শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ার বুকে একখণ্ড দ্বীপ, এক বিচ্ছিন্ন জনপদ
চারদিকে বয়ে যাওয়া বংশী নদী। বর্ষা কিংবা শীত সারা বছর সাপের মতো পেঁচিয়ে রাখে গ্রামগুলোকে। ঠিক যেন সবুজেঘেরা কোনো একটি দ্বীপ। শুষ্ক মৌসুমে গ্রামগুলোকে মূল এলাকার সঙ্গে যুক্ত করে তিনটি বাঁশের সাঁকো। সেই সাঁকো দিয়েই চলাচল করছে মানুষ, গবাদিপশু থেকে শুরু করে ছোট যানবাহন। বর্ষা মৌসুম যেন যান্ত্রিক নৌকা কিংবা ট্রলার একমাত্র ভরসা যোগাযোগের। সেসময় স্রোত আর বৃষ্টি কঠিন করে তোলে মানুষের জীবনযাত্রা। দীর্ঘদিন ধরে সেতু নির্মাণের দাবি থাকলেও জনগুরুত্বপূর্ণ এ স্থানটি বরাবরই জনপ্রতিনিধিদের চোখ এড়িয়ে গেছে। ফলে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া যেন গত্যন্তর নেই স্থানীয়দের।
এ চিত্র শিল্পাঞ্চল সাভারের আশুলিয়ায়। উপজেলার ধামসোনা ইউনিয়নের ৫টি গ্রামের মানুষের চলাচলের একমাত্র ভরসা এই বাঁশের সাঁকো। দীর্ঘদিনেও কোনো স্থায়ী সেতু নির্মিত না হওয়ায় বাঁশের সাঁকোতেই চলছে ঝুঁকি নিয়ে পারাপার। তবে বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই একরাতে ভেঙে গেছে তিনটি বাঁশের সাঁকোই। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন পোশাক শ্রমিকসহ ছয় গ্রামের কমপক্ষে চল্লিশ হাজার মানুষ। এছাড়া এলাকায় নেই কোনো ক্লিনিক বা ফার্মেসি। তাই চিকিৎসার জন্য যেতে হয় অন্য গ্রামগুলোয়। সেখানেও যেতে লাগে নৌকা বা হাঁটা সড়ক। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ এখানকার সাধারণ মানুষ। দ্রুততম সময়ে সেতু নির্মাণের দাবি জানান তারা।
ইউনিয়নটির উনাইল, গোয়ালটেক, গাছটেক, গোপালপাড়া, গৌরপাড়া গ্রামের লোকজনের চলাচলের একমাত্র বাহন ছিল নৌকা। তবে প্রতিদিনের চলাচলের জন্য এখন তারা ব্যবহার করেন এই বাঁশের সাঁকো। কন্ডা থেকে উনাইল নদীর মাঝে রয়েছে দীর্ঘ ১০০ ফুট দৈর্ঘ্যের এই বাঁশের সাঁকো। সেই সঙ্গে ধামসোনা বাজার থেকে গোপালবাড়ী স্কুল পর্যন্ত রয়েছে প্রায় ২০০ ফিটের সাঁকো। এদিকে গৌরপাড়া থেকে মাইঝাইল পর্যন্ত রয়েছে আরও একটি সাঁকো। গ্রামে রয়েছে একটি স্কুল, কলেজ, দুটি মাদ্রাসা। নেই বাজার ও চিকিৎসাকেন্দ্র। এছাড়া পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোয় যেতে হয় হেঁটে কিংবা নৌকা যেন শেষ ভরসা। ফলে শিক্ষা, চিকিৎসা ও কৃষিসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এপারের বাসিন্দারা।
নদীর পাড় ঘেঁষে একসময়ের পায়ে পায়ে গড়ে ওঠা মেঠোপথটি এখনো রয়েছে সেভাবেই। তবে গ্রামের ভেতরে সড়কগুলো ইট ও ঢালাইয়ের। প্রতিদিনের চলাচলের জন্য গ্রামের মানুষের একমাত্র ভরসা এই বাঁশের সাঁকোগুলো। তবে বর্ষার সময়ের আগেই ভেঙে যায় সেই পারাপারের সহজ মাধ্যম। বর্ষা শেষে গ্রামের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নদীর ওপর আবার তৈরি হয় এই সাঁকো। বাকি সময়টা পার হতে হয় নৌকা ও ট্রলারে। ওপাড়ে থাকা পরিবারগুলো নিজেদের প্রয়োজনে নিজের খরচেই তৈরি করে নেন এসব সাকোঁ। সবমিলিয়ে এ বছর গড়ে ওঠা তিনটিই সাঁকোর নির্মাণ খরচও গ্রামের প্রতিটি পরিবারকে বহন করতে হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, স্বাধীনতার পর থেকেই বংশী নদীর ওপর কমপক্ষে একটি সেতুর প্রত্যাশা ছিল তাদের। স্বপ্ন যেন এখনো অধরা। বিগত সরকারের আমলে একাধিক জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনসহ বহুবার স্বপ্ন দেখালেও তা বাস্তবে রূপ নেয়নি। এতে কার্তিক থেকে জ্যৈষ্ঠ এ ৮ মাস নদীর ওপর বাঁশের সাঁকো দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই পারাপার হচ্ছেন তারা। আবার ওই সাঁকো দিয়ে মোটরবাইক ও অটোরিকশাসহ ছোট ছোট যানবাহন চলাচল করে। এ কারণে সাঁকো ভেঙে যে কোনো সময় ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। এছাড়া বর্ষা মৌসুমে পুরো এলাকা থাকে পানির বেষ্টনীতে। পারাপারের জন্য একমাত্র মাধ্যম নৌকা বা ট্রলার। এতে ঘটেছে অসংখ্য দুর্ঘটনা। এছাড়া গ্রামে কোনো চিকিৎসাকেন্দ্র না থাকায় সেবার জন্য যেতে হয় অন্য কোনো ইউনিয়নে বা দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে।
সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাজু ক্ষোভ নিয়ে বলেন, ‘আমরা এই সাঁকো দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন বিদ্যালয়ে যাতায়াত করি। মাঝেমধ্যে সাঁকো ডুবে যায়। সাঁকো ভেঙে গেলে বর্ষার সময় নৌকায় বা ট্রলারে করে স্কুলে যেতে হয়। অনেক সময় নদীতে পড়ে বই-খাতা ও স্কুলের ইউনিফর্ম ভিজে যায়। এছাড়া স্কুলে আসতে ও যেতে দেরি হয়। মাঝে মধ্যে ভিড় থাকলে অনেক সময় লাগে নদী পার হতে। তাই বাধ্য হয়ে ২ মিনিটের রাস্তা ৩০ মিনিট হেঁটে আসতে হয়। আমাদের দাবি, দেওনাই নদীর ওপর একটি ব্রিজ নির্মাণ করে দেয়া হোক।’
স্থানীয় বাসিন্দা ব্যবসায়ী মুমিন মিয়া। প্রতিদিন তাকে দুবেলা নদীর পাড় দিয়ে যেতে হয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। তিনি বলেন, ‘বাপ-দাদার আমল থেকে দেখছি নদীর ওপর ব্রিজ নাই। এলাকাবাসী প্রতি বছর বর্ষা এলে বাঁশ, কাঠ ও চাঁদা সংগ্রহ করে সাঁকো তৈরি করে। আবার ছয় মাস চলতে হয় নৌকায়। প্রতিদিন নদী পার হয়ে হাজার হাজার লোক অন্যত্র যায়। অথচ ভোটের সময় অনেকেই ব্রিজ তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট নিয়ে যায়; কিন্তু ভোট চলে গেলে আর কারও কোনো খবর থাকে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিকল্প রাস্তা না থাকায় যাতায়াতের একমাত্র ভরসা এই বাঁশের সাঁকো ও নৌকা। এখানে একটি ব্রিজ হলে প্রায় ৪০ হাজার মানুষের জীবনমান পাল্টে যাবে। এই গ্রামে কোনো চিকিৎসালয় নেই। তাই চিকিৎসার জন্য যেতে হয় অন্য জায়গায়। অনেক প্রসূতি নারীকে অনেক আগেই এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হয়। কারণ ডেলিভারির সময় হলে নদী পারপারে সমস্যা হয়। মাঝরাতে নৌকা পাওয়া যায় না। তাছাড়া সাঁকোতে গাড়ি চলতে পারে না। তাই কেউ অসুস্থ হলে উপায় থাকে না। রাস্তায় মারা যায়। এছাড়া প্রয়োজনীয় কাজে পুলিশ বা কেউ দ্রুত আসতে পারে না।’
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী হানিফ মোহাম্মদ মুর্শিদীর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘খোঁজখবর নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এর আগে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে, একটি ব্রিজের প্রস্তাব করা হয়েছে। আমরা বিষয়টা গভীরভাবে দেখছি।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে