বাংলাদেশের ব্যাংকারদের সুস্থতা ও সুখবোধ বিশ্লেষণ
১. বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সংক্ষিপ্ত বিবরণ
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত, যেখানে সরকারি-বেসরকারি ও বিশেষায়িত ব্যাংক অন্তর্ভুক্ত, অর্থনীতির একটি মূলস্তম্ভ। দ্রুত ডিজিটালাইজেশন ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তির উদ্যোগ এই খাতের বিকাশে ভূমিকা রাখলেও অকার্যকর ঋণ, নিয়ন্ত্রক কঠোরতা ও প্রতিযোগিতামূলক চাপের মতো চ্যালেঞ্জগুলো অব্যাহত রয়েছে। এই খাতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কর্মী নিয়োজিত, যেখানে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে কাজের পরিবেশে বৈষম্য লক্ষণীয়।
২. সুস্থতা ও সুখবোধের মূল দিকগুলো**
শারীরিক স্বাস্থ্য
-কাজের পরিবেশ: দীর্ঘ সময় স্ক্রিনের সামনে বসে কাজ, নিষ্ক্রিয় জীবনযাপন এবং আরগোনমিক সমস্যা (যেমন: পিঠে ব্যথা, চোখের চাপ) সাধারণ ঘটনা।
-স্বাস্থ্য ঝুঁকি: মানসিক চাপ, অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস ও শারীরিক পরিশ্রমের অভাবের কারণে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও স্থূলতার প্রাদুর্ভাব বেশি।
-সুবিধা: বড় ব্যাংকগুলোতে স্বাস্থ্য পরীক্ষা বা জিমের সুবিধা থাকলেও গ্রামীণ শাখাগুলোতে এগুলো অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
মানসিক স্বাস্থ্য
-চাপের উৎস: কর্মক্ষমতা লক্ষ্যমাত্রা, গ্রাহকের চাহিদা, চাকরির অনিশ্চয়তা (বিশেষত বেসরকারি ব্যাংকে) এবং ডিজিটাল সরঞ্জামের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো।
-মহামারির প্রভাব: কভিড-১৯ স্বাস্থ্যঝুঁকি, রিমোট কাজের চ্যালেঞ্জ ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মাধ্যমে চাপ বাড়িয়েছে।
-কলঙ্ক: মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা সমাজে ট্যাবু হিসেবেই রয়ে গেছে, যা কর্মীদের কাউন্সেলিং নেওয়া বা কর্মস্থলের সুবিধা ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করে।
কাজ ও ব্যক্তিগত জীবনের ভারসাম্য
-দীর্ঘ কর্মঘণ্টা: অর্থবছরের শেষ বা অডিটের সময় লম্বা শিফট পারিবারিক জীবন ও অবসরকে বিঘ্নিত করে।
-অতিরিক্ত কাজের সংস্কৃতি: বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে বিনা পারিশ্রমিকে অতিরিক্ত কাজ করাকে স্বাভাবিক মনে করা হয়, যা কর্মীকে ক্লান্তিতে ফেলে।
-লৈঙ্গিক বৈষম্য: নারী ব্যাংকাররা সামাজিক প্রত্যাশা (যেমন: সন্তান লালন-পালন) এবং কর্মক্ষেত্রের পক্ষপাতিত্বের দ্বৈত চাপের মুখোমুখি হন।
৩. প্রতিষ্ঠানের নীতি ও উদ্যোগ
বেসরকারি বনাম সরকারি ব্যাংক:
-বেসরকারি ব্যাংক: উচ্চ কর্মক্ষমতার চাপ তবে ভালো সুবিধা (যেমন: স্বাস্থ্য বীমা, বোনাস)।
-সরকারি ব্যাংক: চাকরির নিরাপত্তা বেশি তবে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ধীর এবং সুস্থতা কর্মসূচি কম।
-উদ্যোগ: কিছু প্রতিষ্ঠান কাউন্সেলিং, নমনীয় কর্মঘণ্টা বা বিনোদনমূলক কার্যক্রম সরবরাহ করে; কিন্তু বাস্তবায়ন অসঙ্গতিপূর্ণ এবং পর্যবেক্ষণের অভাব রয়েছে।
৪. সামাজিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব**
-শহুরে চ্যালেঞ্জ: ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো শহরে উচ্চ জীবনযাত্রার ব্যয় তুলনামূলক ভালো বেতন সত্ত্বেও আর্থিক চাপ সৃষ্টি করে।
-যাতায়াতের চাপ: যানজট ও অদক্ষ গণপরিবহন নিজের যত্ন নেওয়ার সময় কমিয়ে দেয়।
-সাংস্কৃতিক রীতিনীতি: ‘হাসল কালচার’ অতিরিক্ত কাজকে মহিমান্বিত করে, অন্যদিকে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাকে দুর্বলতা হিসেবে দেখা হয়।
৫. বাহ্যিক চাপ
-নিয়ন্ত্রক চাহিদা: বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশিকা (যেমন: ঋণ আদায়, মানি লন্ডারিং বিরোধী) আমলাতান্ত্রিক চাপ বাড়ায়।
-অর্থনৈতিক অস্থিরতা: মুদ্রাস্ফীতি, মুদ্রার মূল্য হ্রাস ও ঋণখেলাপির কারণে চাকরি-সংক্রান্ত উদ্বেগ তীব্র হয়।
৬. কেস স্টাডি ও তথ্য
- বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) ২০২১ সালের জরিপে দেখা গেছে, ৬৮ শতাংশ ব্যাংকার লক্ষ্যমাত্রা ও কাজের চাপের কারণে দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপে ভুগছেন।
- সংবাদ প্রতিবেদনে বিনা পারিশ্রমিকে অতিরিক্ত কাজ ও মানসিক স্বাস্থ্য সংকটের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের কথা উঠে এসেছে, যেমন ২০২২ সালে একটি বেসরকারি ব্যাংকের শ্রমিকরা ভালো কর্মপরিবেশের দাবিতে ধর্মঘট করে।
৭. সুপারিশগুলো
-নীতি সংস্কার: কর্মঘণ্টা সীমিত করার নিয়ম বাস্তবায়ন এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশিকায় মানসিক স্বাস্থ্য সম্পদের বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা করা।
-করপোরেট দায়িত্ব: সুস্থতা কর্মসূচি প্রসারিত করুন (যেমন: ভর্তুকিযুক্ত জিম, স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট ওয়ার্কশপ) এবং মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খোলামেলা আলোচনা উৎসাহিতকরণ।
-সাংস্কৃতিক পরিবর্তন: মানসিক স্বাস্থ্যের কলঙ্ক দূর করতে মিডিয়া ক্যাম্পেইন ও কাজ-জীবন ভারসাম্য প্রচারকরণ।
-লৈঙ্গিক সমতা: নারী কর্মীদের ধরে রাখতে শিশুযত্ন সহায়তা ও বৈষম্যবিরোধী নীতি প্রণয়নকরণ।
পেশাগত চাপ, সাংস্কৃতিক রীতিনীতি ও অসম প্রতিষ্ঠানিক সহায়তার কারণে বাংলাদেশের ব্যাংকারদের সুস্থতা বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। তাদের সুখবোধ উন্নয়ন ও খাতের টেকসই বিকাশের জন্য সিস্টেমিক পরিবর্তন এবং সামাজিক সচেতনতা অপরিহার্য।
মো. কাফি খান: কলামিস্ট ও কোম্পানি সেক্রেটারি, সিটি ব্যাংক পিএলসি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে