কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও নৈতিকতার সংকট
ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানব কি সত্যিই সত্যিই মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে? সাম্প্রতিক প্রযুক্তি জগতের কিছু ঘটনা কিন্তু আশঙ্কা তৈরি করছে। বিজ্ঞানের কাজ দানব তৈরি নয়, বিজ্ঞানীরা সেটা করেনও না; কিন্তু বিজ্ঞানের দান যখন বেনিয়া শাসকদের কুক্ষিগত হয়, তার ফল কী হতে পারে, সেটা পৃথিবী ১৯৪৫ সালেই চাক্ষুস করেছে, হিরোসিমা নাগাসাকিকাণ্ডে। বিজ্ঞানের দান যখন, অসৎ, দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যায়, তখন সেটাকে যেনতেন উপায়ে বাজারজাত করতেই তারা বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠেন, তাতে নিজেদের ট্যাকের ঝুলি ফুলে-ফেঁপে উঠলেই হলো, অন্যের মান-সম্মান ধুলোয় মিশল কি না, কিংবা ‘তুচ্ছ’ কিছু প্রাণ ঝরে গেল কি না, সে নিয়ে ভাববার অবকাশ বা ইচ্ছা কোনোটাই ওই দুর্বৃত্তদের থাকে না। শুধু টাকা চাই তাদের, খ্যাতি চায়, আরাম-আয়েশ চায়। শুধু চায় আর চায়।
সম্প্রতি প্রযুক্তি জগতে ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনা অশনি সংকেত শোনাচ্ছে। বিজ্ঞানী আর সমাজবিজ্ঞানীদের কপালে ফেলছে চিন্তার ভাঁজ। বলিউড স্টাররা ভিকটিমরা বলে ‘ডিপফেক’ শব্দটার সঙ্গে সারা পৃথিবীর মানুষ পরিচিত হয়ে উঠেছে। চলছে আলোচনা, সমালোচনা, বিশ্লেষণ। অন্যদিকে সাধারণ এক পরিদর্শকের প্রাণ গিয়েছে রোবটের রোষে। এটা নিয়ে বিশ্ব মিডিয়ায় হইচই তো হয়ইনি, এমনকি কাভারেজটাও দিতে কার্পণ্য করেছে বড় বড় মিডিয়াগুলো। সাধারণ এক কোরিয়ান পরিদর্শকের প্রাণের দাম আর কত! আলোচনায় এসেছে ওপেন এ আইয়ের প্রতিষ্ঠাতা স্যাম অল্টম্যানের বহিষ্কার ও পুনর্বহালে ঘটনাও। স্যাম অল্টম্যান তো যেনতেন কেউ নন! আপাত দৃষ্টিতে এ তিন ঘটনা আলাদা মনে হলেও, এরা আসলে একসূত্রে গাঁথা। তিন ঘটনার পেছনেই আছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা; সংক্ষেপে যে প্রযুক্তিকে এ আই বলে ডাকছে বিশ্ববাসী।
স্যাম অল্টম্যান ওপেনএআইয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, যিনি চ্যাটজিপিটির প্রতিষ্ঠাতা৷ গত ১৭ নভেম্বর তাকে বরখাস্ত করে ওপেনএআইয়ের পরিচালনা পর্ষদ। অল্টম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তার ভেতর নেতৃত্বগুণের ঘাটতি দেখা গেছে; কিন্তু দুদিন না যেতেই উলটে যায় পাশার দান। স্যাম বহিস্কার মানতে পারেননি ওপেনএআইয়ে সহপ্রতিষ্ঠাতা ও কোম্পানিটির প্রেসিডেন্ট গ্রেক ব্রোকম্যান, স্যামকে বহিষ্কারের ঘোষণার দিনই তিনিও চাকরি ছাড়ার ঘোষণা দেন। পর দিনই তিনজন সিনিয়র বিজ্ঞানী ও গবেষক ঘোষণা দেন ওপেনএআই ছাড়ার । ৭০০ কর্মী পরিচালনা পর্ষদকে চিঠি লিখে জানান, স্যামকে না ফেরালে তারা গণপদত্যাগ করবেন। কোম্পানিটিতে লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও চাপ দেয় স্যামকে ফিরিয়ে আনার জন্য। বাধ্য হয়েই স্যামকে ফিরিয়ে আনে পরিচালনা পর্ষদ, ২১ নভেম্বরে৷ ফিরেই স্যাম একজন বাদে গোটা পরিচালনা পর্ষদকে বরখাস্ত করেন।
ওপেনএআইয়ের পাঁচ দিনের এই নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহ দেখলে মনে হয়, খুব সাধারণ এক এক অফিস পলিটিকসের শিকার স্যাম। ব্যাপারটা হয়তো অতটা সরল নয়। চ্যাটজিপিটি নামের এক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জনক তিনি, যে অ্যাপটি মানুষের ইনপুট করা ডেটা বিশ্লেষণ করে নিজে নিজেই শিখতে পারে, সে অনুযায়ী সিদ্ধান্তও নিতে পারে কখন কী করা উচিত। কথা হচ্ছে, মানুষই যেখানে নীতি-নৈতিকতার ধার ধারে না, এই আইকেই বা কেন নীতিবান হতে হবে। ওপেনএআইয়ের কথাই ধরা যাক, ওখানে নিশ্চয়ই একটা নোংরা পলেটিকস হয়েছি, কার দোষ কার গুণ সেটাতে না গেলাম- কিন্তু কিছু ঘটেছিল তো বটেই। তাহলে সেখাকার নৈতিকভাবে স্খলিত মানুষের হাতে এআই কতটা নিরাপদ?
চ্যাটজিপিটি, গুগল বার্ড বা বড় বড় কিছু প্রতিষ্ঠানের এআইকে হয়তো নৈতিকভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা হয়, কিন্তু এর বাইরের ছোটবড় অসংখ্য এআই প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, এদের বেশিরভাগের উদ্দেশ্যই অসৎ! তাদের দ্বারা যেসব এআই ডেভেলপ হচ্ছে সেগুলো নিরাপদ নয়, তার বড় উদাহরণ হলো বলিউডের ঘটনা। শুরুটা হলো দক্ষিণী অভিনেত্রী রাশ্মিকা মান্দানাকে দিয়ে, এরপর ক্যাটরিনা কাইফ সবশেষে ডিপফেকের শিকার আলিয়া ভাট। এআই দিয়ে তাদের পর্নো ভিডিও বানিয়ে সেগুলো ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আন্তর্জালে। একশ্রেণির পর্নো ব্যবসায়ী সেগুলো বিকিয়ে আয় করেছেন কোটি কোটি টাকা। রাশ্মিকা-ক্যাটরিনা-আলিয়াদের ক্ষেত্রে মানুষকে বোঝানো গেছে ওগুলো নকল ভিডিও, বানিয়ে দিয়েছে এআই; কিন্তু আমাদের সমাজের অতি সাধারণ কোনো মেয়ের ক্ষেত্রে এ ঘটনা ঘটলে কী হতো?
সেদিন এক সহকর্মী এ নিয়ে কথা বলেছিলেন, এক ভুক্তভোগী তরুণী নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়েছিলেন তাকে। তার বক্তব্য, নকল ভিডিওর ব্যাপারটা বন্ধু-বান্ধব বা সচেতন মানুষকে বোঝানো যায়; কিন্তু অভিভাবক, প্রতিবেশী বা আত্মীয়স্বজনকে বোঝাবে কে। আর কজনকেই ডেকে ডেকে বা ডিপফেক বোঝানো যায়! সুতরাং চরম মানসিক ট্রমা নিয়ে দিনযাপন করছে তরুণী। ট্রমার ধকল কজনই বা সইতে পারে! অনেকেই তাই যে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারে, সে আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। গ্রামে বসবাসকারী মেয়েদের নকল ভিডিও বানানোর পেছনে যতটা না ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য থাকে, তার চেয়ে বেশি থাকে প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া পাওয়ার কারণে অন্ধ আক্রোশ। বখাটের হাতে হাতে স্মার্ট ফোন, অসংখ্য এআই অ্যাপ রয়েছে, যেখান থেকে সহজেই একজন তরুণীর সাধারণ ফটো বা ভিডিও ইনপুট দিয়ে পর্নো ভিডিও বানিয়ে ফেলা সম্ভব।
এ সমস্যার সমাধান তাহলে কী?
এআই ব্যবহার হচ্ছে রোবটেও। আসলে রোবট আর এআই অ্যাপগুলোর মধ্যে কাঠামোগত পার্থক্য ছাড়া আর কোনো তফাৎ নেই। আর রোবটের ধারণা যখন এসেছিল তখন থেকেই এ আইকে কল্পনায় ঠাঁই দিয়েছিলেন উদ্ভাবকরা। কল্পকাহিনিগুলোতে বহু আগেই বুদ্ধিমান রোবটের কল্পনা করেছেন লেখকরা। তাদের নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়া ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। তার ফলে শুরু হয়েছিল দ্বন্দ্ব। মাষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল রোবটরা, বিদ্রোহ করেছিল, মানব হত্যা শুরু করেছিল। কল্পবিজ্ঞানের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে রোবট যখন সত্যি সত্যি বাজারে আসা শুরু করল, গবেষক থেকে শুরু করে কল্পকাহিনির ভক্তরা পর্যন্ত আঁতকে উঠলেন।
বুদ্ধিহীন রোবট নিয়ে কারও আপত্তি ছিল না; কিন্তু ষাটের দশক থেকেই বিজ্ঞানী, গবেষক ও সমাজবিজ্ঞানীরা সতর্ক করা শুরু করলেন রোবট হয়তো এক দিন ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবের মতোই মানবসভ্যতা আঘাত করবে। তারা এও জানতেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সময়ের ব্যাপার মাত্র, তাই এর নেতিবাচক দিকগুলো নিয়েও ভাবার কথা বলেছিলেন উদ্ভাবকদের। উদ্ভাবকেরা সেটা আমলেও নিয়েছিলেন, তাই নব্বই দশক থেকেই এই উন্নতি ঘটানোর চেষ্টা করা হচ্ছিল নৈতিকতার কথা মাথায় রেখেই; কিন্তু স্মার্টফোন আসার পর ইউটিউব, ফেসবুকে যেমন তরুণদের নিজেকে জনপ্রিয় করা কিংবা টাকা আয় করার সহজ পথ খুলে দিয়েছে, নৈতিকতার সংকট তৈরি হয়েছে তখনই। যে কোনো মূল্যে ইউটিউব বা ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার নেশা চেপে বসে সাধারণ মানুষের। তাদের কথা মাথায় রেখে নিত্যনতুন অ্যাপ আর সফটওয়ার টুলস বাজারে ছাড়ছে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো।
ভিডিও বা ফটো সম্পাদনার কাজ একসময় যেমন বিশেষজ্ঞদের হাতে ছিল, স্মার্ট যুগে এসে সেগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত হয়ে গেছে। সহজেই করে ফেলা যায় ছবি বা ভিডিও সম্পাদনার কাজ। এরপর এআই অ্যাপগুলো আসার পর সে খাটুনিটাও করতে হচ্ছে না ব্যবহারকারীকে। এই আইকে নির্দেশ দিলেই আপনি যেমনটা চান, তেমনই ফটো বা ভিডিও এমনকী অডিও তৈরি করে ফেলা যাচ্ছে। খুব ভালো করে লক্ষ না করলে বোঝার উপায় নেই, সেগুলো আসল না নকল। সাধারণ মানুষের জন্য ফারাক বুঝতে পারাটা আরও কঠিন। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। বিশ্বসেরা কল্পবিজ্ঞান লেখক আইজ্যাক আসিমভ আমাদের আশা দেখিয়েছিলেন, তিনি রোবটরে জন্য ঠিক করে দিয়েছিলেন দুটি নীতি, যে নীতিগুলো মেনে চললে আজকের এই সংকট তৈরি হত না। নীতিগুলো হলো, ১. রোবট নিজে মানুষের ক্ষতি অন্য কারো অন্য কিছু দ্বারা মানুষের ক্ষতি হতে দেবে না। ২. রোবট অবশ্যই মানুষের নির্দেশ মেনে চলবে যদি না সেই নির্দেশ তার প্রথম নীতিকে লঙ্ঘন করে। ৩. রোবট সব সময় নিজেকে রক্ষা করবে যদি না তা প্রথম ও দ্বিতীয় নীতিকে লঙ্ঘন করে।
সমস্যা হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন এই রোবটের মধ্যে আসিমভের নীতিগুলো মানুষকেই ঢুকিয়ে দিতে হবে। তাতেও আসলে সমস্যার পুরোপুরি সমাধান হয় না। পৃথিবীর কোনো যন্ত্র বা সিস্টেম বা নীতি শতভাগ নিখুঁত নয়; পদার্থবিদ্যার সূত্রমতে শতভাগ নিঁখুত হওয়া সম্ভবও নয়। তাই রোবটও শতভাগ নিখুঁতভাবে কাজ করবে, এ কথা বলা খোদ প্রাকৃতিক নীতিরই লঙ্ঘন হবে। রোবটের সেই সামান্য ত্রুটিও কিন্তু ভয়াবহ দুর্যোগ বয়ে আনতে পারে। তার সাম্প্রতিক উদাহরণ কোরিয়ায় রোবটের হাতে এক পরিদর্শক নিহত হয়েছেন। রোবটিকস প্রতিষ্ঠানটি বলছে, মসলার বাক্সের সঙ্গে ওই পরিদর্শকে গুলিয়ে ফেলেছিল। তাই কনভেয়ার বেল্টের সঙ্গে চেপে ধরেছিল পরিদর্শককে, সেটা এতটাই গুরুতর ছিল, লোকটা মারা যান। ওই কোম্পানির যুক্তি কিছুটা খাপছাড়া। মসলার বাক্সের সঙ্গে লোকটাকে যদি গুলিয়েই ফেলে, তাহলে অত জোরে বেল্টের সঙ্গে চেপে ধরল কেন? মসলার বাক্সকে নিশ্চয়ই অত জোরে চেপে ধরার দরকার হয় না।
কোম্পানিটি স্বীকার করেছে রোবটের সেন্সরে ত্রুটি ছিল। রোবটের হাতে মানুষ খুনের ঘটনা এই প্রথম নয়। ১৯৭৯ সায়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি কারকাখানায় নিহত হন রবার্ট উইলিয়াম নামে এক শ্রমিক।
সাম্প্রতিক এই তিন ঘটনার সঙ্গেই এআই জড়িয়ে আছে। রোবটকে যেমন আসিমভের সূত্র মেনে চলার নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে, এআই প্রযুক্তিকেও নানার রকম নির্দেশনা দিয়েই ডেভেলপ করা হয়; কিন্তু অসাধু অ্যাপ ডেভেলপারদের রুখবে কে? টাকার জন্য তারা সব কাজ করতে পারে। তবে সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি। এইআইকে কেন্দ্র করেই মানবজাতির নিকটভবিষ্যৎ আবতির্ত হবে, সেটাকে বাতিল করারও উপায় তাই নেই। এখন উচিত বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিদের সঙ্গে রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিকারীদের বসে একটা উপায় খুঁজে পাওয়া, তা না হলে পারমাণবিক বোমার চেয়ে ভয়াবহ উঠতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
লেখক: বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে