সৈয়দ হককে নিয়েও এমন একটা গুজব ছড়িয়েছে যে তিনি রাজাকার
স্বকৃত নোমান এ সময়ের আলোচিত কথাসাহিত্যিক। দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে লিখেছেন বেশ কিছু মননশীল গ্রন্থও। প্রগতিশীল চিন্তা-ভাবনার জন্য তিনি ঋদ্ধ-পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। পেয়েছেন বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পুরস্কারও। বইমেলা উপলক্ষে তার লেখালেখি ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা হলো ভিউজ বাংলাদেশের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কামরুল আহসান ও মাহফুজ সরদার।
ভিউজ বাংলাদেশ: কেমন আছেন?
স্বকৃত নোমান: ভালো আছি। আপনারা কেমন আছেন?
ভিউজ বাংলাদেশ: ভালো আছি। আপনার তো এবার তিনটি বই প্রকাশিত হলো …
স্বকৃত নোমান: তিনটি প্রকাশিত হয়েছে। আরও একটা প্রকাশের অপেক্ষায় আছে।
ভিউজ বাংলাদেশ: আচ্ছা, কী বই ওটা?
স্বকৃত নোমান: ‘যুবতী রাধে, সৈয়দ হক ও আরো কথা’।
ভিউজ বাংলাদেশ: আচ্ছা, এরকম অদ্ভুত নাম কেন?
স্বকৃত নোমান: কয়েকটা বিষয় নিয়ে এ বইয়ে লিখেছি। ঠিক প্রবন্ধ নয়, আমার সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের সাক্ষর এ বইটি। একটা প্রবন্ধ আছে সৈয়দ হককে নিয়ে। সৈয়দ হককে যারা রাজাকার বানাতে চেয়েছিল আমি তাদের বিরুদ্ধে একটা ফাইট দিয়েছি। যুদ্ধ করেছি। আমাদের এখানে একটা মারাত্মক প্রবণতা আছে। ধরুন, আপনাকে কেউ বলল আপনি রাজাকার। ব্যস, কোনোরকমের যাচাই-বাছাই ছাড়াই আপনাকে রাজাকার ট্যাগ দিয়ে দিবে। কিংবা, আপনাকে বলল আপনি খুব দুর্বল লেখক। আপনাকে আর পড়তে হবে না। না পড়েই আপনার সম্পর্কে মন্তব্য করে বসবে, ও, ওর লেখা তো কিছু হয় না। এটা একটা জাতিগত অসুখ আমাদের। আমরা ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি রবীন্দ্রনাথ নাকি নজরুলের লেখা চুরি করে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। বাংলাদেশের ১০ কোটি মানুষ পাবেন এখনো এই কথা বিশ্বাস করে। অথচ রবীন্দ্রনাথের জন্ম কবে, নজরুলের জন্ম কবে তাও জানে না। এই গুজব-প্রবণতা আমাদের মাঝে এত বেশি প্রকট, যা প্রায় অসুখের মতো। সৈয়দ হককে নিয়েও এমন একটা গুজব ছড়িয়েছে যে তিনি রাজাকার। অনেকেই কোনো কিছু পরিষ্কার না জেনে তা বিশ্বাস করেছে। আমাকে এত বেশি আহত করেছে এই ব্যাপারটা আমি এর বিরুদ্ধে কলম ধরতে বাধ্য হয়েছি। আমি দীর্ঘ গবেষণা করে সৈয়দ হকের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের জবাব দিয়েছি।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনার চারটি বই আসছে এই বইমেলায়, কোন বইটি নিয়ে আপনি সবচেয়ে বেশি উৎসাহী?
স্বকৃত নোমান: সবচেয়ে বেশি ‘ইহযৌবন’ নিয়ে। আমি মূলত উপন্যাস লিখি। পাশাপাশি প্রবন্ধ বা প্রবন্ধ-টাইম মুক্তগদ্য লিখি। ‘মহাকালের রেখাপাতা’ আমার মুক্তগদ্যের সিরিজ বিদ্যাপ্রকাশ প্রকাশ করেছে। ‘ইহযৌবন’ নিয়ে এ-কারণে আমি উত্তেজিত। উত্তেজিত শব্দটা যুৎসই কি না জানি না, উচ্চাকাঙ্ক্ষী বলা যেতে পারে। এই উপন্যাসটা আমার নবম উপন্যাস। আবার বারোতম উপন্যাসও বলা যেতে পারে। যদি আমি আমার প্রথম প্রকাশিত তিনটি উপন্যাসকে ধরি। আমি আমার প্রথম তিনটি উপন্যাসকে বাতিল ঘোষণা করেছি।
ভিউজ বাংলাদেশ: বাতিল ঘোষণা করেছেন কেন?
স্বকৃত নোমান: আমি মনে করি, আমি যা লিখতে চেয়েছি, তা হয়ে ওঠেনি। তো ‘রাজনটী’ থেকে ‘ইহযৌবন’ পর্যন্ত আমার যে জার্নি সেই জার্নির নবমতম উপন্যাস হচ্ছে ‘ইহযৌবন’। ইহযৌবনে আমি কল্পনার শক্তিটাকে একটু পরীক্ষা করতে চেয়েছি। আমি বুঝতে চেয়েছি যে, লেখকের কল্পনা কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে। আমি যেখানে কাজ করি, বাংলা একাডেমিতে, বাংলা একাডেমির সপ্তম তলার বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালে দেখা যায় প্রকাণ্ড এক শিরীষ গাছ। চারদিকে ডালপালা ছড়িয়ে আছে। গাছটার দিকে তাকালেই আমি অদ্ভুত এক ঘ্রাণ পেতাম। ঘ্রাণটা কীসের ঠিক বুঝে উঠতে পারতাম না। মনে হতো পাতার ঘ্রাণ, রোদে-পোড়া ঘ্রাণ। ‘ইহযৌবন’ এই ঘ্রাণ নিয়ে উপন্যাস। ঘ্রাণ নিয়ে একটা উপন্যাস হতে পারে! অনেক চরিত্র এসেছে আস্তে আস্তে। একটা ঘ্রাণের সঙ্গেই তারা জড়িয়ে আছে। এই উপন্যাসের মূল-বিষয় হচ্ছে প্রাণ-প্রকৃতি। তারপর আছে মানুষের অতীত, স্মৃতিকাতরতা। আমার অন্যান্য উপন্যাসের চেয়ে এই উপন্যাসটির বিষয়, কাহিনি একটু আলাদা। সে-কারণে এই উপন্যাসটি নিয়ে আমি বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনি মূলত উপন্যাসই লিখেন। দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেও নানা ধরনের লেখা লিখেন; কিন্তু এবার গবেষণাধর্মী একটি বই লিখলেন, ‘বাংলায় ইসলাম, সহজিয়া ও রক্ষণশীল ধারা’। এই বইটি লিখতে কেন অনুপ্রাণিত হলেন?
স্বকৃত নোমান: ২০১৩ সাল ছিল বাংলাদেশের জন্য একটা সংকটের সময়। এর পরে আমরা দেখেছি নাস্তিকদের হত্যা করা হচ্ছে। ওয়াহাবিবাদের এক প্রকার উত্থান লক্ষ্য করি। ইসলামের উত্থান না, ওয়াহাবিবাদের উত্থান। ধর্মের একটা আধ্যাত্মিক দিক আছে, সৌন্দর্যের দিক আছে। ইসলাম ধর্মের মধ্যেও অনেক সৌন্দর্য ছিল, সহনশীলতা ছিল। সৌন্দর্য ও সহনশীলতা না থাকলে ইসলাম ধর্ম এতদূর পর্যন্ত আসতে পারতো না। কী সেই সৌন্দর্য সেটা আমি অন্বেষণ করার চেষ্টা করেছি। অন্বেষণ করতে গিয়ে আমি দেখি, ভারতবর্ষে, বিশেষত বাংলায় ইসলামের দুটি ধারা। একটি হচ্ছে রক্ষণশীল ধারা, আরেকটা হচ্ছে সহজিয়া ধারা। সহজিয়া ধারা কোনটি? যে মানবতার ধর্মের কথা বলেছেন আমাদের লালন, আমাদের হাছন, আমাদের শাহ আবদুল করিম, বিজয় সরকার, রাধারমন। কিংবা, আরও আরও যারা লোকসাধক আছেন, তারা সহজিয়া ইসলামের কথা বলেছেন। মাজারকেন্দ্রিক যে-সংস্কৃতি প্রচলিত আমাদের সমাজে, দেখবেন সেখানে সর্বধর্মের লোকের সহ-অবস্থান। সব ধর্মের লোকজনই সেখানে যাচ্ছে। এটা কিন্তু মসজিদে সম্ভব না। মাজারে সম্ভব। এটা আমাকে ভাবালো, আপ্লুত করল। আমি যে-বহুত্ববাদের কথা বলি, আমি যে-উদারতার কথা বলি, সহিষ্ণুতার কথা বলি, সেই সহিষ্ণুতার চর্চাটা আমি মাজারে দেখতে পাই। এটা আমাকে আকৃষ্ট করল। আমি মাজারগুলো সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়া শুরু করলাম। ভারতে, বাংলায় সুফিদের যে-আবির্ভাব, এই সুফিরা কীভাবে ধর্ম প্রচার করলেন? সুফিরা কীভাবে সহজিয়ার কথা প্রচার করলেন, সহিষ্ণুতার কথা বললেন তা অনুসন্ধান শুরু করলাম। অনুসন্ধান করতে করতে লিখেছি, লিখতে লিখতে বারবার ক্রসচেক করেছি, অনেক লেখাই ফেসবুকে দিয়েছি, অনেক ধরনের মতামত পেয়েছি। অধিকাংশ মতামতই হচ্ছে আমি যা বলতে চাচ্ছি অনেকে তা বুঝতে পারছে না। আমি বলতে চাচ্ছি তিতুমীর আমাদের নায়ক নন, তিতুমীর ব্রিটিশ-ভারতকে ব্রিটিশমুক্ত করতে চাননি। তিনি খ্রিস্টানমুক্ত করতে চেয়েছিলেন। তিনি এইখানে দারুল-ইসলাম কায়েম করতে চেয়েছিলেন। এখানে বহুত্ববাদী সমাজ কায়েমের কথা তিনি বলেন নাই।
ভিউজ বাংলাদেশ: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখালেখি করে অনেকে সেলিব্রেটি লেখক হয়ে যাচ্ছেন। তারা এসে বইমেলা দখল করছেন। কিন্তু সিরিয়াস সাহিত্যের সঙ্গে তাদের পরিচিতি নেই। এই ব্যাপারটা সিরিয়াস সাহিত্যের জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করেন কি না?
স্বকৃত নোমান: না, বইমেলা একটা মেলা। মেলা একটা উৎসব। মেলায় সবকিছুই থাকবে। অনেক রঙিন বৈচিত্র্যময় আয়োজন থাকবে; কিন্তু, পাঠক শেষ পর্যন্ত সিরিয়াস লেখার কাছেই ফিরে যাবে। যুগ যুগ ধরে সিরিয়াস সাহিত্যই টিকে থেকেছে।
ভিউজ বাংলাদেশ: কিন্তু সিরিয়াস সাহিত্য তো সেভাবে প্রচার পাচ্ছে না। তথাকথিত সেলিব্রেটি লেখকরা যেমন নিজেদের নানারকম প্রচার নিয়ে এগিয়ে আসছেন। সাধারণ পাঠক সিরিয়াস সাহিত্য সম্পর্কে তেমন খোঁজ-খবরও রাখে না। এ বিষয়টি কীভাবে দেখেন?
স্বকৃত নোমান: মেলায় দেখবেন মানুষ প্রথমে ভিড় করে যৌনশক্তিবর্ধক-ক্যানভাসারের কাছে, জাদুকরের কাছে। পরে কিন্তু তারা তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসটা কিনে বাড়ি ফিরে। মেলায় এই বৈচিত্র্য বন্ধ করা যায় না। কিন্তু, জাতিগত রুচি বলে একটা ব্যাপার আছে। আমাদের মুষ্টিমেয় পাঠকের রুচি নিম্নগামী বলেই তারা তথাকথিত ফেসবুক-সেলিব্রেটিদের পেছনে ঘুরে বেড়ায়। তা না-হলে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পেছনে ছুটতেন, প্রশান্ত মৃধার পেছনে ছুটতেন, টোকন ঠাকুরের পেছনে ছুটতেন। রুচির অধঃপতন ঘটেছে। তবে, লেখক সব সময় আশাবাদী মানুষ। আমি আশার কথা শুনাতে চাই। আমাদের জাতির প্রস্তুতিকাল হয়তো এখনো শেষ হয় নাই। প্রস্তুতিকাল শেষ হওয়ার পরেই রুচির জায়গায় ফিরে যাবে।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনি বাংলা একাডেমির একজন কর্মকর্তা; কিন্তু একজন লেখক হিসেবে মেলার এই আয়োজন কীভাবে দেখছেন। মেলার আয়োজনের অসঙ্গতি নিয়ে কিছু সমালোচনা হচ্ছে।
স্বকৃত নোমান: কী ধরনের সমালোচনা হচ্ছে?
ভিউজ বাংলাদেশ: লোকজন বলছে, মেলা খুব আঁটসাট, নোংরা।
স্বকৃত নোমান: বেশি খোলামেলা হলে মানুষ হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে যায়। বিশেষ করে যারা বয়ঃবৃদ্ধ। সবাই তো আর তরুণ নয়। ওই মাথা থেকে এই মাথায় আসতে আসতে হাঁপিয়ে যায়। তাই এবারের মেলা একটু আঁটসাট করা হয়েছে। আর মেলা তো মাত্র শুরু হলো, তাই অনেক কিছুই ঠিক মতো গুছানো হয়নি। আর কয়েকদিনের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে, মেলার আয়োজন আরও সুন্দর, পরিচ্ছন্ন করা যেত।
ভিউজ বাংলাদেশ: বাংলা একাডেমি পুরস্কার নিয়ে এখন প্রতি বছরই সমালোচনা হয়। এবার বেশি হলো। কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার এবার বাংলা একাডেমি পুরস্কার ফিরিয়েও দিলেন। একজন লেখক ও বাংলা একাডেমির কর্মকর্তা হিসেব আপনি কি এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবেন?
স্বকৃত নোমান: বাংলা একাডিমির কর্মকর্তা হিসেবে আমি মন্তব্য করব না। লেখক হিসেবে মন্তব্য করব। সমালোচনা তো ভালো। তাহলে বাংলা একাডেমি আরো সাবধান হবে। নিজেদের সংশোধন করতে পারবে। বাংলা একাডেমির পুরস্কার নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে তার মানে তো পুরস্কারটির গুরুত্ব আছে। এ নিয়ে সমালোচনা হতেই পারে; কিন্তু, ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়। কেউ কাউকে বলতে পারে না ওই লেখক ধান্ধাবাজ। ওর লেখা কিছু হয় না। সমালোচনাও হতে হতে গঠনমূলক।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনাকে ধন্যবাদ আমাদের সময় দেয়ার জন্য।
স্বকৃত নোমান: আপনাদেরও ধন্যবাদ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে