Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

বৃষ্টির প্রত্যাশায় ব্যাঙের বিয়ে থেকে ক্লাউড সিডিং

Mamun–Or–Rashid

মামুন–অর–রশিদ

রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪

দিন ধরে দেশের প্রধান আলোচনার বিষয় ‘গরম’। বৃষ্টি না হলে এই আলোচনা থামানো কঠিন। আবহাওয়া অধিদপ্তর দেশে তৃতীয়বারের মতো হিট অ্যালার্ট জারি করেছে। বাইরে বের হলে সূর্যের তাপে শরীরের অনাবৃত অংশ পুড়ে যাওয়ার অনূভূতি হয়। গ্রীষ্মের ঠিক এই সময়ে বৃষ্টির জন্য মানুষের হাহাকার দেখা যায়। তবে এই হাহাকার নতুন নয়। সম্ভবত এ কারণেই বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা আমাদের লোকসংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। ধর্মীয় রীতিনীতি মেনেও বহু বছর ধরে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করা হয়। তবে প্রকৃতির এই আচরণকে মানুষ বহু আগেই নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলো ক্লাউড সিডিংয়ের হরহামেশা প্রয়োগ ঘটায়।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের বক্তব্য অনুযায়ী তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তাকে মৃদু তাপপ্রবাহ বলা হয়। তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্য থাকলে তাকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বলা হয়। আর ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠে গেলে তা তীব্র তাপপ্রবাহ। গ্রীষ্মের এই সময়ে যদি বৃষ্টিপাত হলে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। তবে সাধারণত এমনটি খুব একটা ঘটে না। সঙ্গত কারণেই বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা অনিবার্য হয়ে ওঠে। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। খোদ রাজধানীতে মুসলিমরা তাদের ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী ইসতিসকার সালাত আদায় করছেন। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমন সালাত আদায় করা হচ্ছে। এর মধ্যে রাজশাহীতে ব্যাঙের বিয়ে দিয়েছে স্থানীয় মানুষ। তাদের বিশ্বাস এতে বৃষ্টি নামবে। যদিও আবহাওয়া অধিদপ্তর তাদের পূর্বাভাসে বলছে, মে মাসের প্রথম সপ্তাহের আগে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই।

ব্যাঙের বিয়ে
আমাদের লোকসংস্কৃতিতে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনার যে বিষগুলো খুঁজে পাওয়া যায় এর মধ্যে ব্যাঙের বিয়ে অন্যতম। এ ছাড়াও কুলা নামানি, তালতলার শিন্নি, হুদুমদ্যাও পূজা বা মেঘ পূজা, হুদমা গান, পুণ্যিপুকুর ব্রত এর মতো কিছু আচার অনুষ্ঠান খুঁজে পাওয়া যায়। এর মধ্যে ব্যাঙের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় নির্দিষ্ট আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একটি পুরুষ ব্যাঙের সঙ্গে একটি স্ত্রী ব্যাঙকে বিয়ে দেয়া হয়। এই অনুষ্ঠানে মাটি, পানি, বৃক্ষ, এবং প্রাণী ব্যবহার করা হয়। এরপর ব্যাঙ দুটিতে পুকুরে ছেড়ে দেয়া হয়। এই আচার অনুষ্ঠানটি যারা পালন করেন তারা বিশ্বাস করেন এই বিয়ের পর বৃষ্টি নামবে। তবে কবে, কোথায়, কেন এই লোকসংস্কৃতির উদ্ভব ঘটেছিল তার কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা কোথাও পাওয়া যায়নি। হীরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাংলার লোক-উৎসব ও লোকশিল্প, সন্তোষ কুমারের বাঙালি জীবনের লোকাচার বইগুলোতে ব্যাঙের বিয়ের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে।

তালতলার শিন্নি
গ্রাম পেরিয়ে ফসলের মাঠে যেতে আগে চোখে পড়তো সারি সারি তালগাছ। কৃষক কিম্বা রাখাল বালক এই তালগাছের ছায়ায় গা জুড়িয়ে নিতো। বৃষ্টি না হলে অতিখরার সময় গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দুধ, চাল, গুড় চাঁদা হিসেবে তোলা হতো। এসব নিয়ে তালতলায় গিয়ে শিন্নি রান্না করা হতো। শিন্নি খাওয়ার পর উপস্থিত মানুষেরা বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করতেন।

কুলা নামানি
তালতলার শিন্নির সঙ্গে কুলা নামানির একটি মিল রয়েছে। এই পদ্ধতিতে কিশোর অথবা কিশোরীর মাথায় কাঁসার কলসির ওপর কুলাটি রাখা হয়। কলসিতে থাকে সোনা-রূপা ভেজানো পানি। সঙ্গে থাকে একটি আমগাছের ডাল। কুলা বহনকারী সেই কিশোর/কিশোরীর মুখে মাখানো থাকে সাদা চুন ও কালি যাকে মেঘের প্রতীকি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই কুলা নিয়ে এক সঙ্গে অনেক মানুষ গ্রামের বাড়ি বড়ি গিয়ে চাঁদা তোলে। যা দিয়ে খিঁচুড়ি রান্না করা হয়। বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা শেষে সাধারণের মধ্যে খিঁচুড়ি বিতরণ করা হয়।

মেঘ পূজা/কাদা মাখোনো
চৈত্র মাসের মাঝামাঝি থেকে বৈশাখ মাসের শুরুতে মেঘ পূজার আয়োজন করা হয়। নির্দিষ্ট আনুষ্ঠানিকতার পর কেবল নারীরা বৃষ্টির জন্য গীত করে। এখানে পুরুষের কোনো প্রবেশাধিকার নেই। আবার কোনো কোনো এলাকায় বৃষ্টির জন্য নারীরা পানিভর্তি কলসি নিয়ে নির্দিষ্ট কোন বাড়িতে যান। সেখানে পানি ঢেলে কাদা তৈরি করে একে অন্যের গায়ে কাদা ছিটিয়ে দেন। তারা বিশ্বাস করেন এর মাধ্যমেও বৃষ্টি নামতে পারে।

ইসতিসকার সালাত
সহীহ মুসলিম হাদিস শরীফের ১৯৫১ নাম্বার হাদিসে বলা হয়েছে ও আনাস ইবনু মালিক (রা.) বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে, ‘জনৈক ব্যক্তি জুমআর দিনে দারুল কাযার দিকের দরজা দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করল। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে খুতবা দিচ্ছিলেন। ওই ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামলে গিয়ে দাঁড়াল এবং বলল, ইয়া রাসুলাল্লাহ! সম্পদ বিনষ্ট হলো। রাস্তা ঘাট বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। বৃষ্টির জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করুন। আনাস (রাঃ) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উভয় হাত তুলে বললেন, হে আল্লাহ! আমাদের বৃষ্টি দিন। হে আল্লাহ! আমাদের বৃষ্টি দিন। হে আল্লাহ! আমাদেরকে বৃষ্টি দিন। আনাস (রা.) বলেন, আল্লাহর কসম আমরা আকাশে কোনো মেঘ দেখেনি। আমাদের এবং সালা পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে কোনো ঘরবাড়িও ছিল না। হঠাৎ পাহাড়ের পেছন দিকে হতে তীরের ন্যায় এক খণ্ড মেঘ উদিত হলো। যখন তা মধ্যাকাশে পৌঁছাল তখন তা ছড়িয়ে পড়ল। এরপর বর্ষণ শুরু হলো। রাবী বলেন, আল্লাহর কসম, আমরা এক সপ্তাহ পর্যন্ত সূর্য দেখিনি।


পরবর্তী জুমআয় এক ব্যক্তি সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করল। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে খুতবা দিচ্ছিলেন। ওই ব্যক্তি সামনে গিয়ে দাঁড়াল এবং বলল, ইয়া রাসুলুল্লাহ! সম্পদ বিনষ্ট হলো। রাস্তাঘাট নষ্ট হয়ে গেল। আল্লাহর কাছে বৃষ্টি বন্ধ হওয়ার জন্য দুআ করুন। রাবী বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উভয় হাত তুলে বললেন, হে আল্লাহ! আমাদের ওপরে নয়, আমাদের আশপাশে বর্ষিত হোক। হে আল্লাহ! টিলা উপত্যকার মধ্যে এবং গাছগাছালি উৎপন্ন হওয়ার স্থানে। আনাস (রা.) বলেন, তখন মেঘ সরে গেল। আমরা বের হলাম, আর সূর্যের তাপের মধ্য দিয়ে হাটতে লাগলাম। শরিক (রহ.) বলেন, আমি আনাসকে জিজ্ঞাসা করলাম, এ ব্যক্তি কি পূর্বের ব্যক্তি ছিল? তিনি উত্তরে বললেন, আমি জানি না।’ মুসলমানরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বৃষ্টির জন্য ইসতিসকার সালাত আদায় করছেন। চলতি বছরও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসতিসকার সালাত আদায় করছেন।

ক্লাউড সিডিং
কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটানোর ইতিহাস নতুন কিছু হয়। ইতিহাস বলছে ৭৮ বছর আগে ১৯৪৬ সালে ভিনসেন্ট সেইফার সর্বপ্রথম কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের মূলনীতি আবিষ্কার করেন। একই বছরের ১৩ নভেম্বর আরেক নোবেলবিজয়ী বিজ্ঞানী ল্যাংমুরকে সঙ্গে নিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটাতে সফল হোন। এই পদ্ধতিতে মাইনাস ৭৮ ডিগ্রির ড্রাই আইস বিমানে বা রকেটে করে মেঘের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। এতে সঞ্চারণশীল মেঘমালা বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে। বিশ্বের সব দেশ মিলিয়ে যতবার কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটিয়েছে, চীন একাই তার চেয়ে বেশি ঘটিয়েছে। ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিক গেমসে প্রবল বৃষ্টির সম্ভাবনার কথা জানান আবহাওয়াবিদরা। চীনের বিজ্ঞানীরা অলিম্পিক শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগেই প্রচুর কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে সেই আশঙ্কা নাকচ করে দিয়েছিলেন। এভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে থাকে। তবে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটানোর এই প্রক্রিয়া ব্যয়বহুল হওয়াতে চাইলেই এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায় না।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ