অপরাধ দমনের পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষাও জরুরি
গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে দেখা যাচ্ছে দেশে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বাড়ছে। আগে হয়তো বড় বড় অপরাধ হতো, যার অনেকই থেকে যেত লোকচক্ষুর আড়ালে; কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে সমানে দৃশ্যমান অপরাধের হার এত বাড়ছে যে সাধারণ মানুষও তা দিব্যচোখে দেখছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এমন উদ্বেগের কথা শোনা যায়। পুলিশের গত তিন মাসের অপরাধবিষয়ক পরিসংখ্যান তাদের উদ্বেগকে জোরালোভাবে সমর্থন করছে। এই পরিসংখ্যান অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশের জরুরি পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তাকেও তুলে ধরছে।
চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে সংঘটিত অপরাধের ঘটনায় করা মামলার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়- খুন, অপহরণ, ডাকাতি, ছিনতাইসহ ছয় ধরনের অপরাধ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়ে গেছে। যদিও গত বছরের এই সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে বর্তমান সময়ের বড় ধরনের পার্থক্য আছে। ফারাক আছে পুলিশের সামর্থ্যের জায়গায়ও।
গতকাল (২৬ এপ্রিল) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, সারা দেশের সব ধরনের অপরাধের তথ্য নথিভুক্ত করে পুলিশ সদর দপ্তর। ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শুধু হত্যার ঘটনায় চলতি বছরের জানুয়ারিতে মামলা হয়েছে ২৯৪টি, ফেব্রুয়ারিতে ৩০০টি এবং মার্চে ৩১৬টি। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চে সারা দেশে হত্যা মামলা নথিভুক্ত হয়েছে যথাক্রমে ২৩১, ২৪০ ও ২৩৯টি। গত বছরের মার্চের তুলনায় চলতি বছরের মার্চে হত্যা মামলা বেশি হয়েছে ৭৭টি। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে বেশি হয়েছে যথাক্রমে ৬৩ ও ৬০টি।
যদিও পুলিশের ভাষ্য, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত যারা মামলা করতে পারেননি, এমন বেশ কিছু ঘটনার মামলা নতুন করে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ কারণে সংখ্যা বেড়েছে। তারপরও সাধারণ মানুষও টের পাচ্ছেন সমাজে-রাষ্ট্রে অপরাধের সংখ্যাও যেমন বেড়েছে তেমনি অপরাধের ধরনও পাল্টেছে। চুরি-ছিনতাই-ডাকাতির নতুন নতুন ধরন আসছে। সম্প্রতি গণমাধ্যমে মব সৃষ্টি করে ছিনতাইয়ের ঘটনার খবর এসেছে। বছরের শুরুর দিকে অনেকে সন্ধ্যার পর ঢাকার রাস্তায় বেরোতে ভয় পেতেন অনেকে। এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে ঢাকায়; কিন্তু ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় চুরি-ডাকাতির ঘটনা লোকমুখে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই জানা যাচ্ছে।
দেশে অপরাধের সংখ্যা এমন আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণ খতিয়ে দেখতে হবে। এটা কি শুধু রাজনৈতিক পটপবির্তনের কারণে, না কি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অকার্যকরতার কারণে? না কি এর পেছনে মানুষের মূল্যবোধের অবক্ষয়ও আছে। এটা জানা কথা যে অর্থনৈতিক অনিরাপত্তা-অনিশ্চয়তাও অপরাধ বেড়ে যাওয়ার একটা কারণ। তারপরও বাংলাদেশের মানুষ কখনোই এতটা অপরাধপ্রবণ ছিল না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সমাজে-রাষ্ট্রে এক ভয়াবহ নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলা চলছে।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ ছিল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ। থানার স্বাভাবিক কার্যক্রম ও পুলিশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার সুযোগ নেয় দুর্বৃত্তরা। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ে জনমনে উৎকণ্ঠা দেখা দেয়; কিন্তু সরকারের আট মাস পার হয়েছে। এখন অপরাধের যে চিত্র, তাকে উদ্বেগজনক বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, পুলিশকে এখনই অপরাধ দমনের কৌশল ঠিক করতে হবে। তা না হলে সমাজে অপরাধজনিত অস্থিরতা তৈরি হবে।
অপরাধ দমনের কৌশলের সঙ্গে সঙ্গে সমাজে-রাষ্ট্রে নৈতিক মূল্যবোধ বৃদ্ধিও জরুরি। প্রকৃত শিক্ষা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছাড়া এটা হয় না। আমাদের প্রত্যাশা দেশের নৈতিক শিক্ষায় সংশ্লিষ্টরা আরও বেশি গুরুত্ব দেবে। পাশাপাশি সমাজে-রাষ্ট্রে সুষ্ঠু-সুন্দর-স্বচ্ছ জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে