বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করতে যাচ্ছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী এই সংগঠন শিগগিরই একটি নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে। দল গঠনের এই উদ্যোগকে ঘিরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি ছাত্র আন্দোলন মনে হলেও, বাস্তবে এর রাজনৈতিক অভিসন্ধি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, ‘ছাত্ররা দল গঠন করবে এবং এ লক্ষ্যে তারা দেশব্যাপী জনসমর্থন গড়ে তুলছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ছাত্ররা তাদের রক্ত দিয়ে যে অর্জন করেছে তা রক্ষা করা তাদের দায়িত্ব। অন্যথায়, পূর্ববর্তী প্রশাসন ও ক্ষমতালিপ্সু গোষ্ঠীগুলো এসব অর্জন দখল করে নেবে।’ প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্যের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, তিনি এই রাজনৈতিক উদ্যোগের প্রতি শুধু সমর্থনই দিচ্ছেন না বরং এর সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকও বটে।
তবে ড. ইউনূসের এই অবস্থান এবং বক্তব্য অনেকের কাছে বিতর্কিত ঠেকেছে। কারণ, যদিও কাগজে-কলমে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নেতৃত্ব দিয়েছে, তবে এর পেছনে আরও বিভিন্ন সংগঠন ও রাজনৈতিক দল সক্রিয় ছিল। কৌশলগত কারণে সেই সময় সবাই এই ছাত্র সংগঠনকে একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করেছে। বাস্তবে এটি কখনোই পুরো ছাত্র সমাজের একক প্রতিনিধি ছিল না, এখনো নেই।
‘ছাত্ররা রাজনৈতিক দল গঠন করছে’- এমন বক্তব্যও অনেকের কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ, ছাত্রদের মূল দায়িত্ব পড়াশোনা করা, আর একবার শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে গেলে তারা আর ছাত্র থাকেন না বরং নাগরিক হয়ে যান। সুতরাং এটি মূলত ছাত্রদের উদ্যোগ নয় বরং নাগরিকদের রাজনৈতিক উদ্যোগ। তদুপরি, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার উচিত নিরপেক্ষ থাকা; কিন্তু যখন তিনি ছাত্রদের দল গঠনের উদ্যোগকে সমর্থন দেন, তখন তিনি কার্যত নিরপেক্ষতার সীমা অতিক্রম করে একটি পক্ষের অবস্থান গ্রহণ করেন। এটি রাজনৈতিকভাবে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে, সেটি এখনো বিতর্কের বিষয়। অতএব, নতুন এই রাজনৈতিক সমীকরণ দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে কী প্রভাব ফেলবে এবং জনগণের কাছে এটি কতটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে তা সময়ই বলে দেবে।
প্রশ্ন উঠেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রাজনৈতিক চরিত্র নিয়েও। কেউ কেউ এটিকে জামায়াতে ইসলামীর নতুন ভার্সন হিসেবে অভিহিত করছেন। আবার অনেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে জামায়াতের চেয়েও বেশি প্রতিক্রিয়াশীল এবং পশ্চাৎমুখী হিসেবে চিহ্নিত করছেন।
জামায়াতে ইসলামী মুক্তিযুদ্ধকে সরাসরি অস্বীকার না করলেও, তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করে একটি ভিন্ন বয়ান তৈরি করার চেষ্টা করে। অন্যদিকে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গত পাঁচ মাসের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এটাই প্রদর্শন করেছে যে, মুক্তিযুদ্ধকে তারা কখনো অস্বীকার করে, আবার কখনো নীরব থাকে এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরিবর্তে ১৯৪৭ এবং ১৯২৪ সালের ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোকে তাদের রাজনৈতিক ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। তাদের এই অবস্থান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মুছে ফেলার চেষ্টার সমতুল্য।
আর এই সুযোগটাই নেয়ার চেষ্টা করছে বিএনপি। বিএনপি অতীতে জামায়াতের সঙ্গে জোট করে সরকার পরিচালনা এবং যৌথভাবে আন্দোলন-সংগ্রাম করলেও এখন জামায়াত ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে একই কাতারে ঠেলে দিচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই দুই সংগঠনের অবস্থানকে সমালোচনা করছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়। এটি শুধু একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয় বরং জাতিরাষ্ট্র গঠনের মৌলিক ভিত্তি। বিএনপি সাধারণ মানুষের এই মনোভাবটিকেই কাজে লাগাতে চাইছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রাজনীতি এখন পর্যন্ত যা দেখা গেছে, সেটা মূলত ধর্মভিত্তিক। তারা ধর্মকে ব্যবহার করে দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। এ কারণেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে সামনে এনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জামায়াতের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক ধরনের ‘মধুচন্দ্রিমা’ লক্ষ করা যাচ্ছে। বিএনপি চেষ্টা করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত করে তাদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করতে। এই বাস্তবতায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তাত্ত্বিক নেতা উপদেষ্টা মাহফুজ আলম সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধকে মহান হিসেবে উপস্থাপন করে এক ফেসবুক পোস্ট দিয়ে বিএনপির সমালোচনাকে থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যাদের মূল লক্ষ্য হলো একটি জনভিত্তি তৈরি করা এবং একটি রাজনৈতিক দল গঠন করা। তাদের আন্দোলনের সহযোদ্ধা হিসেবে হাসিনাবিরোধী সব পক্ষই রয়েছে; কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নিজস্ব কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। এই পরিচয় গঠনের জন্যই তারা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক মাঠে মূলত তিনটি বড় শক্তি রয়েছে: আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী। এর বাইরে রয়েছে জাপা, বামপন্থি দল, ইসলামী গোষ্ঠী এবং সুশীল সমাজ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লক্ষ্য হলো এই শক্তিগুলোর মধ্য থেকে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করা। সুশীল সমাজ এবং বামপন্থি দলগুলো ইতোমধ্যেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে সমর্থন দিচ্ছে; কিন্তু তাদের ভোটের রাজনীতিতে কোনো প্রভাব নেই। রংপুরের বাইরের জাপা এবং ইসলামী গোষ্ঠীগুলো মূলত বিএনপিপন্থি। তাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে মূলত আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জামায়াতের দিকে নজর দিতে হবে।
আওয়ামী লীগের দিকে তাদের তেমন সুযোগ নেই, কারণ আওয়ামী লীগ এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্রকাশ্য শত্রু। তবে আওয়ামী লীগের মধ্যে একটি সুবিধাবাদী গ্রুপ রয়েছে, যারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হতে চাইবে; কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তাদের নিতে চাইবে না, কারণ এটি বিতর্ক তৈরি করতে পারে। জামায়াতে ইসলামীর মতো চেইন অব কমান্ড ও বিশেষ মতবাদপুষ্ট নেতাকর্মীরা ভিন্ন কোনো দলে যাবে, এটা আশা করাটা দুরাশামাত্র। বাকি থাকে বিএনপি। তাই মূল খেলাটা বিএনপির সঙ্গে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং বিএনপির মধ্যে দখলদারিত্ব এবং নিজেদের অবস্থান রক্ষার লড়াই চলবে।
বিএনপির সুবিধাবাদী একটি অংশকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন টার্গেট করছে এবং স্থানীয় পর্যায়ে তাদের রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে।
অনেকের অভিযোগ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় একটি ‘কিংস পার্টি’ গঠনের পরিকল্পনা করছে। প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রাজনৈতিক ভিত্তি গঠনের জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। উদাহরণস্বরূপ, স্থানীয় সরকার বিলুপ্ত করে নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তিকে প্রশাসনের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে যা ভবিষ্যতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অনুগত শক্তি হিসেবে কাজ করবে।
এদিকে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া বিএনপি ও আওয়ামী লীগের উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপি চায় দলকে একতাবদ্ধ রাখতে আর আওয়ামী লীগ চায় রাজনৈতিক পুনর্বাসন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ ছাড়া সরকার নির্বাচন দিতে যাবে না এবং এই চাপ তখনই আসবে যখন জনগণ প্রকৃতপক্ষে নির্বাচন চাইবে। সেই লক্ষ্যে দলদুটো আন্তর্জাতিক মহলে লবিং চালিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে এবং প্রতিদিনই নতুন নতুন সমীকরণ তৈরি হচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যে রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করছে তা এরশাদ জমানার রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে তুলনীয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যদি সফল হয়, তাহলে বিএনপির জন্য তা মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। তবে আওয়ামী লীগ এখনো শেষ হয়ে যায়নি এবং নতুন নেতৃত্বের মাধ্যমে তারা রাজনীতিতে নতুন মোড় আনতে পারে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রাজনৈতিক কৌশল এবং এর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবস্থান বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে কেন্দ্র করে যে লড়াই চলছে তা ভবিষ্যতে আরও জটিল ও উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উত্থান ও তাদের রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য কীভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবর্তন আনবে তা নির্ভর করবে আগামী দিনের ঘটনাপ্রবাহের ওপর।
চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে