Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

তাণ্ডবে বিধ্বস্ত ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন

Hira  Talukder

হিরা তালুকদার

বৃহস্পতিবার, ২৫ জুলাই ২০২৪

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে স্মরণকালের ভয়াবহতম তাণ্ডবের শিকার হয়েছে গোটা দেশ। আন্দোলনের নামে ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে দুর্বৃত্তদের হিংস্রতার দগদগে ক্ষত ফুটে উঠতে শুরু করেছে। এই তিন সিটি করপোরেশনের ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক তথ্য দেয়া হলেও, ক্ষয়ক্ষতির সম্পূর্ণ তথ্য পেতে আরও কিছুদিন লাগবে বলে জানা গেছে।

এবারের সহিংসতায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) ২০৫ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। বুধবার মিরপুরে সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত ডিএনসিসির আঞ্চলিক অফিস পরিদর্শনকালে তিনি এ কথা জানান।

মেয়র আতিক বলেন, আন্দোলন চলাকালে ডিএনসিসির পাঁচটি আঞ্চলিক অফিসে ভাঙচুর চালানো হয়েছে। ৫০টি গাড়ি পুড়িয়ে ফেলাসহ মোট ৬৭টি গাড়ির ক্ষতি করা হয়েছে। বর্জ্যবাহী ২৯টি গাড়ি সম্পূর্ণভাবে ভস্মীভূত করে দিয়েছে, অফিসারদের ব্যবহারের ২১টি পাজেরো জিপ পুড়িয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া আরও ১৭টি গাড়ি ভেঙে দিয়েছে। আমাদের বর্জ্য পরিবহনের মোট যানবাহনের চারভাগের একভাগ ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। এতে রাজধানীর বর্জ্য নিরসন ব্যবস্থাপনা ব্যাহত হচ্ছে।

মিরপুর-১০ নম্বর ফুট ওভারব্রিজ অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। উত্তরা কমিউনিটি সেন্টার ও মোহাম্মদপুর সূচনা কমিউনিটি সেন্টার সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে।

রামপুরার পাম্প হাউসে সন্ত্রাসীদের ধ্বংসযজ্ঞের কথা তুলে ধরে আতিকুল ইসলাম বলেন, পাম্প হাউস মেরামতের উদ্দেশ্যে আমাদের কর্মীরা সেখানে গেলে তাদের ওপরেও আক্রমণ করা হয়। আমরা স্ট্রিট লাইট মেরামতের জন্য অত্যাধুনিক ল্যাডার এনেছিলাম। সেই ল্যাডারগুলোও তারা ধ্বংস করেছে।

মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, সহিংসতায় ডিএনসিসির মোট ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণের জন্য কমিটি করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণের জন্য কাজ করছে। তবে প্রাথমিকভাবে আমরা যে হিসাব করেছি, ডিএনসিসির অন্তত ২০৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

আন্দোলনের সহিংসতায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রায় ৬ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে জানান ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাসের।

তিনি জানান, প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, আন্দোলনের সহিংসতায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৬ কোটি টাকা। আমাদের তিনটি ডাম্প ট্রাক পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কর্মকর্তাদের তিনটি গাড়ি ভাঙচুর করেছে। যাত্রাবাড়ী, ধানমন্ডি ২৭, এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা কলেজের সামনে রোড ডিভাইডারগুলো (সড়ক বিভাজন) ভেঙে ফেলা হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় ম্যানহোলগুলোর ঢাকনা তুলে ফেলছে, যার আর্থিক মূল্য প্রায় দেড় কোটি টাকা। আজিমপুরে একটা যাত্রী ছাউনি ভেঙেছে। যাত্রাবাড়ীর কাজলার ওদিকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্পের মালামাল নিয়ে গেছে।

আবু নাসের আরও বলেন, ঠিক কতটুকু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার সঠিক হিসাব এখনই বলা যাচ্ছে না। ক্ষতির বিবরণসহ পরবর্তী সময়ে বিস্তারিত জানানো হবে।

কোটা আন্দোলনের আড়ালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ভবন ও এর বিভিন্ন স্থাপনায় দুর্বৃত্তরা হামলা ও আগুন দেয়ার ঘটনায় প্রায় ৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে বৃহস্পতিবার জানান মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী।

তিনি সাংবাদিকদের জানান, আগুন লাগিয়ে দেয়ার আগে দুর্বৃত্তরা ভবনটির ভিডিও এবং র‌্যাকি করে পরিকল্পিতভাবে হামলা চালায়। তবে সিটি করপোরেশনের সার্ভার ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়ায় জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, ওয়াসার বিলসহ অন্যান্য বিষয়ে সমস্যা হবে না। ইন্টারনেট স্বাভাবিক হলেই এসব সার্ভিস স্বাভাবিক হবে।

তিনি বলেন, কোটাবিরোধী আন্দোলনের সুযোগে গত ১৮ ও ১৯ জুলাই নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ভবন ও সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টায় নগরীর দুই নং রেলগেটের মিনি পার্কে স্থাপিত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাংচুর করে ও গাছপালা উপড়ে ফেলে। নগর মিলনায়তনের পাশে সিটি করপোরেশনের বাণিজ্যিক ভবন দোয়েল সিটি প্লাজা-১ ভাংচুর করা হয়। জিমখানা এলাকায় দোয়েল সিটি প্লাজা-৩ এ ভাংচুর করে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। এ দুইদিন নগরীর চাষাড়া থেকে নিতাইগঞ্জ পর্যন্ত নবাব সলিমুল্লাহ রোডের ডিভাইডারের বিভিন্ন অংশের গাছ, ফুলের টব উপড়ে ফেলে দুর্বৃত্তরা। ভেঙে ফেলে ডিভাইডারের বিভিন্ন স্থানের দেয়াল।

১৯ জুলাই শুক্রবার রাত পৌনে ১০টায় নগর ভবনে হামলা চালিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। সিটি কর্পোরেশনের চারটি গাড়ি, ১০টি মোটর সাইকেল, কম্পিউটার, আসবাবপত্রে আগুন লাগিয়ে দেয়। বিনামূল্যে দেয়ার জন্য রাখা বিপুল পরিমাণ ওষুধপত্র, সিটি কর্পোরেশনের বিক্রয়কেন্দ্র এবং সিটি কর্পোরেশনের প্রায় দেড়শ বছর পুরনো হেরিটেজ ভবন ভাংচুর ও লুটপাট করে। নগর ভবন চত্ত্বরে অবস্থিত ওয়ান ব্যাংক ও সিটি ব্যাংক ভাংচুর করে। এছাড়া, আলী আহম্মদ চুনকা নগর পাঠাগার ও মিলনায়তনে দুই দফায় ব্যপক ভাংচুর ও লুটপাট করে দুর্বৃত্তরা

মেয়র আইভী বলেন, পরিকল্পিতভাবে এ হামলা চালানো হয়েছে। সিটি করপোরেশন ভবনে আগুন লাগানোর আগের দিন ভবনের ভিডিও করে নিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন আমাদের সিকিউরিটি গার্ড। তখন তারা এ ভিডিওকে সন্দেহ করেনি। এখন বোঝা যাচ্ছে ভিডিও করাটি ছিল হামলার আগে র‌্যাকির অংশ। নারায়ণগঞ্জে পাসপোর্ট অফিস, সিটি করপোরেশনসহ বেশকিছু সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে নাশকতা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা।

কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন্দ্র করে গাজীপুরে ব্যাপক ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, সরকারি প্রতিষ্ঠানে হামলায় ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। কয়েক দিনের নাশকতার ঘটনায় গাজীপুরের ৬টি প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনায় ৫১ কোটি ৪৯ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম। তবে এ ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে বলে জানান তিনি।

এদিকে, সহিংসতার ক্ষতচিহ্ন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে রাজধানীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। সবচেয়ে বেশি ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে সরকারের উন্নয়নের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত স্থাপনাগুলোতে। সড়কে যানবাহন থেকে শুরু করে সরকারি অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, কিছুই রেহাই পায়নি দুর্বৃত্তদের আগুন সন্ত্রাস থেকে। একদিকে সরকারের ডাটা সেন্টার পুড়িয়ে দেওয়ায় পাঁচ দিন দুর্বৃত্তদের হিংস্রতার দগদগে ক্ষত দেশজুড়েধরে ইন্টারনেটসেবা বন্ধ হয়ে যায়, অন্যদিকে দুটি স্টেশনে নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালানোয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায় স্বপ্নের মেট্রোরেল সেবা। শত শত যানবাহন পুড়িয়ে সৃষ্টি করা হয় অরাজক পরিস্থিতি। এতে স্থবির ও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে নাগরিক জীবন।

গোয়েন্দা সূত্র বলছে, কোটা সংস্কার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশ থেকে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের কয়েক লাখ প্রশিক্ষিত ক্যাডার রাজধানীতে প্রবেশ করে। তারা রাজধানীর প্রবেশমুখ- শনির আখড়া থেকে সাইনবোর্ড, কাজলা থেকে ডেমরা, টঙ্গী থেকে বিমানবন্দর, গাবতলী-আমিনবাজারে অবস্থান নেয়। অনেকে আবার রামপুরা, বনশ্রী, মহাখালী, ধানমণ্ডি ও কুড়িলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশে যায়। এরই মধ্যে সহিংসতার নেপথ্যের অনেক তথ্য বের হয়ে আসতে শুরু করেছে। তবে তদন্তকারী সংস্থাগুলো এখনই সব তথ্য প্রকাশ করতে চাইছে না।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ