বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিতে কমাবে মামলার চাপ
আদালতের পাশাপাশি দুপক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ মীমাংসার প্রচলন আদিম যুগ থেকেই বিদ্যমান। তা ছাড়া আদালত ও মামলা-সংক্রান্ত জটিলতার কারণে আদালতকেন্দ্রিক বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হয়ে থাকে। এ কারণে সবাই উপলব্ধি করতে শুরু করে যে বিকল্প পন্থায় বিরোধ নিষ্পত্তি করাই সবচেয়ে সহজতর ও শ্রেয় পদ্ধতি।
পারস্পরিক সমঝোতায় একটি জটিল সমস্যাও সহজে সমাধান করা যায়। মূলত, আইনসিদ্ধ পদ্ধতি মেনে ও সহমত পোষণ করে আদালত বা সাধারণ আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে বিকল্পভাবে পক্ষগণের বিরোধ বা সমস্যার নিষ্পত্তিকরণই বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি, যাকে ইংরেজিতে Alternative Dispute Resolution (ADR) বলা হয়। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিকে ‘রেস্টোরেটিভ জাস্টিস’-এর সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে, যেখানে পক্ষগণকে পরস্পরের সম্মুখে বসিয়ে ঘটনার আর্থসামাজিক ও মানসিক কারণ খোঁজা হয়।
একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত কী প্রতিকার চায়, তার ওপর গুরুত্বারোপ করা এবং ভবিষ্যতে যেন অপরাধ সংঘটিত না হয়, সেদিকে নজর রাখা। সার্বিক দিক বিবেচনায়, একটি বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তিকল্পে এ পদ্ধতি জনগণের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বা এডিআর এমন একটা পদ্ধতি, যার মাধ্যমে স্বল্প সময়ে ও স্বল্প ব্যয়ে মধ্যস্থতাকারীর উপস্থিতিতে আদালতের ভেতরে বা বাইরে বসে বিরোধ নিষ্পত্তি করা হয়। তবে যদি কোনো মামলা এডিআরের মাধ্যমে নিষ্পত্তি না হয়, তাহলে মামলাটি আদালতে চলে যায়।
সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় সর্বশেষ ২০২১ সালে ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৬৬৭টি মামলার বিপরীতে নিষ্পত্তি হয়েছে ৪ লাখ ৬৬ হাজার ৬৫টি মামলা। অথচ ছয় বছর আগে ২০১৩ আদালতে এডিআরের বিধান আনার আগে মামলা দায়ের ও নিষ্পত্তির পার্থক্য ছিল ১ লাখেরও বেশি। এই পার্থক্য কমে আসার পেছনে বিচার ব্যবস্থায় বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার মধ্যে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির বিধান আনা অন্যতম। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মূল লক্ষ্য মামলায় জটিলতা এবং দীর্ঘসূত্রতা পরিহার করা। আমাদের দেশে তিন ধরনের বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা আছে, যার মধ্যে রয়েছে:
১. আলাপ-আলোচনা বা নেগোসিয়েশন: উক্ত পদ্ধতিতে পক্ষগণ কারও সাহায্য ছাড়াই নিজেরা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় উপনীত হয়।
২. মধ্যস্থতা বা মিডিয়েশন: এ পদ্ধতিতে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি মধ্যস্থতাকারী নিযুক্ত হন এবং কোনো ধরনের জোরারোপ বা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া ব্যতীত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দুপক্ষকে একটি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করেন।
৩. সালিশ বা আরবিট্রেশন: এ প্রক্রিয়াটির ধরন মধ্যস্থতার মতো হলেও কিছুটা নিয়মনিষ্ঠাভাবে সম্পাদিত হয়, যেখানে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে আদালত বা কোনো আরবিট্রেশন বডি থাকে, যেখানে পক্ষগণকে সমঝোতায় এনে সমাধান প্রণয়ন করা হয়।
বিরোধ অথবা দ্বন্দ্ব মানবিক ও সামাজিক সম্পর্কের একটি স্বাভাবিক ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। সমাজের সর্বস্তরে অর্থাৎ ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিরোধের সূত্রপাত ঘটে। এক কথায় বিরোধ অথবা দ্বন্দ্ব বলতে আমরা দুই বা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যে ভিন্ন মত অথবা স্বার্থগত দ্বন্দ্ব বুঝি। বিরোধ বা দ্বন্দ্বের পক্ষগুলো বিশ্বাস করে তাদের উদ্দেশ্য অসংগতিপূর্ণ এবং এখানে তাদের ইচ্ছা থাকে একজন আরেকজনের ওপর সুবিধা নেওয়া, জয়লাভ করা অথবা পরাজিত করা।
বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি একটি পরিভাষা, যা আদালতের আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে বিরোধ বা দ্বন্দ্ব সমাধানের বিভিন্ন পদ্ধতি বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। যেহেতু আদালতে মামলার চাপ দ্রুতগতিতে বাড়ছে, সে ক্ষেত্রে আইন ও সামাজিক অঙ্গনের এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের স্টেকহোল্ডারের জন্য এখন বিকল্পভাবে মামলা অথবা বিরোধ নিষ্পত্তি করার কোনো পন্থা ব্যবহার করা অতি আবশ্যক। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মামলার জট কমাতে হলে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির কোনো বিকল্প নেই। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির জনপ্রিয়তা বাংলাদেশে আগের চেয়ে কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০০৯ সাল থেকেই সরকার বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের নাগালে ন্যায় বিচার পৌঁছে দিতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। দেওয়ানি আদালতের মামলা বিভিন্ন পর্যায়ে এডিআরের বিধান আবশ্যিক রাখা হয়েছে। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির সুবিধা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের। তবে আইনজ্ঞদের অভিমত, বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান মামলার জট কমাতে, সাধারণ মানুষের ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে দেওয়ানি মামলার পাশাপাশি ফৌজদারি মামলায়ও এডিআর প্রচলন করা উচিত। তাদের মতে, বিচারে দীর্ঘসূত্রতা, ব্যয়বহুলতা ও জটিলতা নিরসনে এডিআর অনেক বেশি ফলপ্রসূ।
গত বছর জাতীয় আইন সহায়তা দিবসের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ফৌজদারি মামলায় বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বা এডিআর প্রচলনের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেছিলেন, ‘আমরা চাই প্রতিটি মানুষ ন্যায় বিচার পাক এবং সেই ব্যবস্থাটা যেন চালু হয়। অনেক মামলার দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে। আমার মনে হয়, আইন মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।’ দীর্ঘ দুইশ’ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনামলের ব্রিটিশ আইনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে আমাদের আইন ব্যবস্থা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সে ব্যবস্থা থেকে আমরা এখনো বের হয়ে আসতে পারিনি। ফলে বিচার ব্যবস্থায় আমলাতান্ত্রিকতার পাশাপাশি দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে।
মানুষ গাঁটের পয়সা খরচ করে আদালতে আসেন বিচারের আশায়; কিন্তু দিনের পর দিন, মাসের পর মাস পার হয়ে গেলেও মামলার নিষ্পত্তি হয় না। এভাবে দেশে বর্তমানে ৪০ লাখ মামলার জট সৃষ্টি হয়েছে। মামলার একটি তারিখ উৎকোচ দেওয়া যেন নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে। এর পরেও নির্ধারিত তারিখে বিচার প্রার্থীরা সাক্ষী নিয়ে এসে দেখেন যে, বিচারক নেই। এক্ষেত্রে বিচারপ্রার্থী ও অভিযুক্তরা বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিতে নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করতে পারেন। এর মধ্য দিয়ে আইন ও বিচার ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা ফিরে আসবে।
বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বলতে বিভিন্ন পদ্ধতির সমন্বয় বা সমষ্টিকে বোঝায়, যেগুলো দ্বন্দ্ব বা বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্দেশ্যে সৃষ্ট। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির কোনো সর্বজনীন সংজ্ঞা নেই। বাংলাদেশ এখন একটি উন্নয়নশীল দেশ এবং অর্থনৈতিকভাবে ক্রমোন্নতি করে যাচ্ছে। এ কারণে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ এবং এ দেশের নাগরিক বিভিন্ন ধরনের বিরোধে জড়িয়ে পড়ছে। সে ক্ষেত্রে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ক্রমবর্ধমান চাহিদা লক্ষণীয়। বিশেষত উন্নত দেশগুলোতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবহার বহুল প্রচলিত এবং বলা হয়ে থাকে যে একটি দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত করতে হলে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
Black’s Law Dictionary (9th ed. 2009) অনুযায়ী, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির সংজ্ঞা হচ্ছে মামলা ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে একটি বিতর্ক বা বিরোধের সমাধান করার পদ্ধতি, যেমন সালিশি বা মধ্যস্থতা। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি হচ্ছে একটি অনানুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে বিরোধীয় পক্ষগুলো একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তির শরণাপন্ন হয়, যিনি বিরোধ সমাধানে সহায়তা করবেন। এ প্রক্রিয়াটি আইনি প্রক্রিয়ার তুলনায় বেশ কিছু সুবিধা দেয় এবং তুলনামূলকভাবে কম ব্যয়বহুল। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া বিরোধীয় পক্ষগুলোকে ব্যক্তিগতভাবে এবং কার্যকরভাবে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেয়, যেটি আদালতের আইনি লড়াইয়ে সম্ভব নয়। পুরো পদ্ধতির ওপর পক্ষগুলোর ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ থাকে।
নিরপেক্ষ ব্যক্তি নির্ধারণ ও প্রক্রিয়ার সময়সীমাসহ সব কিছুই পক্ষগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকে। এসবই তাদের একটি স্বাচ্ছন্দ্যকর অবস্থা ও পরিবেশ দেয় মামলা নিষ্পত্তির জন্য। এগুলো ছাড়াও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি আইনি বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সহযোগিতামূলক আচরণ উৎসাহী করে। পক্ষগুলোর মধ্যে একে অপরের বিরুদ্ধে অসৎ উদ্দেশ্য পোষণ করার আশঙ্কা কম থাকে এবং পক্ষগুলো এ প্রক্রিয়ার ফলাফল দ্বারা অসন্তুষ্ট হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে।
লেখক: সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে