লোকসভা নির্বাচন ২০২৪ বিশ্লেষণ
অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের কাউন্ট-ডাউন শুরু। এই নির্বাচনের ফলাফল ভারতের ভবিষ্যৎ রাজনীতির নির্ণায়ক দিশা তৈরি করে দিতে পারে। আদর্শগত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এই নির্বাচন দেশে এক বিরল মেরুকরণ তৈরি করতে চলেছে। নির্বাচন কমিশন দ্বারা স্বীকৃত জাতীয় পার্টিসহ রাজ্যভিত্তিক আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের সংখ্যা পঞ্চাশের অধিক হলেও মূলত দুই জাতীয় রাজনৈতিক দল- ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবং সর্বভারতীয় কংগ্রেস দলকে কেন্দ্র করেই রাজনৈতিক মেরুকরণ তৈরি হতে চলেছে। পূর্ব ঘোষণা বা আগ্রহ থাকলেও ভোট-পূর্ববর্তী তৃতীয় রাজনৈতিক মোর্চা গড়ে ওঠেনি। অনেক আঞ্চলিক দল এককভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে ঘোষণাও করেছেন।
ভারতের লোকসভা ভোট মূলত রাজনৈতিক দলের সাংসদ নির্বাচনের লড়াই হলেও বিজেপি সাফ্যলের সঙ্গে লোকসভা নির্বাচনকে অনেকটা রাষ্ট্রপতি ধাঁচের নির্বাচনে রূপান্তরিত করতে পেরেছে। যেহেতু বিজেপিসহ শরিক দলগুলোর নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর মুখ। তুলনায় এটা বাস্তব যে, বিরোধী কংগ্রেসসহ শরিক এবং অন্যান্য আঞ্চলিক দলের ঘোষিত রণকৌশল হলো নির্বাচনের পরে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের দল প্রধানমন্ত্রী চয়ন করবেন। বিরোধী দলের কোনো মুখ নেই বলেই তারা বলছেন, এবারের নির্বাচন মোদি বনাম ‘জনতার’।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, এনডিএ নেতৃত্বাধীন নরেন্দ্র মোদি যদি এবার তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন, তাহলে তিনি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর রেকর্ড ছোঁয়ার পথে এগোতে পারেন। এখনো জওহরলাল নেহরু সর্বাধিক সময়ের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত। ১৬ বছর ২৮৬ দিন। তবে পরপর তিনবার নির্বাচনে জয়ী হওয়ার নেহরুর রেকর্ডের সমকক্ষ হবেন। ইন্দিরা গান্ধী প্রথম পর্যায়ে ১৯৬৬-১৯৭৭ (১১ বছর ৫৯ দিন) এবং দ্বিতীয় পর্যায় (১৯৮০-৮৪) ৪ বছর ২৫৯ দিন। গান্ধী পরিবারের বাইরে একমাত্র ড. মনমোহন সিং একটানা দশ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। নরেন্দ্র দামোদার দাস মোদি দেশের চতুর্দশ প্রধানমন্ত্রী। দশ বছর মেয়াদ পেরিয়েছেন। তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হলে মনমোহন সিংয়ের মেয়াদ পেরোবেন। তাও এক অকংগ্রেসী প্রধানমন্ত্রী। এ কারণে এটা বাস্তব যে স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের রাজনীতি আবর্তিত হতো কংগ্রেসকেন্দ্রিক।
এই গতির প্রথম দিশা বদলাল যখন অটল বিহারি বাজপেয়ীর নেতৃত্বে বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ সরকার তৈরি হয়। ব্যতিক্রমী ঘটনা হলো ভারতে প্রথম অকংগ্রেসী-অবিজেপি দলের সরকার গঠিত হলো এইচডি দেবগৌড়ার নেতৃত্বে। সেই চিত্র বদলে গেছে। এবার মূল কেন্দ্রে বিজেপি। রাজনীতির অক্ষ বদল হয়ে গেছে। এর আগে চরন সিং, মোরারজী দেশাই, বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং স্বল্প সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন ঠিকই। ভারতের রাজনীতি তাদের কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়নি। প্রথম ব্যতিক্রমী ঘটনা আঞ্চলিক দলগুলোর সরকার গঠিত হলো এইচডি দেবগৌড়ার নেতৃত্বে। কংগ্রেস দল সরকারে যোগ না দিয়ে বাইরে থেকে সমর্থন করল। সেও টেকেনি।
ভারতের রাজনীতিতে প্রথম সংযুক্ত মোর্চা নামে তৃতীয় একটি অক্ষ তৈরি হয়েছিল। সেই উদাহরণ এখনো আঞ্চলিক দলগুলো কখনো উত্থানের চেষ্টা করেন। শেষ পর্যন্ত এই লোকসভা ভোটের আগে সেটা দানা বাঁধল না। সে কারণেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ বনাম কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন খণ্ডিত ইন্ডিয়া (উদ্ধব শিবসেনাসহ)। আদতে এটা সংযুক্ত প্রগতিশীল মোর্চার পরিবর্তিত রূপ। এখনো মন্থন চলছে। এই দুই অক্ষের বাইরে বহু আঞ্চলিক দল- যেমন পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস, অন্ধ্রের ওয়াই এস আর (জগন রেড্ডি) কংগ্রেস, তেলেঙ্গানার তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতি, তামিলনাড়ুর এআইএডিএমকে (দ্বিখণ্ডিত) এককভাবে দুটি মূল বলয়ের বাইরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।
২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি জোট ৫৪৩টি আসনের মধ্যে ২৮৩টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এনডিএ শরিকদের নিয়ে ৩৩৬টি আসন। এই প্রথম ভারতে এক রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করেছে সর্বনিম্ন ভোটের শতাংশ নিয়ে। মাত্র ৩১ শতাংশ। জোট শরিক ধরলে ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০১৯ সালে বিজেপি ভোট বাড়িয়ে পেল ৩৭ দশমিক ৭৬ এবং এনডিএ শরিকদের মিলিয়ে ৪৫ শতাংশ। ১৯৮৯ সালের পরে এই প্রথম একটি রাজনৈতিক দল সর্বাধিক ভোট পেল। কংগ্রেস লোকসভার ১০ শতাংশ আসন পায়নি বলে বিরোধী দলের মর্যাদা পেল না। ২০১৪ সালে ৪৪ এবং ২০১৯ সালে ৫২ স্বাধীনতার পরে কংগ্রেসের সর্বনিম্ন ভোট।
২০২৩ সালে দেশে ৯টি রাজ্যে বিধানসভা ভোট অনুষ্ঠিত হয়। ত্রিপুরায় ফেব্রুয়ারি মাসে বিজেপি পুনরায় দ্বিতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় আসে। মেঘালয় ও নাগাল্যান্ডে বিজেপির আঞ্চলিক শরিক দল ক্ষমতায়। কংগ্রেসের ক্ষমতা সংকুচিত হয়। এরপর মে মাসে কর্নাটকের বিধানসভা ফলাফল কংগ্রেসকে অনেকটা অক্সিজেন দেয়। বিজেপির কট্টর হিন্দুত্ব দর্শনের (বিশেষ করে বিদ্যালয়ে হিজাব পোশাক) নিষিদ্ধ করে সার্বিক মেরুকরণের প্রয়াস করে। তা সত্ত্বেও অনেকটা ২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গের ‘নো ভোট টু বিজেপি’ ধাঁচের প্রচার করে কংগ্রেস আশাতীত সাফল্য পায়। ২৪৩ আসনের মধ্যে কংগ্রেস ১৩৫টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা অর্জন করে। কর্নাটকের জয় নিশ্চিতভাবে কংগ্রেসের মনোবল চাঙ্গা করে। এই প্রথম কর্নাটকে বিজেরি দক্ষিণপন্থি হিন্দুত্ব বনাম কংগ্রেসের উদারবাদী ধর্মনিরপেক্ষতা আদর্শের প্রত্যক্ষ লড়াই হলো। ধারণা হয়েছিল কংগ্রেস হয়তো এবার জাতীয় স্তরে মোদি বিজেপির মোকাবিলা করতে পারবে। হাওয়াই বদলে গেলো নভেম্বর মাসের পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটের ফলে। উত্তর-পূর্ব রাজ্যের মধ্যে মিজোরাম মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট জয়ী। তেলেঙ্গানায় কর্নাটকের ফলের মতো কংগ্রেস রাজ্য দ্বিখণ্ডিত হওয়ার পরে এই প্রথম জয়ী হলো; কিন্তু হিন্দি বলয়ের মধ্যপ্রদেশ-রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ে কংগ্রেস ধরাশায়ী।
রাজস্থানে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সরকাররের পরিবর্তন হয়ে থাকে। এটা আশ্চর্যের নয়। সবাইকে বা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের চমকে দিয়েছিল মধ্য প্রদেশের ও ছত্তিশগড়ের ফলাফল। এক বা দুটি ছাড়া কোনো ওপিনিয়ন বা একজিট পোল বিজেপিকে জয়ী দেখায়নি। বিজেপি নেতারাও বিশ্বাস করতে পারেননি। দুই-তৃতীয়াংশ আসনে তারা জয়ী হবেন। এই জয়কে বিজেপির জাতীয় নেতৃত্ব এবং বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদি হাতিয়ার করে ফেললেন আসন্ন লোকসভা ভোটের প্রচার হিসেবে।
এর আগে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এক অভিনব যাত্রা শুরু করেন। ভারতে যেসব নেতা এইভাবে পথ পরিক্রম করেছেন, তারা রাজনৈতিক সাফল্য পেয়েছেন। ১৯৮৩ সালে তদানীন্তন জনতা পার্টি নেতা চন্দ্রশেখর কন্যাকুমারী থেকে ভারত যাত্রা শুরু করেন। ছয় মাসব্যাপী পদযাত্রার শেষে তিনি দিল্লি পৌঁছালে তার রাজনৈতিক ভাগ্য বদলে যায়। কংগ্রেসের সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। ভারতের রাজনীতিতে নতুন দিশা তৈরি করেছিল যখন বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদবানি অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের দাবিতে সোমনাথ থেকে ১০ হাজার কি.মি. রথযাত্রা শুরু করেন। বিজেপির রাজনৈতিক ভাগ্য বদলে যায়। উত্থান হয় হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির। প্রথম রথযাত্রার জনক ছিলেন অন্ধ্রর এন টি রামা রাও। তার রাজনৈতিক উত্থানের পরে ভারতে প্রথম ‘তৃতীয় মোর্চার’ আঁতুড়ঘর হয়ে উঠেছিল হায়দরাবাদ।
রাহুল গান্ধী ‘নফরত কে বাজার মেঁ মহব্বত কি দুকান’ স্লোগান দিয়ে সেপ্টেম্বর মাসে কন্যাকুমারী থেকে ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রা শুরু করেন পদব্রজে। ৩ হাজার ৫০০ কি.মি. যাত্রা শ্রীনগরে সমাপ্ত হয়। যাত্রাপথে রাহুল বিপুল সমর্থন পেয়েছিলেন- এটা সত্য। কেবলমাত্র কংগ্রেস সমর্থক নয়, সাধারণ নাগরিক, সুশীল সমাজের মানুষ যুক্ত হয়েছিলেন যাত্রাপথে। কংগ্রেস নেতাদের ধারণা ছিল, রাহুলের যাত্রার রাজনৈতিক মুনাফা পাওয়া যাবে। যদিও এক সর্বভারতীয় সমীক্ষায় ৩৭ শতাংশ মানুষ বলেছিলেন কোনো লাভ হবে না। এই যাত্রার মধ্যেই গুজরাট ও হিমাচলে বিধানসভা ভোট হয়। গুজরাটে কংগ্রেস শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হয়। এই প্রথম হিমাচলে কংগ্রেস এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। গুজরাটে আম আদমি পার্টি বেশ কিছু আসনে ভোট পেয়ে যাওয়ায় বিজেপির সুবিধা হয়ে যায়। তখন থেকেই কংগ্রেস হাইকমান্ড সিদ্ধান্ত নেয়, লোকসভা ভোটের সময়ে আপ পার্টির সঙ্গে আসন সমঝোতা করা হবে। এটা নিশ্চিত কর্নাটকে কংগ্রেস দলের সাফ্যলের নেপথ্যে রাহুলের যাত্রার প্রভাব পড়েছে। এমনকি পরে তেলেঙ্গানা রাজ্যের বিধানসভা ভোটেও কংগ্রেস রাজনৈতিক লাভ পায়।
এরপর বিজেপি হিন্দি বলয়ের মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় ও রাজস্থানে আশাতীত সাফল্য পাওয়ার পরে প্রধানমন্ত্রী নিজেই বিজেপি দপ্তরে বিজয় সমাবেশে ঘোষণা করে দেন ‘আব কি বার চারশ পার’, অর্থাৎ এবার চারশর বেশি আসনে বিজেপি জয়ী হবে। পরে প্রধানমন্ত্রী নিজের বক্তব্য সংশোধন করে বলেন, বিজেপির ৩৭০ পার। এনডিএ চারশ পার। এবার বিশ্লেষণ করব বিজেপি কি সত্যিই ৩৭০ আসন পাবে? বিজেপির আসনের সঙ্গে কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বিলোপের সিদ্ধান্তকে জুড়ে দিয়ে ভাবাবেগ তৈরি করলেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। পূর্ব ঘোষণা মতো অযোধ্যার নির্মিয়মাণ রামমন্দিরের ভগবান রামের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে হিন্দু ভাবাবেগকে আরও সুসংহত করলেন। একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবকের ঘোষণা মতো অযোধ্যার মন্দির ছাড়াও কাশী ও মথুরায় মসজিদ হটিয়ে কেবলমাত্র মন্দির রাখার প্রচার সুকৌশলে বিজেপি শাখা সংগঠন শুরু করে দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী মোদি দিল্লিতে এই প্রথম জি-কুড়ি দেশের শিখর সম্মেলন করেছেন। চাঁদের দক্ষিণ প্রান্তে চন্দ্রযান পাঠিয়ে ভারতের মহাকাশ গবেষণার মাইলফলক তৈরি হয়েছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো-বিজেপির প্রচারের মূল বিষয়ে এসব গুরুত্ব পাচ্ছে না। মৌলিক প্রচারের কেন্দ্রে রাম মন্দিরের মতো হিন্দুত্ব আদর্শ। এক কথায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা বাদকে হাতিয়ার করে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ভোটদাতার মন জয় করা। প্রচারে অবশ্যই তিন তালাক নিষিদ্ধ করাও রয়েছে। এটা পরোক্ষে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বা ইউনিফর্ম সিভিল কোড লাগু করার প্রথম পদক্ষেপ। হিন্দুত্ব ইস্যুর সুবিধা হলো বর্তমান আর্থিক সমস্যা-বেকারত্ব মুদ্রাস্ফীতির মতো নাগরিক জীবনকে প্রভাবিত করার বিষয়গুলোকে পেছনের সারিতে নিয়ে যাওয়া। বিতর্কের কেন্দ্রে কেবলমাত্র হিন্দুত্ব এজেন্ডাই রাখা। পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক। তুলে মেরুকরণ করা।
আদর্শগত বিষয় ছাড়াও বিজেপি সরকারের অন্যতম হাতিয়ার একেবারে প্রান্তিক মানুষের জন্য বিনামূল্যে রেশন দেয়া। মোদি সরকার ঘোষণা করে দিয়েছে দেশের আশি কোটি মানুষের জন্য বিনামূল্যে রেশন দিয়ে যাবে। অথচ কৃতিত্ব দাবি করছে ২৫ কোটি মানুষকে গরিব থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও গরিবদের বাসস্থান ও গ্যাসের সিলিন্ডার দেয়ার প্রচার করে এক নতুন ভোটব্যাংক তৈরি করেছে। যাকে বলা হচ্ছে ‘লাভার্থী’। যারা লাভবান হচ্ছেন। এই দুমুখী রণনীতি লোকসভা ভোটের প্রধান হাতিয়ার। সর্বশেষ মেরুকরণের হাতিয়ার নাগরিক সংশোধনী আইন। বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকে আগত নিপীড়িত হিন্দুসহ খ্রিষ্টান, বৌদ্ধদের নাগরিকত্ব দেয়ার নিয়ম লাগু করে দেয়া। এতে কতটা রাজনৈতিক লাভ পাবে বিজেপি?
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপি ৩০৩টি আসন পায়। সিংহভাগ হিন্দি বলয় থেকে এবং প্রায় মোট আসনের সিংহভাগ। অর্থাৎ বিজেপিকে গতবারের আসন ধরে রাখতে হলে প্রায় গত লোকসভা ভোটের ফলের পুনরাবৃত্তি করতে হবে। অনেক রাজ্য রয়েছে, যেখানে বিজেপি একশ ভাগ আসন জয়লাভ করে। এসব রাজ্যে আসন বাড়ানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। যেমন বিহারে ৪০টি আসনের মধ্যে বিজেপি সহযোগীদের নিয়ে ৩৯টি আসন জয়লাভ তরে। এখানে আসন বাড়ানোর সম্ভাবনা কোথায়? গতবার বিজেপি ১৭টি আসনে জয়ী হয়। এখন পর্যন্ত নীতিশ কুমারের সংযুক্ত জনতা দলের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে বিজেপি ২০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। যদি ধরেই নিই বিজেপি সব আসনে জয়ী হবে তাহলেও তিনটি বাড়তে পারে। সহযোগী নীতিশ কুমারের দল সব আসনে জয়ী হবে কি? নীতিশ কুমারের জনপ্রিয়তা ভাটার পথে। তুলনায় লালু প্রসাদের পুত্র তেজস্বী ইতিমধ্যেই ঝড় তুলেছেন। গতবার একটাও আসন জেতেনি। এবার কি একটাও জিতবে না? যদি জেতে সেটা হবে বিজেপির ক্ষতি। সুতরাং বিজেপির আসন বাড়ানোর সম্ভাবনা থেকে বিহার কার্যত বাদ।
দ্বিতীয় রাজ্য ছত্তিশগড়। বিজেপি সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা ভোটে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হওয়ার পরে উজ্জীবিত। গত লোকসভা ভোটে বিজেপি রাজ্যের ১১টি আসনের মধ্যে ৯টিতে জয়ী হয়। এবার পরাজিত কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী ভুপেশ বাঘেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। বিজেপির এখানে কতটুকু সম্ভাবনা? রাজধানী দিল্লির ৭ আসনের মধ্যে বিজেপি সবকটিতেই জয়ী হয়। এখানেও বাড়ছে না। এবার কংগ্রেস এবং আম আদমি পার্টি আসন সমঝোতা করে ৪-৩ আসনে লড়ছে। গতবার বিজেপি প্রত্যেকটি আসনে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছিল। এবার কংগ্রেস-আপ যোগ দিলেও সেই সংখ্যা ছাড়ানো যাবে না। এটা যেমন ঠিক, তেমনি এই জোট কোনো আসন পাবে না, তাও সঠিক বিশ্লেষণ নয়। বিরোধীরা যত পাবে সেটাই বিজেপির ঝোলা থেকে কমবে।
গুজরাটে মোট আসন ২৬। গতবার সব আসনেই বিজেপি জয়ী হয়। এবার বিধানসভা ভোটের উপলব্ধি নিয়ে কংগ্রেস ও আপ পার্টি আসন সমঝোতা করেছে। বিরোধীরা যে কটা আসন জিতবে তাতেও বিজেপির ঝোলা থেকে কমবে। বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। হরিয়ানায় বিজেপি দশে দশ ছিল। এবার কয়েক দিন আগে বিজেপি জোটসঙ্গী চৌতালার দলের সঙ্গে সমঝোতা ভেঙে একা লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত ভোটে বিজেপি একাই লড়েছিল। এখানেও আসন বাড়ার সম্ভাবনা নেই। বরং কমার শঙ্কা। হিমাচল প্রদেশের চারটি আসন। চারটিতেই বিজেপি জয়ী হয়। ঝাড়খন্ডে ১৪টি আসনের মধ্যে বিজেপি ১১। দক্ষিণ ভারতের একমাত্র কর্নাটক রাজ্যে বিজেপি সাফল্য পায়। ২৮টি আসনের মধ্যে ২৫। মধ্যপ্রদেশে ২৮টি আসনের মধ্যে ২৭। অন্যটি কংগ্রেস নেতা কমলনাথের ছিন্দওয়াড়া। খাস তালুক কখনো পরাজিত হননি। এবার তার পুত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
গত ভোটে মহারাষ্ট্র বিজেপির জন্য গেম চেঞ্জার ছিল। ৪৮টি আসনের মধ্যে অভিকতো শিবসেনা সমেত ৪১টি আসন পেয়েছে। এবার মহারাষ্ট্রের রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে গিয়েছে। শিবসেনা যেমন ভেঙেছে, তেমনি শারদ পাওয়ারের এনসিপি ভেঙেছে। তাদের বিজেপিকে বাড়তি আসন দিতে হবে। লড়াই এখন পর্যন্ত হাড্ডাহাড্ডি মহা গট বন্ধনের সঙ্গে। রাজস্থানে ২৫টির মধ্যে বিজেপি ২৪ এবং এক আঞ্চলিক শরিক নিয়ে পুরোই। ফলে বাড়ছে না ধরে রাখতে হবে। ত্রিপুরার দুটিতেই বিজেপি জয়ী। হিন্দি বলয়ের বড় রাজ্য উত্তরপ্রদেশ। মোট আসন ৮০। বিজেপি গতবার ৬২টি আসন পায়। এখানে এবার কংগ্রেস-সমাজবাদী আঁতাত। যদি বিজেপির আসন বাড়েও, তাহলে কয়েকটা বাড়ার সম্ভাবনা; কিন্তু অন্যত্র যে লোকসান হবে, তার কতটা পূরণ হবে তাই নিয়ে সংশয় রয়েছে।
উত্তরাখন্ডে পাঁচটি আসনের সবকটিতেই বিজেপি জয়ী হয়। এসব রাজ্য থেকে আসন বাড়ার সম্ভাবনা নেই। তাহলে ৩০৩ বেড়ে ৩৭০ হবে কোন রাজ্য থেকে? ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপির সাফল্য প্রথমে ভাবা হয়নি। সমস্ত সমীকরণ বদলে দিলো পুলওয়ামা পাক জঙ্গি হানা। তারপর কেন্দ্রীয় সরকারের বালাকোট বিমান হানা। উগ্র জাতীয়তার বীজ রোপিত হলো। ২০১৪ সালে বিজেপি ২৮৪টি আসন পায়। তার থেকে বেড়ে হলো ৩০৩। অনেকেই বিশ্লেষণ করেছিলেন পুলওয়ামা না ঘটলে বিজেপি এত আসন পেত না বরং কমত।
বিজেপির প্রধান লক্ষ্য দক্ষিণ ভারত এহং পূর্বত্তোর রাজ্যগুলো থেকে আসন বাড়ানো। যেমন অন্ধ্রর পঁচিশটি আসনের গতবার একটি আসনও পায়নি বিজেপি। এবার তেলেগু দেশমের সঙ্গে আঁতাত করেছে। কতটা সাফল্য পাবে তাই নিয়ে সংশয় রয়েছে। কেরালায় কুড়িটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা মূলত কংগ্রেস বনাম বামদের। সেখানে বিজেপির আসন না পাওয়ার সম্ভাবনা। যদি না অঘটন ঘটে। একই অবস্থা চল্লিশ আসনের তামিলনাডুতে। উত্তর-পূর্ব ভারতে বিজেপি গত ভোটে ১৩টি আসন পায়। এবার মণিপুরের জাতিগত দাঙ্গা হওয়ার পরে উত্তর-পূর্ব ভারতে বাড়তি আসন পাওয়া কঠিন। একমাত্র দক্ষিণ ভারতে তেলেঙ্গানায় বিজেপি চারটি পেয়েছিল। সেখানে একটি বা দুটি বাড়তে পারে। পূর্ব ভারতে ওড়িশায় ২১টি আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছিল আটটি আসন। সামান্য হলেও বিজেপির আসন বেড়ে যাওয়ায় সম্ভাবনা রয়েছে।
বিজেপি মূল লক্ষ্য তৃতীয় বৃহত্তম প্রদেশ পশ্চিমবঙ্গ। এখানকার ১৮ আসন বাঁচানোই প্রধান লক্ষ্য। যদিও বিজেপি দাবি করছে পঁচিশটি পেতে পারে। সর্বভারতীয় চিত্র দেখলে বোঝা যায়, বিজেপি একশো ভাগ আসন পাওয়া রাজ্য থেকে যদি আসন হারায় তাহলে সামান্য লোকসান পূরণ হতে পারে। এটা অঙ্কের হিসাবে। রাজনীতিতে অঙ্ক শেষ কথা নয়। রসায়ন ভিন্ন। অঘটন ঘটানোর সব রকম চেষ্টাই বিজেপি করবে।
এবার এনডিও এবং কংগ্রেস মোর্চা দেখা যাক। বিজেপির পুরোনো শরিকের মধ্যে আকালি দল নেই। সংযুক্ত জনতা দল এবার রয়ে গেছে। অন্য নতুন দলের মধ্যে মহারাষ্ট্রের শিবসেনা (বিভক্ত) এনসিপি (বিভক্ত), অন্ধ্রে তেলেগু দেশম, কর্নাটকে দেবগৌড়ার জনতা সেকুলারের সঙ্গে সমঝোতা হয়েছে। উত্তর প্রদেশে ছোট জাতি ভিত্তিক দল ছাড়া রাষ্ট্রীয় লোক দল এবং আপনা দল। এ ছাড়া ছোট ছোট অনেক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আঁতাত করেছে। উল্টো দিকে প্রচারে অনেক পিছিয়ে থাকলেও কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোটের শেষ পর্যন্ত অনেকেই নেই। এটা কার্যত ইউপিএ এক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ২০০৪ সালের কংগ্রেস সরকারের জোট যেমন ছিল। ইউপিএতে যারা ছিলেন তারা সবাই রয়েছেন। দক্ষিণ ভারতের ডিএমকে, মহারাষ্ট্রের উদ্ধব ঠাকরসহ (নয়া শরিক) শারদ পাওয়ার, ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চা, বিহারে লালু প্রসাদের রাষ্ট্রীয় জনতা দল। এবার উত্তর প্রদেশে সমাজাবাদী পার্টির সঙ্গেও আসন সমঝোতা হয়েছে। খাতা-কলমে লড়াই রয়েছে। এক তরফা প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। এটা বোঝা যায় নরেন্দ্র মোদির বিপুল জনপ্রিয়তা, রাম মন্দিরসহ হিন্দুত্বের ইস্যু থাকা সত্ত্বেও প্রত্যেক দিন কংগ্রেস থেকে নেতা ভাঙিয়ে নিতে হচ্ছে। হয়তো বুঝেছেন একা বিজেপির দ্বারা সম্ভব হবে না।
বামপন্থিদের সঙ্গে আঁতাত না হলেও শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস নেতৃতাধীন সরকারকেই তারা সমর্থন করবেন। যদি কোনো সম্ভাবনা তৈরি হয়। যেমন প্রথম ইউপিএতে হয়েছিল। একমাত্র বিষফোড়া হয়ে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে আঁতাত। শেষ পর্যন্ত হচ্ছে না। আম আদমি পার্টির সঙ্গে সমঝোতা হলেও পাঞ্জাবে হয়নি। তার রাজনৈতিক কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে এখানে আঁতাত হওযার অর্থ বিরোধী স্থান অকালি বা বিজেপি পেতে পারে। সে কারণে গুজরাট ও দিল্লিতে আঁতাত করলেও পাঞ্জাবে করা হয়নি।
এখনো রাজীব গান্ধী একমাত্র প্রধানমন্ত্রী, যিনি ইন্দিরা গান্ধী হত্যার সহানুভূতি হাওয়ায় ৪১১টি আসন পেয়েছিলেন। মোদির লক্ষ্য সেই সংখ্যা এবার পেরোনো। কেন? হবে কি না নিশ্চয়তা নেই। নিছক রাজীব গান্ধীর রেকর্ড ভঙ্গ করাই নয়। সংসদের উভয় কক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা। ইতিমধ্যে রাজ্যসভায় বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার থেকে মাত্র চারটি আসন দূরে। অদূর ভবিষ্যতে সেটা পূরণ করার লক্ষ্য। লোকসভাতেও যদি তাই হয়, তাহলে মোদি যা চাইবেন সেভাবে ভারতের সংবিধান পরিবর্তন করার ক্ষমতা অর্জন করবেন।
আগামী ২০২৬ সালে ভারতে লোকসভার আসনসংখ্যা বাড়ানোর সুযোগ আসবে। ইতিমধ্যেই নয়া সংসদ ভবনে লোকসভার জন্য আটশ আসন রেখে দেয়া হয়েছে। লোকসভা আসন বাড়ানোর মোয়াদ ওই সাল পর্যন্ত ফ্রিজ করা আছে। আসন বাড়াতে গেলে আবার লোকসভার আসন সীমানা পুনঃবিন্যাস করা হবে। মোদির বয়স ওই সময়ে পঁচাত্তর। তারই তৈরি করা নিয়ম অনুযায়ী ওই বয়সে রাজনীতিবিদদের অবসর নেয়া। মোদি তাই হয়তো করবেন না; কিন্তু দুই সভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রর শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতি ধাঁচের শাসন ব্যবস্থা চালু করবেন কি? এটা আরএসের স্বপ্ন।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে