Views Bangladesh Logo

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনী, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার অপরিহার্য পদক্ষেপ

বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারজনিত সমস্যার ভয়াবহতা দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের তামাক ব্যবহারের হার সর্বোচ্চ (৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ)। ধূমপান না করেও প্রায় ৪ কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন, যা তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। প্রতি বছর তামাকজনিত রোগে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ অকালে প্রাণ হারাচ্ছেন। পাশাপাশি তামাকজনিত রোগের চিকিৎসা এবং উৎপাদনশীলতার ক্ষতির কারণে দেশের অর্থনীতিতে প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকার বোঝা তৈরি হচ্ছে, যা তামাক খাত থেকে অর্জিত রাজস্বের তুলনায় প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা বেশি।

তামাকজনিত রোগে অকাল মৃত্যু এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি প্রতিরোধে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে আরও শক্তিশালী করা অত্যন্ত জরুরি। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে, যা ডব্লিউএইচওর ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোলের (এফসিটিসি) সঙ্গে অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ।

প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলো হলো- পাবলিক প্লেসে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান বিলুপ্ত করা, তামাক পণ্যের প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা, ই-সিগারেটের আমদানি, উৎপাদন, ব্যবহার ও বাজারজাত নিষিদ্ধ করা, তামাক কোম্পানির যে কোনো ধরনের সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) কর্মসূচি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা, বিড়ি-সিগারেটের খুচরা শলাকা, মোড়কহীন ও খোলা ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি নিষিদ্ধ করা এবং সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তার আকার ৫০ দশমিক থেকে ৯০ শতাংশ বাড়ানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত। এই সংশোধনীগুলো দ্রুত পাস হলে আমরা তরুণ প্রজন্মকে তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষার পাশাপাশি তাদের জন্য একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত হবে।

তবে তামাক কোম্পানিগুলো এই সংশোধনী নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তারা দাবি করছে, আইন শক্তিশালী হলে রাজস্ব হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। অথচ বাস্তবতা হলো, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন (২০০৫) এবং সংশোধন (২০১৩) করার পর সিগারেট থেকে রাজস্ব আয় বেড়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করার পরেও গত ১৮ বছরে তামাক খাত থেকে রাজস্ব আয় সাড়ে ১২ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

তামাক কোম্পানির আরেকটি মিথ্যা দাবি হলো, আইন সংশোধন করলে ৬০ লাখ মানুষের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো শ্রমশক্তি জরিপ এর তথ্য অনুযায়ী, তামাক শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যা মাত্র ১ লাখ ৩২ হাজার যা মোট কর্মে নিয়োজিত নাগরিকের সংখ্যার মাত্র শূন্য দশমিক ২ শতাংশ। আর প্রতি বছর কেবল আনুষ্ঠানিক খাতেই বাংলাদেশে ২ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। কাজেই সিগারেটে কার্যকর করারোপের ফলে কর্মসংস্থানে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কাটি পুরোপুরি অমূলক।

এ ছাড়া, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের ফলে অবৈধ তামাকজাত দ্রব্যের বাণিজ্য বাড়বে বলে যে প্রচারণা চালানো হচ্ছে, তা বাস্তবসম্মত নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে অবৈধ তামাকজাত বাণিজ্যের হার ৫ শতাংশের কম। অস্ট্রেলিয়া এবং অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে প্রমাণিত, কঠোর আইন প্রণয়ন এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব।

জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি, প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাই তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন দ্রুত পাস করা অতি জরুরি। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে তামাক মুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার ভিশন বাস্তবায়নে বাধাগ্রস্ত হবে এবং তামাকজনিত দুর্ভোগ চলতেই থাকবে।

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন কেবল জনস্বাস্থ্যের জন্য নয়, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্যও অপরিহার্য। তাই তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য সরকারের প্রতি আমার আহ্বান, দ্রুত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করুন। সুস্থ-সবল জাতি গড়ুন।

লেখক : সদস্য, তামাকবিরোধী মায়েদের ফোরাম এবং চেয়ারপারসন, আয়শা সার্ভিস লিমিটেড-বিপিও (এএসএল-বিপিও)।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ