Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

সালতামামি ২০২৪

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান এবং শেখ হাসিনার পতন

Kamrul  Hasan

কামরুল হাসান

সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনগুলোর একটি ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ সরকার। দ্বিতীয়বারের মতো দেশের ক্ষমতা নেন শেখ হাসিনা। এর পরে আরও তিনটি নির্বাচন পার করেও ক্ষমতায় টিকে থাকে আওয়ামী লীগ। গত ১১ বছরে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা হারালেও রাজনৈতিক কোনো কারণে নয়, বরং আপাত নিরীহ সরকারি চাকরিতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের তীব্রতায় ক্ষমতা ত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, একক কর্তৃত্বে শেখ হাসিনার সরকার সম্পূর্ণভাবে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। পশ্চিমা বিশ্বকে শত্রু বানিয়ে শেষ পর্যায়ে ভূরাজনীতিতেও প্রায় একা হয়ে পড়েছিলেন তিনি। অবশেষে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। কোটা সংস্কার থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ৫ আগস্ট সরকারি চাকরিতে কোটাপ্রথা চালু করে বঙ্গবন্ধু সরকার। উদ্দেশ্য, মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সামনে এগোনোর সুযোগ এবং সংখ্যালঘুদের সমাজে একাত্ম করে নেয়া।

সর্বশেষ ২০০৯ সালের ২০ ডিসেম্বর জেলাওয়ারি কোটা নির্ধারিত হওয়ায় সরকারি চাকরিতে এর মোট হার দাঁড়ায় ৫৫ শতাংশেরও বেশি৷ মুক্তিযোদ্ধা ৩০, জেলা ১০, নারী ১০ এবং উপজাতি কোটা ৫ শতাংশ- এই ৫৫ শতাংশ কোটায় পূরণযোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সেক্ষেত্রে এক শতাংশ পদে প্রতিবন্ধী নিয়োগের বিধান রাখা হয়৷ ফলে সরকারি চাকরির বাজার মেধার দখলে থাকে অর্ধেকেরও কম মাত্র ৪৫ শতাংশ৷ কোটা প্রথার অপব্যবহারের নিত্যনিয়মিত ঘটনা সামনে আসা এবং বেসরকারি চাকরির বাজারের অস্থিরতায় কোটার প্রতি তরুণ প্রজন্মের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। কোটা প্রবর্তনের ৪১ বছরে ২০১৩ সালে প্রথম কোটা সংস্কার আন্দোলনে নামেন একদল ছাত্র।

২০১৩ সালের ওই কোটা আন্দোলন সফলতার মুখ না দেখলেও ২০১৮ সালে ফের আন্দোলন সংঘটিত হয়। এতে সাড়া দিয়ে তৎকালীন সরকারের মন্ত্রিসভা ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে নবম থেকে ১৩তম গ্রেডে (যেসব পদ আগে প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরি বলে পরিচিত ছিল) নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থাই বাতিল করে দেয়। বিদায়ী বছরে সরকারের জারি করা ওই প্রজ্ঞাপন হাইকোর্ট বাতিল করে দিলে ফের ৫৫ শতাংশ কোটার কবলে পড়ার শঙ্কা থেকে ১ জুলাই থেকে আন্দোলনে নামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এক পর্যায়ে মূল দাবি হিসেবে ‘অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে শুধু সংবিধান অনুসারে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যূনতম কোটা রেখে সংসদে আইন পাসে’ পরিণত হলে এটি হয়ে ওঠে ‘কোটাবিরোধী আন্দোলন।’

এবারের আন্দোলনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ একে সর্বাত্মক করে তোলে। এক পর্যায়ে ছাত্রদের ওপর গুলি চললে সাধারণ জনতা রাস্তায় নামলে বদলে যায় গত এক দশকেরও বেশি আওয়ামী লীগ সরকারের আন্দোলন মোকাবিলার চিত্র। ছাত্র আন্দোলনে যেভাবে পতন ঘটে শেখ হাসিনার। ২০২১ সালে কোটা পদ্ধতি বাতিলের পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্ম কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সভাপতি অহিদুল ইসলাম তুষারসহ সাতজন।

এর পরিপ্রেক্ষিতে এ বছরের ৫ জুন সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। পরদিনই সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা (মুক্তিযোদ্ধা কোটা) পুনর্বহালে হাইকোর্টের ওই রায় বাতিলের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ করেন ছাত্ররা। ৯ জুনের বিক্ষোভ সমাবেশে দাবি মানতে সরকারকে ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন তারা। এ সময়ের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে সর্বাত্মক আন্দোলনেরও ঘোষণা আসে।

১ জুলাই কোটা বাতিলের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে ঢাবির সমাবেশে ৪ জুলাইয়ের মধ্যে চূড়ান্ত সুরাহার আহ্বান জানানো হয়। তিন দিনের কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলনে নামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ৪ই জুলাই সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণার বিষয়ে হাইকোর্টের রায় আপিল বিভাগে স্থগিত হয়নি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৬ জুলাই ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে দেশজুড়ে অবরোধের ডাক দেন আন্দোলনকারীরা।

৭ জুলাই বাংলা ব্লকেডে স্থবির হয়ে পড়ে রাজধানী। অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা। ৮ জুলাই সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে শুধু সংবিধান অনুসারে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যূনতম কোটা রেখে সংসদে আইন পাসের দাবি জানান তারা। পরদিন হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন জানান দুই শিক্ষার্থী। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১০ জুলাই সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিয়োগে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) কোটার বিষয়ে পক্ষগুলোকে চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দেন সর্বোচ্চ আদালত।

চলমান আন্দোলনের মাঝেই ১১ জুলাই প্রথমবারের মতো শক্ত অবস্থানে যাবার আভাস দেয় সরকার। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, শিক্ষার্থীরা ‘লিমিট ক্রস’ করে যাচ্ছেন। ১৩ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রছাত্রীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে তুলে সহিংসতার দিকে ঠেলে দেয়। ১৫ জুলাই সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা চাকরি পাবে?’ সংঘাত আরও বাড়িয়ে তোলে।

১৫ জুলাই কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ স্লোগানের জবাব ছাত্রলীগই দেবে বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেনও আন্দোলনকারীদের দেখে নেবার হুমকি দিলে সংঘাত চলে যায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। ১৬ জুলাই দেশজুড়ে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ হামলা চালায়। রংপুরে আন্দোলনকারী বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়াসিমসহ নিহত হন ছয়জন। পুলিশের বুলেটে আবু সাঈদের নিহত হওয়ার সচিত্র ছবি সারা দেশে দিনভর ব্যাপক বিক্ষোভ ও উত্তেজনার সৃষ্টি করে।

১৮ জুলাই আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচি ঘিরে ঢাকাসহ সারা দেশ বিজিবি মোতায়েন করা হয়। ১৯ জুলাই কোটা সংস্কারের দাবিতে ঢাকায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ ঘটে। আন্দোলনকারীরা জানান, নয় দফা দাবি না মানা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। রাতে সারা দেশে কারফিউ জারি, সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। ইন্টারনেট সেবা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয় সরকার।

২০ জুলাইও দেশজুড়ে কারফিউ চলে, হয় সেনা মোতায়েন। দেশে সাধারণ ছুটিও ঘোষণা করা হয়। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামসহ কয়েকজনকে তুলে নেয়ার অভিযোগ ওঠে। আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক তিন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে আট দফা দাবি পেশ করেন। ২১ জুলাই সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা হিসেবে মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ; মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য পাঁচ শতাংশ; ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী এক শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য এক শতাংশ নির্ধারণ করে রায় দেন সর্বোচ্চ আদালত। কিন্তু এরই মধ্যে ১৬ থেকে ১৯ জুলাই চার দিনে শতাধিক মৃত্যুর প্রতিবাদে বিচার চেয়ে এই আন্দোলন শুধু কোটায় সীমাবদ্ধে না থেকে বৃহত্তর গণআন্দোলনে রূপ নেয়।

২৬ জুলাই থেকে এলাকা ভাগ করে চলে ব্লক রেইড অভিযান। সারা দেশে অন্তত ৫৫৫টি মামলা হয়। নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদারকে নিজেদের হেফাজতে নেয় ডিবি। পরদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরও দুই সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহকেও হেফাজতে নেয়া হয়। ১১ দিনে গ্রেপ্তার হন নয় হাজার ১২১ জন। ২৮ জুলাই সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকেও হেফাজতে নেয় গোয়েন্দা বিভাগ। ডিবির হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয়জন সমন্বয়ক ভিডিও বার্তায় সব কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন, যা বাইরে থাকা অন্য সমন্বয়করা তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেন।

২৯ জুলাই জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিতে বৈঠকে বসে ১৪ দল। ৩০ জুলাই ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ৩১ জুলাই ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ থেকে আসে নতুন কর্মসূচি ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’। ১ আগস্ট ডিবি হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে ছেড়ে দেয়া হয়। এদিন জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার।

৩ আগস্ট সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠে বাংলাদেশ। ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জমায়েত হন শিক্ষার্থীসহ হাজারো জনতা। ৪ আগস্ট সরকার পতনের এক দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচির প্রথম দিনে সারা দেশে ১৮ জেলায় ব্যাপক সংঘাতে মৃত্যু হয় ১১৪ জনের। রাতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসভবন (গণভবন) অভিমুখে যাত্রা এবং গণভবন ঘেরাও কর্মসূচি দেন আন্দোলনকারীরা।

প্রবল গণঅভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ঘোষণা দেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। গণভবন, সংসদ ভবনে ঢুকে পড়ে অসংখ্য মানুষ, চলে ব্যাপক লুটপাট-ভাঙচুর। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আগুন দেয়া হয়। হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির হিসাব মতে, ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত নিহত হন অন্তত ৭৭২ জন। এর মধ্যে ৫ আগস্ট একদিনেই পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের কর্মীদের সঙ্গে সংঘাতে মারা যান ২৯৪ জন।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ