নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা ও যুবকদের ভোটাধিকার
নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ হবে কি না- মানুষের মধ্যে এ নিয়ে সংশয়, শঙ্কা ও উদ্বেগ দিন দিন বাড়ছে। শুধু নির্বাচন নয়, এটা নিয়ে নানা ডালপালা গজাচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর হওয়ার লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। জনজীবনের অন্যান্য সংকট বাড়লেও সবকিছু ছাপিয়ে নির্বাচনের আলোচনা সামনে চলে আসছে। নির্বাচন এমন একটি সময়- যখন দেশের মানুষ উৎসবমুখর পরিবেশে তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে তাদের নেতৃত্ব বেছে নেওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু তার বদলে দুই শীর্ষ রাজনৈতিক দলের পরস্পরের প্রতি দড়ি টানাটানি দেখতে ক্লান্ত। আওয়ামী লীগ চায় শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশ নিতে, আর বিএনপি ও অন্যান্য দলের দাবি এর সম্পূর্ণ বিপরীত।
এটা সত্য যে, বিরোধীদল হিসেবে বিএনপি গত ১৫ বছরে জনগণের সামনে হাজির হতে পারেনি। মাঝে মাঝে ঈদের পর ‘আন্দোলনের’ হুমকি দিয়ে স্বস্তির সময় পার করেছে দলটি। তারা সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে কোনো গবেষণামূলক, গভীর ও তথ্যভিত্তিক সমালোচনা না করে ঢালাওভাবে কেবল একটাই দাবি করে যাচ্ছে, ‘সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে’। বিএনপির এ আন্দোলন নিছক আন্দোলন নয়, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য একটা নিরাপদ পথ খুঁজছে। স্বাভাবিকভাবে বিএনপির আন্দোলনের গতিমুখ নিয়ে আমাদের ইত্যাদি প্রশ্ন তৈরি করে।
বিএনপি ১৯৯৪-৯৬ সালে ক্ষমতায় ছিল। আওয়ামী লীগ তখন ক্ষমতাসীন দলের ওপর ভরসা করা যায় না- এই যুক্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানায়। সেই সময়ে বিএনপির যুক্তি ছিল, তারা ‘সংবিধানের বাইরে’ যেতে পারবে না। মজার ব্যাপার হলো- ২৭ বছর পরেও আমরা ঠিক একই সমস্যায় আটকে আছি, কিন্তু দল দুটির অবস্থান পুরোপুরি উল্টে গেছে। এই রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশে মারাত্মক রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, আমাদের গত ৩২ বছরের সব অর্জনকে ব্যর্থ করে দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছে।
২০১৪ ও ২০১৮, ওই দুই বছরে ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতা ভোটারদের জন্য সুখকর নয়। ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩ জন সংসদ সদস্য ‘নির্বাচিত’ হন। ৩০০ আসনের সংসদের ক্ষেত্রে বলা যায়, সরকার গঠনে বেশিরভাগ সদস্যই একটি ভোটও না পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। অভিযোগ আছে ২০১৮ সালের নির্বাচনে আগের রাতে ভোট দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এই ঢালাউ অভিযোগকারী বিরোধী দলগুলো এখনও রাতে ভোটের কারচুপির তথ্যসহ দালিলিক প্রামণ হাজির করতে পারেনি। কাজেই সামগ্রিকভাবে দেশের গণতন্ত্র পরিসর সংকুচিত হওয়ায় বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে এখন ‘হাইব্রিড গণতন্ত্র’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এরকম নির্বাচন হলে বাংলাদেশ আর গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সামিলে থাকবে কি না, সেটা বড় প্রশ্ন। এদিকে হঠাৎই বিদেশি শক্তি বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ‘অতিসক্রিয়’ হয়ে উঠেছে।
আওয়ামী লীগ দৃশ্যতই নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে। কয়েকদিন ধরে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারি দলের সব নেতারাই তাদের বক্তৃতায় ‘নৌকা’ মার্কায় ভোট চাওয়া শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও তাদের জোট এবং পরোক্ষ মিত্ররা ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক দলকেই নির্বাচন নিয়ে প্রস্তুতি নেওয়ার মতো অবস্থা দেখা যাচ্ছে না। বিএনপি, বিএনপির জোট এবং বিএনপির সঙ্গে অন্য বেশ কিছু ছোট ছোট দল মিলে সরকার উৎখাতের আন্দোলনে আছে। সিপিবি, বাসদ এবং তাদের সমর্থিত বাম গণতান্ত্রিক জোট সীমিত সামর্থ্য নিয়ে ভোটাধিকারের আন্দোলনে ময়দানে আছে।
দেশের মানুষের ভোটাধিকার ও নির্বাচন নিয়ে এই সংকট নতুন কিছু নয়। ১৯৯০ এর ৬ ডিসেম্বর এরশাদ স্বৈরাচারের পতনের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় মানুষের ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার হলেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দলীয় সরকারের আওতায় মানুষ নিজের ভোট নিজে কতটা দিতে পেরেছে তা সকলেই জানেন। তাদের ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়ার লড়াইয়ের কারণে মানুষের ভোটাধিকার বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুই দলের এই ক্ষমতার লড়াইয়ের সুযোগ নিয়ে আগেও হস্তক্ষেপ করেছে বিদেশিরা, এইবারও আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করছে। যা আমাদের দেশ ও জাতির জন্য অপমানজনক, একই সঙ্গে ব্যর্থতাও।
ভোট মানুষের অধিকার। আসন্ন নির্বাচনের আগে মানুষ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের প্রত্যাশা নিয়ে কথা বলবে, সেটা তো স্বাভাবিক চাওয়া। ভোট দিতে পারবেন এমন একটি নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছেন বাংলাদেশের মানুষ তথা যুবকরা। গত দুটি নির্বাচনে ৫৩ দশমিক ৮ শতাংশ যুবক সে সুযোগ পায়নি (নাগরিক প্ল্যাটফর্মের যুব জরিপ) । সেই যুবকরা ‘ভোট দিতে চাই’ এমন দাবি জোরালো করছে। এই দাবিতে ঢাকায় ছাত্র ও যুবকদের সংগঠনগুলো নিয়মিত কর্মসূচি পালনও করছে। কখনো সমাবেশে বক্তব্য দিয়ে, কখনো মিছিলে গলা মিলিয়ে, আবার কখনো প্ল্যাকার্ড তুলে ‘ভোট দিতে চাই’ দাবি জানাচ্ছে তারা। বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলো এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ভোট দিতে চাই’ ব্যানারে শাহবাগে সমাবেশ ও মিছিল করে।
দেশে এখন যুব ভোটারের সংখ্যা আড়াই কোটির বেশি। তাদের বেশির ভাগেরই জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতা হয়নি। অথচ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পহেলা আলাপ হলো, নির্দিষ্ট সময় পরপর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভোটাররা তাদের পছন্দের দল বা প্রার্থীকে বেছে নেওয়ার অধিকার পাবেন। প্রথম ভোট ঘিরে যুবকদের আবেগ যেমন থাকে তুঙ্গে, আবার ভোটের ফলাফল নির্ধারণে তাদের ভূমিকাও থাকে গুরুত্বপূর্ণ। যেটা আমরা ২০০৮ সালের নির্বাচনে দেখেছি। যুবকদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সেবার আওয়ামী লীগে মহাবিজয় লাভ করে।
বাংলাদেশে কে কোন দলের সমর্থক হবে, সেটা অনেকটা নির্ধারিত হয় পারিবারিক সূত্রে। কিন্তু যুবকদের বড় একটা অংশ আবার পারিবারিক ঐতিহ্য ভেঙে ভিন্ন দল কিংবা নতুন রাজনীতি বেছে নিতে পিছপা হন না। তারা অনেকটাই স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক মত বেছে নেন। সে কারণেই আমরা দেখি, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ছয় বছরের মাথায় মুসলিম লীগ পরিবারের সন্তানেরা সেই দলের রাজনীতিকে নাকচ করে দিয়ে আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন।
যুবকদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে বৈশ্বিক রাজনৈতিক বাতাবরণ নিশ্চিত করেই একটা জোরালো ভূমিকা রাখে। সে কারণেই কখনো বামপন্থী জোয়ারে, আবার কখনো জাতীয়তাবাদী জোয়ারে, কখনো ধর্মীয় ও জাতিগত আত্মপরিচয়ের রাজনীতিতে গত কয়েক প্রজন্মের যুবকরা প্রভাবিত হয়েছেন। কিন্তু যুবকদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আন্টি-ইনক্যাম্বেন্সি বা বিদ্যমান শাসনের প্রতি অনাস্থাটা প্রবলভাবে কাজ করে। সে কারণেই সুষ্ঠু ও অবাধ পরিবেশে নির্বাচন হলে যুবকদের ভোট জয়-পরাজয় নির্ধারণে নির্ধারক ভূমিকা পালন করে।
ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে বাংলাদেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ভিত্তি গড়ে তুলেছেন ছাত্র-যুবকরাই। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরপরই কলকাতা থেকে আসা ছাত্র নেতৃত্ব ও ঢাকার ছাত্র নেতৃত্ব মিলে গড়ে তোলেন গণতান্ত্রিক যুবলীগ। বলা চলে, এ ভূমির গণতান্ত্রিক আন্দোলনের গোড়াপত্তন। এরপর ১৯৫২ থেকে শুরু করে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সব কটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে পথ দেখিয়েছে তরুণেরা। এমনকি ২০০৮ সালের আগস্টে জরুরি অবস্থা অবসানের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন ছাত্র-যুবকরা। অথচ দেড় দশকের মধ্যে রাজনীতিতে যুবকরা এতটাই প্রান্তিক হয়ে পড়েছেন যে ‘ভোট দিতে চাই’ দাবি জানিয়ে তাদের আন্দোলন করতে হচ্ছে।
অতিসম্প্রতি নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত যুবজরিপ অনুযায়ী জনবিন্যাসে যুবকরাই দেশের প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের গরিষ্ঠসংখ্যক। অথচ রাষ্ট্রের উন্নয়নদর্শন কিংবা গণতন্ত্র- কোনোটাই যুবকদের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করতে পারছে না। তাদের আশাহীনতা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বাইরে রেখে কোনো উন্নয়নই টেকসই হতে পারে না। এই জরিপে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ যুবক বলেছেন, সুযোগ পেলে তারা স্থায়ীভাবে বিদেশে চলে যাবেন। এই যুবকদের বেশির ভাগই উচ্চশিক্ষিত। আমাদের রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা কি কখনো জানতে চেয়েছেন, কেন তারা দেশ ছাড়তে চাইছেন? জরিপের তথ্য অনুযায়ী, রাজনীতি ও ছাত্ররাজনীতিতে আগ্রহী মাত্র ১১ দশমিক ৬ শতাংশ যুবক। অন্যদিকে রাজনীতি নিয়ে অনাগ্রহী যুবকদের সংখ্যা আগ্রহী যুবকদের চেয়ে তিন গুণ বেশি (৩৫ দশমিক ২ শতাংশ)। ৫৩ দশমিক ৮ শতাংশ যুবক জানিয়েছেন, তারা জাতীয় নির্বাচনে কখনো ভোট দেননি।
ভোটাধিকারের জন্যে রাস্তায় নেমে যুবকদের দাবি তুলতে হচ্ছে। অথচ আমাদের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের গৌরবজনক ইতিহাস অনেকের চেয়ে সমৃদ্ধ। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের বয়সও ৫২ বছর পেরিয়েছে। এতগুলো বছরেও ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলগুলো একটা নির্বাচনী ব্যবস্থা ও সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। অথচ রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে পা দেওয়া নেপাল এবং কয়েক লাখ মানুষের দ্বীপদেশ মালদ্বীপও একটা গ্রহণযোগ্য ও স্বস্তিদায়ক নির্বাচনী সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো দিল্লি বা ওয়াশিংটনের দিকে মুখ চেয়ে না থেকে কিংবা আমলাতন্ত্র ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল না হয়ে কবে গণতন্ত্রের চর্চা করতে শিখবে? যুবকদের যদি প্রান্তিক করেই দেওয়া হয়, তাহলে রাজনীতিবিদেরা কাদের জন্য রাজনীতি করেন?
সম্প্রতি ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘তলে তলে আপস হয়ে গেছে। চিন্তার কিছু নেই।’ তাহলে কি আপসের ওপর ভর করে আওয়ামী লীগ আবারও একতরফা নির্বাচন করবে? নাকি বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা ভাগাভাগির আপস হয়েছে? কোনো শঙ্কাই এখন উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। গত ১৫ বছরে আমরা এটাও দেখেছি, বিএনপির নেতৃস্থানীয় নেতারা মামলা নিয়ে সন্তুষ্ঠ থাকতে। মার খেয়েছে তাদের কর্মীরা। তলে তলে নেতারা আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়েছে। তাহলে আমরা ভোটাররা কোথায় আছি? এবার নির্বাচনের ‘ফল’ নিয়ে বহির্শক্তির সঙ্গে ‘দর-কষাকষি’ চলছে। এভাবেই কি বাংলাদেশে গণতন্ত্র কাজ করছে? এটাই কি আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের সেই ‘খেলা হবে’? মনে হচ্ছে আমাদের নির্বাচন ‘ফেয়ার প্লে’ নয়, বরং ‘ম্যাচ ফিক্সিং’য়ের উদাহরণ হতে যাচ্ছে।
ইতিহাসে যুবকরা সবচেয়ে বেশি অসংগঠিত, স্বপ্নহীন ও রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয়। ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন কিংবা অন্যান্য ছাত্রসংগঠনে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী যুক্ত থাকলেও প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ যুবকরা রাজনীতিতে আগ্রহী নন। বাংলাদেশে যুবকদের নিয়ে খুব একটা জরিপ হয় না। ‘২০১৯ সালে তরুণেরা কী ভাবছেন’ এই শিরোনামে একটি গণমাধ্যম যে জরিপ করেছিল, তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রায় ৫৭ শতাংশ যুবক রাজনীতির প্রতি অনাগ্রহী। এসব যুবকদের অধিকাংশ রাজনীতি প্রতি বিক্ষোভ থেকে বিদেশে চলে যাচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে?
বড় দুইটি রাজনৈতিক দল, যারা ক্ষমতা দখলের জন্য যতই পরস্পরের সঙ্গে বৈরিতা থাকুক, রাষ্ট্রীয় নীতি আদর্শের প্রশ্নে ওদের মধ্যকার বিভেদ অনেকাংশেই কমে এসেছে। দুনিয়াব্যাপী নব্যউদারনীতিবাদের দোর্দণ্ড প্রতাপের ফলে দেশের অর্থনৈতিক নীতির প্রশ্নে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে এখন মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। দুই দলই বাজার অর্থনীতির বাইরে যেতে রাজি না। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ছাড়াও, একসময় যাদের বামপন্থী বা সমাজতন্ত্রী দল হিসেবে চিহ্নিত করা যেত, ওরাও অর্থনৈতিক নীতির প্রশ্নে এখন আর মুখ ফুটে সমাজতন্ত্রের কথা কেউ বলে না। অন্যভাবে বললে, সিপিবি-বাসদ ও অন্য দুই একটি ছোট দল ছাড়া দেশের মধ্যে একরকম ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে দেশে বাজার অর্থনীতিই থাকবে। এমনকি ধর্মনিরপেক্ষতার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি, যেটা ছিল আমাদের স্বাধীনতার অন্যতম মৌলিক ভিত্তি, প্রশ্নটিও যেন পেছনে পড়ে গেছে।
এটার নানাপ্রকার প্রভাব পড়েছে আমাদের দেশের রাজনীতিতে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সুস্পষ্ট কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ না থাকার ফলে ছাত্ররা প্রতিদিন আরও বেশি করে রাজনিতিবিমুখ হতে থাকবে আর ওদের চিন্তার জগতে এই আদর্শগত শূন্যতা পূরণ করবে সাম্প্রদায়িকতা। আশঙ্কার ব্যাপার হচ্ছে যে, এই অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে চরম সাম্প্রদায়িক যেসব গোষ্ঠী দেশে বিদ্যমান আছে, যেমন হেফাজতে ইসলাম এবং ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো, তারা সুযোগটা নিবে এবং চেষ্টা করবে যতটুকু পারা যায় রাজনৈতিক ক্ষেত্র দখল করা যায় সেটা করে নিতে। ইতোমধ্যে ওরা সরকারের সঙ্গে নানারকম সমঝোতা করে একটা অবস্থান তৈরি করেছে। এখন যেহেতু নির্বাচন চলে আসছে, এখন ওরা নির্বাচনে সমর্থন দেওয়ার লোভ দেখিয়ে সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে নিয়ে আসার চেষ্টা করবে। এমনকি আশঙ্কা করা যায় যে, বাংলাদেশ তার উদারনৈতিক চরিত্রও হয়তো হারিয়ে ফেলবে অনেকখানি।
আরেকটা বড় প্রভাব হতে পারে যে আমাদের যুবকদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটবে। প্রথমত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সুস্পষ্ট কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ না থাকার ফলে ছাত্ররা প্রতিদিন আরও বেশি করে রাজনিতিবিমুখ হতে থাকবে আর ওদের চিন্তার জগতে এই আদর্শগত শূন্যতা পূরণ করবে সাম্প্রদায়িকতা।
নির্বাচন আর ক্ষমতা দখলের কায়দাকানুন নিয়ে কলহ করতে করতে যখন রাজনৈতিক দলগুলো একেকটা নীতিহীন, আদর্শহীন ও রাজনীতিহীন বিরাজনৈতিক দলে পরিণত হতে থাকবে তখন ছোট ছেলেমেয়েরা বড় হতে থাকবে রাজনীতিবিমুখ নীতিহীন ও সাম্প্রদায়িক ফ্যান্টিক হিসেবে। সেইরকম ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্যে মোটেই সুখকর হবে না।
এবারও যদি ভোট না দিতে পারেন তবে সবচেয়ে চড়া মূল্য দেবেন যুব সমাজ, যেটা হয়তো অদূরে ভিত্ নাড়িয়ে দিবে। ভোটের অধিকার ছাড়া যে প্রজন্ম গড়ে উঠেছে, তাদের মনে যে ক্ষোভ, হতাশা ও হাহাকার তৈরি হচ্ছে, তা খেসারত অনেক দীর্ঘ হবে। যুবকদের একাংশ দেশত্যাগ করতে চাইছেন, আরেক অংশ রাজনীতির প্রতি অনাস্থা জানাচ্ছে। এই অবস্থার পরিবর্তন না হলে দেশ ও জাতির জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক। প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, কেন্দ্রীয় কমিটি
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে