বাংলাদেশ ফুটবলে ফিফার আরেকটি ধাক্কা
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) মসনদে বসে আবু নাঈম সোহাগ যে রামরাজত্ব কায়েম করে গেলেন; তা শীর্ষ কর্মকর্তাদের দৃষ্টির বাইরে ছিল না- এ অভিযোগ পুরোনো। এতদিন অভিযোগটা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ২৩ মে বৃহস্পতিবার বিশ্ব ফুটবল সংস্থার (ফিফা) প্রকাশিত প্রতিবেদন প্রমাণ করে দিল- সে চেষ্টা ছিল বৃথা।
বাফুফের সিনিয়র সহসভাপতি ও অর্থ-সংক্রান্ত কমিটির প্রধান আব্দুস সালাম মুর্শেদীকে ১০ হাজার সুইস ফ্রাঁ জরিমানা করেছে ফিফার অ্যাডজুডিকেটরি চেম্বার। টাকায় রূপান্তর করলে অঙ্কটা দাঁড়ায় প্রায় ১২ লাখ ৮৩ হাজার। সাবেক এ ফুটবল তারকা ফিফা আইনের অনুচ্ছেদ-১৪ (সাধারণ দায়িত্ব) ভঙ্গ করেছেন। ফিফার বরাদ্দকৃত অর্থ সংস্থাটির নির্দেশনামাফিক খরচ করার বিষয়ে গাফিলতি করেছেন আব্দুস সালাম মুর্শেদী। প্রতিটি ক্রয় ও অর্থ পরিশোধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এ কর্মকর্তা। দীর্ঘ তদন্তের পর ৫২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা আছে, ফিফার বরাদ্দকৃত অর্থ কোন প্রক্রিয়ায় খরচ করতে হবে এবং বাফুফে কোন প্রক্রিয়ায় খরচ করেছে। ওই খরচগুলোর সঙ্গে কোন কর্মকর্তা কীভাবে সম্পৃক্ত- তাও পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
জাতীয় দলের ওমান সফরের জন্য বিমান টিকিট কেনা, ঘাস কাটার মেশিন কেনা, ফুটবল কেনা, ক্রীড়া সরঞ্জাম কেনার প্রক্রিয়া স্বাভাবিক ছিল না বলে তদন্তে প্রমাণ করেছে ফিফা। অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আব্দুস সালাম মুর্শেদীর ভূমিকার বিশদ বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে ফিফার কাছে লিখিতভাবে নিজের অবস্থান বর্ণনা করেছেন আব্দুস সালাম মুর্শেদী। সবকিছু যাচাইয়ের পর ফিফার অ্যাডজুডিকেটরি চেম্বার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যা আর্থিক স্বচ্ছতার বিষয়ে বাফুফের শীর্ষ কর্মকর্তাদের উদাসীনতার চিত্র চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
উদাসীনতার সুযোগ নিয়ে বাফুফের অভ্যন্তরে অর্থ লোপাটের ভয়ংকর এক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। সে সিন্ডিকেট কাগজ-কলমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে। সে প্রতিষ্ঠানগুলো বাফুফের দরপত্রে অংশগ্রহণ করেছে। শেষ পর্যন্ত মনগড়া সরবরাহের মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছে অর্থ। এ কাজে অনেক সময় প্রতিষ্ঠানটির অর্থ-সংক্রান্ত বিধিকে তোয়াক্কা করা হয়নি।
নগরীতে আবু নাঈম সোহাগের একাধিক ফ্ল্যাট কেনার গুঞ্জন অনেক দিনের পুরোনো। বাফুফের অভ্যন্তরে গড়ে তোলা সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দেওয়ার মাধ্যমে সে গুঞ্জনকে বাস্তবতায় পরিণত করেছেন- এমন গল্পও হরহামেশা হয়েছে। ২০২৩ সালের এপ্রিলে ঘোষিত প্রথম রায় গুঞ্জনটা স্পষ্ট করেছে। জুম সেটআপ কেনা, জিমের সামগ্রী কেনা, ফিফা কনসালট্যান্ট রুমের অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জার কাজ, বাফুফে রেফারি কনসালট্যান্ট রুমের অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জার কাজে করা অনিয়ম সে গুঞ্জনকে দিবালোকের মতো পরিষ্কার করেছে।
উপরোক্ত কেনাকাটা ও কাজের সঙ্গে আবু নাঈম সোহাগের সম্পৃক্ততার বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে ফিফার প্রতিবেদনে। উল্লিখিত কাজের মাধ্যমে ফিফা আইনের কোন ধারা ভঙ্গ করেছেন, সেটাও পরিষ্কার করা হয়েছে। যে কারণে আবু নাঈম সোহাগকে তিন বছর সব ধরনের ফুটবল কর্মকাণ্ডে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে করা হয়েছে ২০ হাজার সুইস ফ্রাঁ জরিমানা। টাকায় এই অঙ্ক দাঁড়ায় প্রায় ২৬ লাখ।
বাফুফের অর্থ-সংক্রান্ত বিষয়ে ফিফার সংশ্লিষ্ট বিভাগ তদন্ত শুরুর পর থেকেই পালানোর পথ খুঁজছিলেন বাফুফের অর্থ বিভাগের সাবেক প্রধান আবু হোসেন। ছুটিতে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দীর্ঘদিন অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করেন তিনি। এরই মধ্যে কানাডায় অভিবাসী হওয়ার জোগাড়যন্ত্র সারেন। ‘সোহাগ-কাণ্ড’ নিয়ে ফুটবলাঙ্গনে যখন টালমাটাল অবস্থা, তখন চাকরি ছেড়ে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন দীর্ঘদিন বাফুফের অভ্যন্তরে নয়ছয় করার জন্য অভিযুক্ত এ কর্মকর্তা। আরেক অভিযুক্ত ছিলেন ম্যানেজার অপারেশন্স মিজানুর রহমান, তিনিও পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন। আবু হোসেনের মতো চাকরি ছাড়েন তিনিও। তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। দুজনকে সব ধরনের ফুটবল কর্মকাণ্ড থেকে ২ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জরিমানা করা হয়েছে ১০ হাজার সুইস ফ্রাঁ করে।
প্রকিউরমেন্ট এবং স্টোর অফিসার ইমরুল হাসান শরীফের ভূমিকাকেও সন্দেহের বাইরে রাখেনি ফিফার তদন্তকারী বিভাগ। সতর্কবার্তার মাধ্যমেই অবশ্য পার পেয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে ফিফার কমপ্লায়েন্স ট্রেনিং নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ইমরুল হাসান শরীফকে।
দুর্নীতির অভিযোগে দেশের ফুটবলে প্রথম ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যাওয়ার পর বাফুফে অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি গঠন করে। দীর্ঘ তদন্তের পর সে কমিটি কিছু সুপারিশও পাঠায়। বর্তমানে বাফুফের বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত কিছু কর্মীর নামও উঠে আসে সে তদন্তে; যাদের বহাল তবিয়তেই দেখা যাচ্ছে।
প্রশ্নটা হচ্ছে, পরপর দুটি ধাক্কার পর কি আদৌ সতর্ক হবে দেশের ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা, না কি ধরন বদলে চলতে থাকবে নয়ছয়? প্রশ্নের উত্তরটা এখনই দেয়া কঠিন। ফিফা প্রকাশিত দ্বিতীয় প্রতিবেদনের পর ফুটবলাঙ্গনে কী প্রতিক্রিয়া দেখা যায়- সেটা দেখার বিষয়। বাফুফের নির্বাচন আসন্ন। বিগত চারটি নির্বাচনের মতো যদি আব্দুস সালাম মুর্শেদী ভোটের লড়াইয়ে থাকেন, তার জন্য কি প্রভাব পড়তে যাচ্ছে ফিফা প্রকাশিত প্রতিবেদনে!
লেখক: সাংবাদিক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে