দেশে চালের সংকট নেই, তবুও কেন বাড়ছে চালের দাম!
বেশ কিছুদিন ধরে চালের বাজার অস্থির। জাতীয় নির্বাচনের আগে দাম কিছুটা কমেছিল। নির্বাচনের পর আবার বাড়ছে চালের দাম। বর্তমানে মোটা জাতের স্বর্ণা ও চায়না প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫৪ থেকে ৫৬ টাকা। মাঝারি ব্রিধান ২৯ বিক্রি হচ্ছে ৫৮ থেকে ৬০ টাকা। মিনিকেট নামে পরিচিত সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। সরু নাজিরশাইল বাজারভেদে বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা। কাটারিভোগ ও অন্যান্য সুগন্ধি চালের দাম আরও বেশি। আমন ধানের ভরা মৌসুমে এ মূল্য অস্বাভাবিক। ব্যবসায়ীরা অন্যায্য মুনাফা অর্জন করছে ভোক্তাদের কাছ থেকে। তাতে কষ্ট পাচ্ছে গরিব খেটে খাওয়া মানুষ। এবার চালের উৎপাদন খরচ প্রতি কেজি ৪৩ টাকা। এর সঙ্গে ১৫ শতাংশ বাজারজাতকরণে করচ ও মুনাফা যোগ করা হলে ভোক্তা পর্যায়ে মোটা চালের দাম হয় প্রতি কেজি ৫০ টাকা। মানভেদে চালের মূল্য সর্বোচ্চ হতে পারে ৭০ টাকা; কিন্তু বর্তমানে আমন চালের পূর্ণ মৌসুমে বাজারে যে দামে চাল বেচা-কেনা হচ্ছে, তা অযৌক্তিক।
অনেকে মনে করেন, এটা ব্যবসায়ীদের কারসাজি। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি তার দলীয় একটি বৈঠকে বলেছেন, দুরভিসন্ধিমূলকভাবে চালসহ নিত্যপণ্য মজুদ করলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়ে জেলে পাঠিয়ে দেয়া হবে। এর আগে অর্থমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী এবং খাদ্যমন্ত্রী এ বিষয়ে মজুতদারদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা করেছেন। ইতোমধ্যে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ দপ্তরসহ খাদ্য বিভাগ, জেলা প্রশাসন এবং সরকারি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে ক্রমাগত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। তাতে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজির মূল্য ২-৩ টাকা শিথিল হলেও খুচরা পর্যায়ে তার কোনো প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এখনো দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অবৈধভাবে বিশাল গোডাউন ভর্তি করে হাজার হাজার বস্তা ধান মজুত করে রাখার খবর পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে। এতে করপোরেট হাউসগুলোর আধিপত্য সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া বড় অটো রাইস মিলাররাও তাদের আধিপত্য ধরে রেখেছে। তাদের সঙ্গে যুক্ত আছে মাঝারি ও ছোট মিল মালিকরা। তাদের দৌরাত্ম্য ও কারসাজিতেই এভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে চালের দাম।
এবার দেশে চালের কোনো সংকট নেই। সরকারি পর্যায়ে চালের মজুদ আছে প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ টন। গমসহ মোট খাদ্য শস্য আছে প্রায় ১৭ লাখ টন। আমন চাল সংগ্রহ করা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টন। ধান সংগ্রহ করা হয়েছে মাত্র ১৯ হাজার ২৯৭ টন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় সরকার চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ৫ লাখ টন অর্জন করতে পারবে। কিন্তু ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারবে না। এর আগেও কখনো ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। এবার ২ লাখ টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা সিকিভাগও পূরণ হবে বলে মনে হয় না। কারণ ধান তোলার সঙ্গে সঙ্গেই কৃষকরা ধান বিক্রি করে দিয়েছে চাতালের মালিক ও বড় করপোরেট হাউসের প্রতিনিধিদের কাছে। ৩০ টাকা কেজি দরে শুকনো ধান সরকারি গুদামে গিয়ে দিয়ে আসার মতো সুযোগ তাদের আর তেমন নেই। এখন বাজারজাত উদ্বৃত্ত ধান সবই বড় ব্যবসায়ী ও চাতালের মালিকদের হাতে কুক্ষিগত। এরাই সরকারকে চাল সরবরাহ করছে। বাজারে চাল পাঠাচ্ছে। এরাই নিয়ন্ত্রণ করছে বাজার। মূল্য নির্ধারণ করছে এরাই। মূল্য বৃদ্ধির কারসাজিও করছে তারাই।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা বেশি দামে ধান কিনেছেন, তাই চালের দাম পড়ছে বেশি। প্রকৃত প্রস্তাবে, বড় মিলাররা ধান কিনে নিয়েছে উৎপাদনের পর পরই। তখন ভেজা ধান প্রতি মণ বিক্রি হয় ৯শ থেকে ১১শ টাকা দামে। সরকার নির্ধারিত ১২শ টাকা দর কখনোই কৃষকদের দেয় না ব্যবসায়ীরা। পরে যখন ময়ালে ধানের দাম বাড়ে তখন কৃষকদের হাতে বিক্রির মতো উদ্বৃত্ত থাকে না। অল্প করে শুকনো ধান তখন বিক্রি হয় বেশি দামে। ক্ষেত্র বিশেষে সরু ধান ১৩-১৪শ টাকা মণ দরেও বিক্রি হতে দেখা যায়। মোট বিক্রি করা ধানের মধ্যে এর হিস্যা খুবই নগণ্য, কিঞ্চিতকর। তাই চালের বেশি দামের সুবিধার ভাগীদার কৃষক হয় না। এর ফায়দা লোটে অসাধু ব্যবসায়ীরা। অর্থাৎ গুড়ের লাভ সবই পিঁপড়ে খায়। এবার দেশে আমনের উৎপাদন ভালো হয়েছে। দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে পরপর ঘূর্ণিঝড় ও টানা বৃষ্টির কারণে আমন ধানের কিছুটা ক্ষতি হলেও দেশের উত্তরাঞ্চলে ও মধ্যাঞ্চলে বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলে এ মৌসুমে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১ কোটি ৭০ লাখ টন অর্জন করা সম্ভব না হলেও কমপক্ষে দেড় কোটি টন হবেই। এটা আমাদের বার্ষিক খোরাকির অর্ধেক। আগামী এপ্রিল মাস পর্যন্ত অর্থাৎ বোরো ধানের মৌসুম পর্যন্ত তাতে অনায়াসেই চলবে। অতএব, দেশে চালের কোনো সরবরাহে সংকট নেই। এর দুর্মূল্য ব্যবসায়ীদের সৃষ্ট।
তাদের লাগাম টেনে ধরতে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছে সরকার; কিন্তু সুফল মিলছে না। কারণ রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ীদের অনৈতিক জোট ভাঙা যাচ্ছে না। এক হিসাবে দেখা যায়, বর্তমান সংসদের ৬৭ শতাংশ সদস্য ব্যবসায়ী। চালসহ নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে নিয়ে আসার জন্য তারা তাদের শ্রেণি স্বার্থ বিসর্জন দিতে চাইবেন কি? নির্বাচনের আগে নিত্যপণ্যের দাম কমিয়ে রাখা তাদের জন্য ছিল খুবই প্রয়োজন। এখন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ তাদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে এ দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ শতাংশের ওপরে। এখন তা নেমে এসেছে সাড়ে ৯ শতাংশে। পর্যাপ্ত উৎপাদন না হওয়া, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, মুদ্রামান হ্রাস, বিদেশি মুদ্রা সংকটের কারণে অপ্রতুল আমদানি, অতিরিক্ত শুল্ক হার এবং বৈশ্বিক উচ্চ মূল্য আমাদের দেশে উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতির প্রধান কারণ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্বৃত্তায়ন। শুধু চালের ক্ষেত্রেই নয়, পেঁয়াজ, আলু, ভোজ্যতেল ও চিনির ক্ষেত্রেও এই দুর্বৃত্তায়নের সন্ধান আমরা পেয়েছি। এতে কলকাঠি নাড়ছে আমাদের ব্যবসায়ীরা। এখনই তাদের লাগাম টেনে ধরা দরকার। বর্তমানে নতুন সরকার ক্ষমতায় বসেছে। অপ্রীতিকর শক্ত অবস্থানে থেকে জনস্বার্থের কাজগুলো করে নেয়ার এখনই সময়।
চালের মূল্য স্বাভাবিক পর্যায়ে রাখার প্রধান উপায় ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি। সামনে বোরো ধানের মৌসুম। এদেশে শতকরা ৫৪ ভাগ চাল সরবরাহ হয় বোরো ধানের উৎপাদন থেকে। সাম্প্রতিক দীর্ঘ শৈত্যপ্রবাহ, ঘন কুয়াশা এবং গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির কারণে বোরোর চারা উৎপাদন ও রোপণের কাজ কিছুটা বিঘ্নিত হচ্ছে। তথাপি বোরো মৌসুম মোটামুটি নিরাপদ। তবে এ ধান সেচনির্ভর। রাসায়নিক সারের প্রতি সংবেদনশীল। এ দুটি উপকরণের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। গ্যাসের সংকট হেতু চট্টগ্রামের সার কারখানাগুলোর উৎপাদন বিঘ্নিত হচ্ছে। সেখানে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করা দরকার। জ্বালানি তেলের দাম এখনো বেশি। পানি সেচের প্রায় ৬৫ শতাংশ নির্ভরতা জ্বালানি তেলের ওপর। এখানে ভর্তুকি দেয়া দরকার। এখানে আচ্ছাদিত ভর্তুকি সম্ভব নয় বিধায় কৃষকদের নগদ সহায়তা দেয়া প্রয়োজন।
অনেকে মনে করছেন, চালের উচ্চ মূল্য ঠেকাতে আমদানি করা উচিত। চলতি অর্থবছরে এ নাগাদ পণ্যটি আমদানি করা হয়নি। গত বছর চাল আমদানি হয়েছিল প্রায় সাড়ে ১০ লাখ টন। আগের বছরও ১০ লাখ টন চাল আমদানি করা হয়েছিল। এবারও আমদানি করা প্রয়োজন হতে পারে ১০ লাখ টন। অভ্যন্তরীণ মজুদ বৃদ্ধির জন্য তা খুবই দরকার। কমপক্ষে ২৫ লাখ টন মজুদ গড়ে তুলতে না পারলে চালের বাজার দর নিয়ন্ত্রণে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে। তাছাড়া খোলা বাজারে হস্তক্ষেপ ও গরিববান্ধব চাল বিতরণ কর্মসূচি সম্প্রসারণের জন্য মজুদের পরিমাণ বাড়ানো দরকার। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে চাল সংগ্রহ বাড়ানো হলে এর বাজার আরও চড়ে যেতে পারে। অতএব, আমদানি করা নিরাপদ। গেল বছর বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মাত্রা ছিল প্রাক শিল্পযুগের তুলনায় ১.৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। এবার অর্থাৎ ২০২৪ সালে তা আরও বৃদ্ধি পেয়ে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করে যেতে পারে। তাতে ব্যাহত হবে খাদ্যশস্যের বৈশ্বিক উৎপাদন। বেড়ে যাবে খাদ্যশস্যের আন্তর্জাতিক মূল্য। তেমন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটার আগেই দেশের খাদ্য মজুদ নিরাপদ পর্যায়ে উন্নতি করা উচিত। তাতে সার্বিক খাদ্য মূল্যস্ফীতির ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
অনেকে মনে করেন, মুক্ত বাজার ব্যবস্থায় চালসহ নিত্য ব্যবহৃত পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেয়ার তেমন সুযোগ নেই। এটা ভ্রান্ত ধারণা। বাজার কারসাজির ক্ষেত্রে পণ্যমূল্য নির্ধারণ করে দেয়াই উত্তম পদক্ষেপ। অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত পণ্যের ক্ষেত্রে মূল্য নির্ধারণের ভিত্তি হওয়া উচিত উৎপাদন খরচ। তার সঙ্গে বিপণন খরচ ও মুনাফা যোগ করে নির্ধারিত হবে ভোক্তা মূল্য। আমদানিকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে বিবেচনার বিষয় হবে আমদানি মূল্য। অভ্যন্তরীণ খরচ ও ব্যবসায়ীর লাভ যোগ করে হবে ভোক্তার মূল্য। বিপণন শৃঙ্খলের প্রতিটি স্তরে তার ঘোষণা থাকা উচিত। যাতে কেউ চড়া দাম হাকিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত না করতে পারে গরিব ভোক্তাদের। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময় শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর হ্রাস করা উচিত। তাতে ভোক্তা পর্যায়ে হ্রাস পাবে পণ্য মূল্য। বিশ্ববাজার থেকে খাদ্য আমদানির ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা বাড়ছে। ২০১০ সালে বাংলাদেশের মোট খাদ্য চাহিদার ৯ দশমিক ৩ শতাংশ মেটানো হতো আমদানির মাধ্যমে। ২০২২ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ২ শতাংশে। এই প্রবণতা রোধ করতে হবে। চাল, গম, আলু, পেঁয়াজ, ডাল ও ভোজ্যতেলের মতো প্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে। এর জন্য আরও বেশি আর্থিক সহায়তা ও নীতিগত সমর্থন প্রদান করা উচিত।
লেখক: কৃষি অর্থনীতিবিদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। পরিচালক, ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকস এবং সাবেক উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে