খেলাপি ঋণ সৃষ্টির জন্য ঋণগ্রহীতা নাকি ব্যাংকার বেশি দায়ী?
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মোতাবেক, দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। এটা ব্যাংকগুলোর মোট ছাড়কৃত ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। গত জুলাই মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। সে হিসাবে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। বর্ণিত সময়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ২৩ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৪৯ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে সেই সময় খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিগত সাড়ে ১৫ বছরে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ২ লাখ ৬২ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। যদিও বিগত সরকার আমলে একাধিকবার ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাবে না বলে অঙ্গীকার করা হয়েছিল; কিন্তু সেই অঙ্গীকার রক্ষিত হয়নি। বরং নানাভাবে ঋণখেলাপি কালচারকে প্রণোদিত করা হয়েছে।
গত সেপ্টেম্বর কোয়ার্টারে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৬ হাজার ১১১ কোটি টাকা আর ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকে এটা ছিল ১ লাখ ৪৯ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা। এক সময় ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে দুর্নীতি এবং স্বচ্ছতার দিক থেকে এগিয়ে রাখা হতো; কিন্তু এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতেও এখন পাল্লা দিয়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বিগত সরকার আমলে দেশের অর্থনীতির হৃদপিণ্ড হিসেবে খ্যাত ব্যাংকিং খাত এবং রাজস্ব খাতকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। তার এই মন্তব্য আক্ষরিক অর্থেই ঠিক; কিন্তু প্রশ্ন হলো, ব্যাংকিং খাতের এই দুরবস্থার জন্য কারা দায়ি ঋণ গ্রহীতা নাকি ব্যাংকারদেরও এখানে দায় রয়েছে? আমাদের দেশে ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থা নিয়ে যখন আলোচনা হয় তখন অনিবার্যভাবে পুরো দায়ভার ঋণ গ্রহীতাদের ওপর চাপানো হয়। দুর্নীতিবাজ ব্যাংক কর্মকর্তারা দৃশ্যপটের আড়ালেই থেকে যান।
একটি দেশের অর্থনীতিতে ব্যাংকিং খাত হচ্ছে ধমনিতে রক্ত প্রবাহের মতো। কোনো কারণে ধমনিতে রক্ত প্রবাহ কোনো কারণে বন্ধ হয়ে গেলে মানুষের মৃত্যু অনিবার্য হয়ে উঠে। তেমনি কোনো দেশের ব্যাংকিং খাত যদি সঠিকভাবে কাজ না করে তাহলে সেই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হতে পারে না। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের উদ্যোক্তারা সব সময়ই পুঁজি স্বল্পতায় ভুগেন। তারা পুঁজি চাহিদা পূরণের জন্য ব্যাংক এবং পুঁজিবাজারের ওপর নির্ভর করে থাকেন; কিন্তু বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এখনো সেভাবে বিকশিত হতে পারেনি। এ ছাড়া সাম্প্রতিক নিকট অতীতে পুঁজিবাজারে বেশ কয়েক বড় ধরনের বিপর্যয় সংঘটিত হবার কারণে সাধারণ মানুষ এখন আর পুঁজিবাজারের ওপর তেমন একটা আস্থা রাখতে পারছেন না।
উদ্যোক্তারা তাদের পুঁজি চাহিদা মেটানোর জন্য সবার আগে ব্যাংকিং খাতের ওপরই নির্ভর করেন; কিন্তু ব্যাংকিং খাত তাদের সেভাবে সহায়তা দিতে পারছে না। নানা ধরনের অনিয়ম আর দুর্নীতি এই খাতকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ফলে ব্যাংকিং খাত থেকে কাঙ্খিত মাত্রায় সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। একটি দেশের ব্যাংকিং খাতের অবস্থা জানতে হলে বিভিন্ন সূচকের প্রতি দৃষ্টি দিতে হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচক হচ্ছে খেলাপি ঋণের অবস্থা। খেলাপি ঋণের অবস্থা দেখলেই একটি দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রকৃত অবস্থা অনেকটাই অনুধাবন করা যায়। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। কোনোভাবেই খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা রোধ করা যাচ্ছে না। ব্যাংকগুলো ঋণ দিচ্ছে কিন্তু সেই ঋণের কিস্তি সঠিক সময়ে নিয়মিত আদায় করতে পারছে না। ফলে অধিকাংশ ব্যাংকই তারল্য সংকটে ভুগছে। খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়েই চলেছে।
যে কোনো দেশের ব্যাংকিং খাতে দুধরনের ঋণখেলাপি থাকেন। এদের মধ্যে এক শ্রেণির ঋণখেলাপি আছেন, যারা নানা অনিবার্য কারণে গৃহীত ঋণের কিস্তি সঠিক সময়ে প্রদান করতে পারেন না। এরা ইচ্ছা থাকলেও সামর্থ্যের অভাবে গৃহীত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারেন না। এরা প্রকৃত ঋণখেলাপি। আর একটি শ্রেণির ঋণ গ্রহীতা আছেন যারা অত্যন্ত ক্ষমতাবান এবং সব সময়ই সরকারি দলের সাহচর্যে থাকেন তারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেন না। এদের অনেকেই ব্যাংক থেকে সুনির্দিষ্ট প্রকল্পের নামে ঋণ গ্রহণ করে তা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করেন। এমনকি বিদেশে পাচার করে থাকেন। এরা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। এরা ব্যাংকিং খাতের জন্য সবচেয়ে বড় আপদ। বিভিন্ন সময় যখনই খেলাপি ঋণ এবং ব্যাংকিং খাতের সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয় তখন আলোচনার মূল ফোকাস থাকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের ওপর; কিন্তু আমরা সাধারণত কোনো আলোচনাতেই ব্যাংকের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের প্রসঙ্গ উত্থাপন করি না। একজন ব্যাংকার যদি শতভাগ সততা এবং দৃঢ়তার সঙ্গে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন, তাহলে প্রদত্ত ঋণখেলাপি হবার আশঙ্কা খুব একটা থাকে না। যারা ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে খেলাপি হন তাদের সঙ্গে ব্যাংকের এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার যোগসাজশ থাকে। ব্যাংকারদের সহায়তা ব্যতীত কোনো ঋণ গ্রহীতার পক্ষে খেলাপি হওয়া প্রায় অসম্ভব।
দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা দ্বৈত নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাংকিং খাত নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকলেও বাস্তবে তারা মূলত ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে। রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব দেয়া হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ওপর। এমনকি ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ তাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। বিগত সরকার আমলে সর্বশেষ যখন অর্থ মন্ত্রণালয় যখন ব্যক্তি মালিকানায় ৯টি নতুন ব্যাংক স্থাপনের অনুমোদন দেবার উদ্যোগ গ্রহণ করে তখন বাংলাদেশ ব্যাংক তাতে আপত্তি উত্থাপন করে বলেছিল, দেশে এত বেশি ব্যাংক স্থাপনের আবশ্যকতা নেই; কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের সেই আপত্তি ধোপে টেকেনি। সেই সময় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছিলেন, দেশে নতুন ব্যাংকের কোনো স্থাপনের আবশ্যকতা নেই; কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনায় ৯টি নতুন ব্যাংক স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হলো। রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হলে তার পরিণতি কি হয় তা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। প্রতিটি দেশেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে; কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সংস্থার নিয়ন্ত্রণে কাজ করে থাকে।
বিশেষ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর খবরদারি করে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নরের আগে অন্তত দুজন গভর্নর ছিলেন যারা সরকারের আমলা। তারা দায়িত্ব পালনকালে কিছু কিছু ক্ষেত্রে যে ন্যাক্কারজনক ভূমিকা পালন করেছেন তা বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। দেশের ব্যবসায়ীদের একাংশের দাবির মুখে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। একই সঙ্গে আমানতের ওপর প্রদেয় সুদের হার নির্ধারণ করে দেয়া হয় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের ক্ষেত্রে সাড়ে ৫ শতাংশ এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকেরে বলায় ৬ শতাংশ। ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকে আমানত সংরক্ষণের জন্য দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি সুদ প্রদানের অনুমতি দেয়া হয় ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে যাতে বেশি পরিমাণে আমানত লাভ করতে পারে সেই প্রত্যাশায়। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান তাদের উদ্বৃত্ত আমানতের ২৫ শতাংশ ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকে সংরক্ষণ করতে পারতো। সেই আইন পরিবর্তন করে ৫০ শতাংশ আমানত ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকে সংরক্ষণের অনুমতি দেয়া হয়। অনেক প্রতিষ্ঠান বেশি সুদ পাবার প্রত্যাশায় ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকে আমানত সংরক্ষণ করে এখন সেই অর্থ উত্তোলন করতে পারছে না।
আগে কোনো একক পরিবার থেকে একযোগে দুজন পরিচালক নিযুক্ত হতে পারতেন। তারা ধারাবাহিকভাবে দুই টার্ম (প্রতি টার্ম তিন বছর) দায়িত্ব পালন করতে পারতেন। এই নিয়ম পরিবর্তন করে একই পরিবার থেকে একযোগে ৪ জন পরিচালক নিয়োগের বিধান করা হয়। তারা অব্যাহতভাবে চার টার্ম দায়িত্ব পালন করতে পারবেন বলে আইন করা হয়। পরবর্তীতে অবশ্য ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড (আইএমএফ) এর কাছ থেকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ গ্রহণের সময় এই শর্ত কিছুটা শিথিল করে এক পরিবার থেকে তিন জন পরিচালক নিয়োগের বিধান করা হয়। ঋণ হিসাব পুনঃতপশিলীকরণ নীতিমালা সহজীকরণ করা হয়েছে। ঋণ হিসাব অবলোপন নীতিমালা সহজীকরণ করা হয়েছে। এসব উদ্যোগের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল খেলাপি ঋণের পরিমাণ কৃত্রিমভাবে কমিয়ে দেখানো। সর্বশেষ পরিসংখ্যান মোতাবেক দেশের ব্যাংকিং খাতের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। এর সঙ্গে অবলোপনকৃত ঋণ হিসাবের নিকট পাওনা অর্থ, পুনঃতপশিলীকৃত ঋণ হিসাবের নিকট পাওনা এবং মামলাধীন প্রকল্পের নিকট দাবিকৃত অর্থ যোগ করা হলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬ লাখ কোটি টাকায় উন্নীত হবে।
খেলাপি ঋণ সৃষ্টির জন্য এক শ্রেণির ঋণ গ্রহীতা অবশ্যই দায়ী; কিন্তু প্রশ্ন হলো, ঋণখেলাপি কালচারের জন্য ব্যাংক কর্মকর্তারা কি কোনোভাবেই দায়ী নন? যারা ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্পর্কে ধারনা রাখেন তারা জানের ব্যাংকারদের সহযোগিতা ব্যতীত একজন ঋণ গ্রহীতা সাধারণত ঋণখেলাপি হতে পারেন না; কিন্তু ঋণখেলাপির সমস্ত দায়ভার ঋণ গ্রহীতার ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়। ঋণ গ্রহীতা ও ব্যাংকারের পরস্পর যোগসাজস না থাকলে ঋণখেলাপি হওয়া প্রায়শই সম্ভব হয় না। একজন ব্যাংকার যদি নির্মোহভাবে সততার সঙ্গে প্রচলিত আইন-কানুন মেনে ঋণ প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণ করেন তাহলে সেই ঋণ সাধারণত খেলাপি হবার আশঙ্কা কম থাকে।
ঋণ প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণের সময় প্রথমেই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে ব্যাংক কি কারও আর্থিক ক্ষমতা সৃষ্টির জন্য ঋণ দেবে নাকি আর্থিক ক্ষমতা সম্প্রসারণের জন্য ঋণ দেবে? আর্থিক ক্ষমতা সৃষ্টির জন্য ঋণ দেয়া হলে সেই ঋণের কিস্তি আদায় হবার সম্ভাবনা কম থাকবে। আর কারো আর্থিক ক্ষমতা সম্প্রসারণের জন্য ঋণ দেয়া হলে সে ক্ষেত্রে ঋণের কিস্তি নিয়মিত আদায়ের সম্ভাবনা বেশি থাকে। যার একটি চলমান ছোট কারখানা আছে এবং সংশ্লিষ্ট কাজে অভিজ্ঞতা আছে তাকে যদি কিছু অর্থ ঋণ হিসেবে দেয়া হয় তাহলে সেই ঋণের কিস্তি বকেয়া হবার আশঙ্কা কম থাকবে। আর কাউকে যদি কারখানা তৈরির জন্য ঋণ দেয়া হয় যার কোনো অভিজ্ঞতা নেই তাহলে সেই ঋণের কিস্তি আদায়ের সম্ভাবনা কম থাকবে।
কোনো ঋণ প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণের পদ্ধতি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, জুনিয়র অফিসার থেকে শুরু করে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পর্যন্ত যারা ঋণ আবেদন প্রক্রিয়াকরণ কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকেন তাদের সবাই নোটে একই ধরনের মন্তব্য করে থাকেন। তার অর্থ হচ্ছে শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা বলে দেন প্রস্তাবে কি লিখতে হবে। কর্মকর্তারা যদি তাদের ইচ্ছে মতো নিজ বিবেচনায় প্রস্তাব উপস্থাপন করতে পারতেন তাহলে ভিন্ন মত প্রতিফলিত হতো। সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত দাতা তার বিবেচনা মতো যে কোনো কর্মকর্তার প্রস্তাব গ্রহণ বা বাতিল করতে পারতেন।
খেলাপি ঋণ সৃষ্টির জন্য সবচেয়ে বড় দায়ী হচ্ছে ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনকালে বন্ধকী সম্পদের সঠিক ভ্যালুয়েশন না করা। ব্যাংক ম্যানেজার যদি ঋণ আবেদনকারীর প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হন তাহলে ৫০০ টাকার সম্পদের মূল্য ৫ হাজার টাকা দেখানো সম্ভব। আবার কোনো কারণে যদি ম্যানেজার আবেদনকারীর প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণ করেন তাহলে ৫০০ টাকার সম্পত্তিও ২০০ টাকা দেখানো সম্ভব। ঋণ গ্রহণকালে আবেদনকারিকে ১:১ দশমিক ২৫ অথবা ১:১ দশমিক ৫০ মূল্যের সম্পত্তি ব্যাংকের নিকট বন্ধক দিতে হয়। ব্যাংক ম্যানেজার চাইলেই এখানে অনিয়মের আশ্রয় গ্রহণ করতে পারেন। একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের শাখা কার্যালয় থেকে ৩ লাখ টাকার সম্পত্তিকে ৬৩ লাখ টাকা মূল্য দেখিয়ে ৩০ লাখ টাকা ঋণ গ্রহণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে অন্য একটি টিম সেই সম্পদের ভ্যালুয়েশন করতে গিয়ে জানতে পারে এই জমির মূল্য কোনোভাবেই ৩ লাখ টাকার বেশি হবে না। ৩ লাখ টাকার সম্পদ ৬৩ লাখ টাকা মূল্য দেখিয়ে যদি ব্যাংক ঋণ গ্রহণ করা যায় তাহলে সেই ঋণের কিস্তি ফেরত পাবার প্রত্যাশা করা কি ঠিক হবে? বন্ধকী সম্পদের সঠিক ভ্যালুয়েশন না করার কারণেই ব্যাংক যখন বন্ধকী সম্পদ নিলামে তুলতে যায় তখন উপযুক্ত ক্রেতা পাওয়া যায় না।
ঘটনা-উত্তর ব্যবস্থা গ্রহণের চেয়ে পূর্ব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করাই উত্তম। খেলাপি ঋণ সৃষ্টির পর তা আদায়ের চেষ্টা করার চেয়ে ঋণ অনুমোদনকালে এমনভাবে প্রস্তাব যাচাই বাছাই করা উচিত, যাতে সেই ঋণ কোনোভাবেই খেলাপি না হয়। আর যারা ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন তাদের কোনো না কোনোভাবে ঋণ আদায়ের দায়িত্বে রাখতে হবে। যারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি তাদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করে ক্রিমিন্যাল আইনে বিচার করা যেতে পারে।
এম এ খালেক: অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে