৫ জানুয়ারি সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ। এতে সাতটি প্রধান বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে একগুচ্ছ সুপারিশ করা হয়েছে। বিষয়গুলো হলো: ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, প্রধানমন্ত্রী পদের একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাস, অন্তর্বর্তী সরকার কাঠামোর সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ, শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সুনিশ্চিতকরণ এবং মৌলিক অধিকারের আওতা সম্প্রসারণ, সাংবিধানিক সুরক্ষা ও বলবৎযোগ্যতা নিশ্চিতকরণ। ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ করার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। আর প্রজাতন্ত্রের পরিবর্তে ‘নাগরিকতন্ত্র’ করার প্রস্তাবও করেছে কমিশন।
বর্তমানে বাংলাদেশের সংবিধানের নাম হিসেবে উল্লেখ আছে, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’। সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে সংবিধানের প্রস্তাব হিসেবে বলা হয়েছে, ‘জনগণের সম্মতি নিয়ে আমরা এই সংবিধান জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করছি। দেশের বিদ্যমান সংবিধানে আছে বাংলাদেশ একটি একক, স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র, যা “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ” নামে পরিচিত হবে।’
নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে নির্বাচনি আইন পরিবর্তনের পাশাপাশি কিছু প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশন। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধনেরও সুপারিশ করতে চায় কমিশন। অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে একটি কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে একগুচ্ছ সুপারিশ রাখবে বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ইসির নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা, প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে আইনে সংশোধন, ইসির ক্ষমতা বাড়ানো ও জবাবদিহি তৈরি, নির্বাচনি শাস্তি ও ব্যবস্থা নেয়ার বিধানগুলো কিছু ক্ষেত্রে আরও সুনির্দিষ্ট করা, হলফনামার ছকে পরিবর্তন, হলফনামার তথ্য যাচাই বাধ্যতামূলক করার কথা থাকতে পারে সুপারিশে। পাশাপাশি নির্বাচনে ‘না’ ভোটের সুযোগ যুক্ত করা, সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি ভোটের ব্যবস্থা করা, রাজনৈতিক দলের প্রার্থী মনোনয়ন পদ্ধতিতে কিছু পরিবর্তন আনা, ন্যূনতম ভোটার ছাড়া নির্বাচন বাতিল, জাতীয় পরিচয়পত্রের সেবা ইসির অধীনে রাখা, দুই কক্ষের পার্লামেন্ট ও সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা প্রণয়নসহ বেশ কিছু সুপারিশ থাকছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদককে স্বাধীন ও কার্যকর করতে কী কী পদক্ষেপ নেয়া যায়, সে বিষয়ে ৪৭ দফা সুপারিশসহ প্রতিবেদন দিয়েছে দুদক সংস্কার কমিশন। এ কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মোটা দাগে দুই ধরনের সংস্কারের সুপারিশ রেখে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। একটিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের সরাসরি সংস্কার; আরেকটিতে রয়েছে এই সংস্কার কার্যকর করার জন্য পুরো রাষ্ট্রকাঠামোয় পরিবর্তন আনার সুপারিশ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে