আমেরিকার স্বার্থ রক্ষার গণতন্ত্র বনাম শেখ হাসিনা
আমাদের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত একটি নিবন্ধের শিরোনাম ছিল, ‘বাইডেনের গণতন্ত্র উন্নয়নের সীমাবদ্ধতা তুলে ধরল বাংলাদেশ’। নিবন্ধের মূল বক্তব্য হচ্ছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বিজয় হবে এবং এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতি বাংলাদেশে পরাজিত হবে। জানুয়ারির ৭ তারিখে নির্বাচন হয়েছে, এই নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে ৩ তারিখে।
এই নিবন্ধে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, টানা চারবার বিজয়ী হয়েছেন শেখ হাসিনা এবং এবারের নির্বাচনে পরাজিত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে, কারণ শেখ হাসিনাকে চাপে রাখার জো বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতি ফলপ্রসূ হয়নি। নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, বাইডেন প্রশাসন শেখ হাসিনার সরকারকে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণগ্রেপ্তারের অভিযোগে অভিযুক্ত করে শাস্তি দেয়ার চেষ্টা করেছে; কিন্তু শেখ হাসিনা আমেরিকার ভয়ে ভীত হননি। জার্নালের অভিমত হচ্ছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সঙ্গে নিজেদের পার্থক্য দেখাতে জো বাইডেন শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বন্দ্বে নেমেছেন। বিগত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার বিভিন্ন অর্জন ও সাফল্যও তুলে ধরা হয়েছে এই জার্নালে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মতে, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাস অনেক উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় বেশি উজ্জ্বল। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের পূর্বোক্ত নিবন্ধে শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বের প্রশংসা করে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তার শাসনামলে বাংলাদেশে এমন কতগুলো অর্জন হয়েছে, যা অনেক উন্নয়নশীল দেশে হয়নি।
জার্নালের ভাষ্য অনুযায়ী, শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রতার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়েছে, অতীতের মতো বিগত পনেরো বছরে সামরিক শাসন কায়েম হয়নি, সামরিক শক্তির ওপর জনগণের শাসনের আধিপত্য নিশ্চিত হয়েছে, চরম দরিদ্র্য থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করে আনা সম্ভব হয়েছে এবং নাশকতার বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার সরকার কঠোর অবস্থানে ছিল। বাইডেন সরকারের অভিযোগ হচ্ছে, শেখ হাসিনা বিরোধী দলের উপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল তাদের আরেকটি বক্তব্যের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে এই অভিযোগ থেকে মুক্তি দিয়েছে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। নির্বাচনের আগে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল আওয়ামী লীগের জয় নিয়ে যে পূর্বাভাস দিয়েছে, তাতে কোনো বিচক্ষণতা ছিল না, এমন পূর্বাভাস দেয়ার জন্য কষ্টসহিষ্ণু কোনো গবেষণার দরকার পড়েনি।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশগ্রহণ না করায় ভোটের মাঠে প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীই ছিল না। জাতীয় পার্টি দিন দিন ক্ষয় হচ্ছে, এরশাদ সাহেবের মৃত্যুর পর পার্টির নেতৃত্ব নিয়ে রেষারেষি দলটিকে অস্তিত্বহীন করে তুলেছে। এরশাদ সাহেবের মতো বর্তমান নেতৃত্বও গৃহীত সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারে না, সিদ্ধান্তের সকাল-বিকাল পরিবর্তন হয়। এই দলটি বর্তমানে আঞ্চলিক দলে পর্যবসিত হয়েছে, পেয়েছে মাত্র ১১টি আসন, আওয়ামী লীগ ২৬টি আসন ছেড়ে না দিলে জাতীয় পার্টির আসনসংখ্যা আরও কম হতো। নির্বাচনকালীন তাদের বহু দলীয় প্রার্থী ঘোষণা দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে গেছেন, সরে যাওয়ার প্রধান কারণ জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক দুর্বলতা। সারা দেশে প্রার্থী দিয়ে নির্বাচন করার ক্ষমতা আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি ছাড়া আর কোনো দলের নেই। সত্যিকার অর্থে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রার্থীর ভোটযুদ্ধ হয়েছে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের কথিত উন্নয়ন নিয়ে দ্বিমত করার অবকাশ নেই; বিগত পনেরো বছরে বাংলাদেশে প্রভূত উন্নয়ন হয়েছে। অবশ্য সব সরকারের আমলেই উন্নয়ন হয়েছে, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা না থাকলে শেখ হাসিনার আমলের উন্নয়নে এত বড় উল্লফন চোখে পড়ত না। শেখ হাসিনার আমলের উন্নয়ন নিয়ে বিরোধী দলের ভিন্ন মত আছে; ভিন্ন মত থাকা স্বাভাবিক, কারণ আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন বিনা বাক্যে স্বীকার করে নিলে বিরোধী দলের রাজনীতি থাকে না।
বিরোধী দলের অভিযোগ উন্নয়ন নিয়ে নয়, তাদের অভিযোগ মেগা প্রকল্পে মেগা দুর্নীতি নিয়ে। মেঘা প্রকল্পের মধ্যে একটি হচ্ছে পদ্মা সেতু। বরাদ্দ ঋণের একটি টাকাও না দিয়ে পদ্মা সেতুর দুর্নীতি নিয়ে অভিযোগ তুলেছিল বিশ্ব ব্যাংক, অথচ তখনো পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ শুরুই হয়নি। তাই বলে আওয়ামী লীগ আমলে দুর্নীতি হয়নি, তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না; তবে দুর্নীতি নিয়ে বিরোধী দল থেকে যা বলা হচ্ছে, তা শুধু রাজনীতি। আওয়ামী লীগ সরকারের সফলতা হচ্ছে, দুর্নীতি হলেও কোনো মেগা প্রকল্প মাঝপথে থেমে যায়নি, জনগণ মেগা প্রকল্প থেকে মেগা বেনিফিট পাচ্ছে। মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে মেট্রোরেল। অনেক মেগা বিদ্যুৎ প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন হয়েছে, ১ লাখ কোটি টাকার পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পেও উৎপাদন শুরু হয়েছে, রেলগাড়ি করে কক্সবাজারগামী পর্যটকদের ভিড় থামছে না, কর্ণফুলী নদীর তলদেশের সুড়ঙ্গ পথের ভ্রমণ জনগণের মধ্যে নতুন আমেজ তৈরি করেছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়ন নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটিয়েছে, এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করে দ্রুততম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে। সারা দেশে শুধু অবকাঠামোর চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন হয়নি, সহায় সম্বলহীন গরিব ও নিঃস্বদের বাঁচিয়ে রাখার সামাজিক সুরক্ষা খাতে বিগত পনেরো বছরে লাখ লাখ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
করোনা এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ব্যাপক নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে সৃষ্ট বিশ্ব মন্দায় বিরোধী দল উৎফুল্ল ছিল; তাদের ধারণা ছিল দেশ দেউলিয়া হয়ে যাবে, দুর্ভিক্ষে কোটি কোটি লোক মারা যাবে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনে আওয়ামী লীগের করুণ পরিণতি হবে, গণআন্দোলন তাদের ক্ষমতায় বসাবে। আন্দোলনের শেষের দিকে বিরোধী দলের নেতাদের মুখে হাসি লেগে থাকত, এই বুঝি হাসিনা সরকারের পতন হলো। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভোটারের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল না সত্য; কিন্তু তারা বিরোধী দলের ডাকে রাস্তায়ও নামেনি। ভোটের দিন এক আড্ডায় একজন ভোটারকে বলতে শুনলাম, বিএনপি যেভাবে দেশের মন্দা অবস্থার বর্ণনা দিচ্ছে, তাতে মনে হয় দেশ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, আওয়ামী লীগ সরকার সব সম্পদ লুটপাট করে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে, এ অবস্থায় বিএনপি ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগ সরকারের নিন্দা করতে করতে পাঁচটি বছর কাটিয়ে দেবে, তাই বিএনপিকে ক্ষমতায় না আনাই শ্রেয় হবে। এই ভোটার নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থক।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের অভিমত অনুযায়ী রাশিয়া, চীন ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সব চাপের সমুচিত জবাব দিয়েছেন শেখ হাসিনা। জার্নালের এই বক্তব্যটি আংশিক সত্য, শেখ হাসিনার সরকার যত রেটরিক শব্দ উচ্চারণ করুক না কেন, আমেরিকাকে অবহেলা করার সাহস এবং ক্ষমতা কোনোটাই তাদের নেই। আমেরিকা এবং ইউরোপে ৩২ বিলিয়ন ডলারের বস্ত্র রপ্তানির বাজার নষ্ট করার ঝুঁকি নেওয়ার সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই, যে তিনটি দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ঘটানো হয়েছে তার মধ্যে চীন এবং ভারত বস্ত্র রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী। জার্নালের বক্তব্য মোতাবেক আমেরিকাকে শেখ হাসিনার ‘বৃদ্ধাঙ্গুল’ দেখানোর ঘটনা সত্য নয়, যদি সত্য হতো, তাহলে রাশিয়ার জাহাজ বাংলাদেশ প্রত্যাখ্যান করত না; মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থাকায় রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের পণ্য নিয়ে আসা রাশিয়ার জাহাজ ‘উরসা মেজর’কে বাংলাদেশের সীমানায় ঢুকতে দেয়া হয়নি। আমেরিকা এবং ইউরোপকে অগ্রাহ্য করার মতো অর্থনৈতিক অবস্থা বাংলাদেশের নেই, কারণ ১৯৭৪ সনের দুর্বিষহ দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়েছিল আমেরিকার হাত ধরেই।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মতে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, অথচ একই সম্মেলনে এমন অনেক দেশকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, যাদের রেকর্ড বাংলাদেশের চেয়েও অনেক বেশি খারাপ। গণতান্ত্রিক সম্মলনে আমেরিকা দাওয়াত দিয়েছিল পাকিস্তান, ভিয়েতনাম ইত্যাদি দেশকে; পাকিস্তানে চলে সামরিক গণতন্ত্র, ভিয়েতনাম হল একটি সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র যেখানে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে একদলীয় ব্যবস্থা রয়েছে। আমেরিকার ডেমোক্রেসি সামিটে গণতান্ত্রিক সূচকে ১০৭তম অবস্থানে থেকে পাকিস্তান আমন্ত্রণ পেলেও ৭৩তম স্থানের বাংলাদেশ আমন্ত্রণ পায়নি। আমেরিকার গণতন্ত্র আসলে নিজের স্বার্থ রক্ষার গণতন্ত্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মূলত চীন ও রাশিয়ার বিপরীতে নিজেদের নতুন বলয় তৈরি করার লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক সম্মেলন করে থাকে। গণতান্ত্রিক সূচকে আমেরিকার অবস্থান ৩০, অর্থাৎ ২৯টি দেশের গণতান্ত্রিক অবস্থা আমেরিকার চেয়ে ভালো। শুধু ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রশংসা শুনে বুঁদ হয়ে থাকলে শেখ হাসিনার মঙ্গল হবে না, বিরোধী মতগুলোও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে। ওয়াল স্ট্রিট জার্লাল যেখানে বিরোধী দলের ওপর সরকারের নির্যাতন স্বীকার করেনি সেখানে জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ফলকার টুর্কের মতে, ভোট শুরুর আগের কয়েক মাস হাজার হাজার বিরোধী সমর্থককে নির্বিচারে আটক করা হয়েছে। তিনি অবশ্য বিরোধী দলের বিরুদ্ধেও অগ্নিসংযোগসহ রাজনৈতিক সহিংসতামূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ পাওয়ার কথাও উল্লেখ করেছেন।
সর্বশেষে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে তিনি বাংলাদেশ সরকারের কাছে এই উন্নয়ন রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হবে মর্মে প্রত্যাশা করেছেন। বিচার বিভাগ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়েছে মর্মে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের বক্তব্যের বিপরীত বক্তব্য দিয়েছে ভারতের নিউজ পোর্টাল ‘ওয়্যার’; ওয়্যার বলছে, অনবচ্ছিন্নভাবে বিশ্বাসযোগ্য বিরোধী হল, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা ও গণমাধ্যমের অনুপস্থিতির কারণে দেশে অর্থনৈতিক অগ্রগতির পুনরুজ্জীবন সম্ভব হবে না। তাই ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রশংসা শেখ হাসিনার নতুন যুদ্ধে সাহস ও অনুপ্রেরণা জোগাবে সত্য; কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আমেরিকা ও ব্রিটেনের নেতিবাচক মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন করে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তাকে আরও সতর্ক ও কৌশলী হতে হবে।
লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে