Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা

স্বাধীনতা রক্ষায় শিল্পীর দায়

Liaquat Ali  Lucky

লিয়াকত আলী লাকী

সোমবার, ২৫ মার্চ ২০২৪

প্রত্যেক মানুষের জন্য স্বাধীনতা একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। সেই স্বাধীনতার জন্য হাজার বছর ধরে আমরা সংগ্রাম করেছি। সেই সংগ্রামের ইতিহাস কতটা ব্যাপক, সেটা শুধু আমরা নই, সারা বিশ্ব জানে। আমরা ভাগ্যবান, আমরা এমন একজন মানুষ পেয়েছি, যার জন্ম না হলে আমরা মুক্ত হতে পারতাম না। আমরা জানি না, পরাধীনতার গ্লানি আমাদের বয়ে যেতে হতো আরও কতকাল! মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের সেই স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছেন এবং স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন।

পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর সেই ১৯৪৭ সালেই তিনি বলছেন, আমরা নতুন করে আবার পরাধীন হলাম। ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম ছিল দুইশ বছরের বেশি। পরাধীনতার গ্লানি মুছে ফেলতে আমাদের মণীষীরা শৃঙ্খল ভাঙার গান গেয়েছেন। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। পরাধীনতামুক্ত একটা জাতি গড়ে তোলার জন্য শত মনীষী, হাজার মনীষী আমাদের জীবনে শিল্পের আলো ফেলেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবারের মতো রাজনৈতিকভাবে সেটি সুপ্রতিষ্ঠিত করলেন।

সেই স্বাধীনতার পরেই, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পরে আমাদের অনুভূতি জাগলো সারা দেশ এখন একটি পরিবার। কেন এই অনুভূতিটা জাগলো? আমরাও যুদ্ধ করেছি। আমরাও সংগ্রাম করেছি। দীর্ঘ লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে আমরা একটা দর্শনে এক হয়েছি। এর আগে, আমাদের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল, আমরা বাঙালি না কি মুসলমান, না কি মানুষ, না অন্যকিছু? জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্পষ্ট করে দিলেন, আমাদের জাতিসত্তা কী হবে, আত্মপরিচয় কী হবে?

তিনি বললেন, ‘আমি বাঙালি, আমি মুসলমান, আমি মানুষ’। তার অর্থ হলো, মাঝখানে আমার ধর্মের পরিচয়টা থাকবে; কিন্তু বাঙালি এবং মানুষ হিসেবে আমাদের পরিচয় সবার আগে। এই পরিচয় সবার জন্য এক। সেই দর্শনটা- ‘সবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই’ বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে এমনই দর্শন প্রকাশ করেছেন। এ যে শুধু ব্যক্তিমানসিকতার কথা তা নয়, এটি সমতার কথা। এ ছাড়া সমতা প্রতিষ্ঠা হয় না। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের আত্মপরিচয়ের সন্ধান তিনি দিলেন। এই আত্মপরিচয়ের সন্ধান থেকেই স্বাধীনতা অর্জন।

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস আমরা কেবল পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিনি। আমরা যুদ্ধ করেছি বিশ্বের অনেক বৃহৎ শক্তির সঙ্গেও। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ভূ-রাজনীতিও বুঝতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্বের বড় বড় কয়েকটা দেশ নিরপেক্ষ থাকেনি। আমাদের বিরুদ্ধে যারা ছিল, সেই হানাদার বাহিনী, যারা গণহত্যা সংঘটিত করেছে তারা তাদের পক্ষ নিয়েছিল উন্মুক্তভাবে। শুধু পক্ষ না, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-বিরোধীশক্তি যেন বিশেষ শক্তিশালী হয়, তারা সেইভাবে কাজ করেছে। সপ্তম নৌবহর এখানে পাঠানো হলো আমাদের বিরুদ্ধে। সেই সময় আমাদের সঙ্গে যদি দুটি বড় দেশ না থাকত তাহলে নয় মাসে আমাদের স্বাধীনতা খুব কঠিন হয়ে পড়ত।

স্বাধীনতার পর সাড়ে তিন বছরে কী ঘটেছিল ভেতরে ভেতরে? স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছর বেঁচেছিলেন। এই সাড়ে তিন বছর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বাঙালিদের মধ্যে কার কী ভূমিকা ছিল, তা বুঝতে হবে। এই সাড়ে তিন বছর তাকে শান্তিতে থাকতে দেয়া হয়নি। দরিদ্র একটা দেশ যখন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়ে যাচ্ছিল তখনই তাকে সপরিবারে হত্যা করা হলো। এটি অনেক বিশ্লেষণের দাবি রাখে। শুধু একজন বঙ্গবন্ধু নয়, তার পরিবারের সবাইকেই হত্যা করতে হবে, এটার পেছনে যে পরিকল্পনা সেটি অনেক বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

আমি আসলে একজন শিল্পী, শিল্পের মানুষ, সংস্কৃতিকর্মী। আমার দায়বদ্ধতা হলো শিল্পের আলোয় ভাষা-আন্দোলন। শিল্পের আলোয় মুক্তিযুদ্ধ। শিল্পের আলোয় বঙ্গবন্ধু। শিল্পের আলোয় শেখ হাসিনা। অর্থাৎ, শিল্পের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্নগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরাই আমার কাজ। কারণ, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন মানেই বাংলাদেশের স্বপ্ন। বাংলার মানুষের কল্যাণ।

বঙ্গবন্ধুর ওপর কী কী শিল্প নির্মিত হয়েছে, আরো কী কী নির্মিত হওয়া উচিত, তা নিয়েই আমি ১৯৭৫-এর পর থেকে কাজ করছি। শিল্পকলা একাডেমিতে এসেও এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করছি। এটা কেন? আসলে শিল্পের শক্তি অনেক বড়। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার ১০টি বক্তৃতায় যা না হয়, একটি শিল্প তার চাইতে দশগুণ শক্তিশালী হয়ে সেই কাজটি করতে পারে’। কী অসাধারণ তার বোধ!

সেই শিল্পের শক্তি জাগরিত করার জন্যই আমি পঁচাত্তর-পরবর্তী সময় থেকে কাজ করে যাচ্ছি। আমি ডাকসুর সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলাম। আমি যতবার গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল, চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি, সব সময়ই এই কাজটি করেছি।

শিল্পকলার আর্ট গ্যালারিতে বঙ্গবন্ধুর একটা ছবিও ছিল না। এখন প্রায় দেড় হাজার ছবি আছে। বঙ্গবন্ধু কর্নার অনেকেই করেছে, আমরাও করেছি, আমি গর্বের সঙ্গে বলতে পারি, সর্ববৃহৎ বঙ্গবন্ধু কর্নার শিল্পকলা একাডেমির। প্রায় ১ হাজার ৮০০ বই আমরা সংগ্রহ করেছি। আরও সংগ্রহ হচ্ছে। যে কোনো সময় ২ হাজার হয়ে যাবে।

সব চাইতে বেশি সংগ্রহ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। গবেষকরাই বলছেন, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি সেটা অতিক্রম করেছে। শুধু যে বই সংগ্রহ বা লাইব্রেরি সাজিয়েছি তা নয়। আমরা প্রত্যেকটি গ্রন্থ পর্যালোচনার ব্যবস্থা করছি। ১০০টা বই পর্যালোচনা করে এই নিবন্ধগুলো একসঙ্গে করে একটা করে বই প্রকাশ করছি। ৭টি খণ্ড প্রকাশ হয়ে গেছে। ৭টি খণ্ড মানে ৭০০ বইয়ের মূল্যায়ন।

কে কী লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুর সামগ্রিক জীবনের যাবতীয় তথ্য এই মূল্যায়নগুলোর মধ্য দিয়ে জানা যায়। এমন কি, কোথাও কোনো তথ্যচ্যুতি হয়েছে কি না, কেউ কপি পেস্ট করেছেন কি না তাও এই পর্যালোচনাগুলো থেকে বেরিয়ে আসে। এরকম একজন মহান নেতাকে নিয়ে লেখা হবে, আর সেটার মধ্যে কোনো ভুল তথ্য থাকবে সেটা আমরা চাইনি।

আমরা নিজেরাও অনেক গ্রন্থ প্রকাশ করেছি। বঙ্গবন্ধু জন্মশতবর্ষে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। সব ক্ষেত্রেই। এবার আমরা যে-কাজটি করছি, ‘রেণুর শেষ সন্ধ্যা’ বঙ্গমাতার শেষ সন্ধ্যাটাকে, ওই মুহূর্তটাকে নিয়ে একটা মনোড্রামা আমি লিখেছি, সেখানে বেরিয়ে আসবে ওই সাড়ে তিন বছরে বঙ্গবন্ধুর না বলা কথা। তিনি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে কিছুটা লিখেছেন। পরে আর লিখতে পারেননি। বাকি কথাগুলো বঙ্গমাতার বক্তব্য থেকে বেরিয়ে আসবে।

আমি কথাটা এই কারণে বলছি, এই বিশ্লেষণ ছাড়া আমি দেশপ্রেমিক হতে পারব না। ভবিষ্যতের জন্য সংগ্রামী হতে পারব না। এই দেশের মানুষের মুক্তির জন্য বঙ্গমাতার জবানীতে ওই সাড়ে তিন বছরের ইতিহাস জানা খুব দরকার।

এখন তো বঙ্গবন্ধু নেই, রবীন্দ্রনাথ নেই, নজরুল নেই, লালন সাঁইজি নেই। আমাদের সুকান্ত নেই। সুকান্ত স্বপ্ন দেখেছিলেন, এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি/নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার! প্রত্যেক মহান মানুষের একটা করে দিকনির্দেশনা রয়েছে। এই দিকনির্দেশনা আমাদের প্রতি। তাদের একেকটা কথা আমাদের কাছে একেকটা পবিত্র বানী, পবিত্র নির্দেশনা বলে মনে করি।

বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘মুক্তির সংগ্রাম’। আমার কাছে মনে হয়েছে, ‘মুক্তির সংগ্রাম’ কেন বলেছেন বঙ্গবন্ধু? স্বাধীনতার সংগ্রাম বললেও তো পারতেন; কিন্তু আসলে মুক্তি। শুধু পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে নয়, সমস্তরকম মিথ্যে বানোয়াট পরিচয় থেকে, নিপীড়ন-শোষণের পূর্ববর্তী সমস্ত শৃঙ্খল থেকে মুক্তি। এই মুক্তির সংগ্রাম আমরা এখন করছি।

স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর কেন স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে? এর কারণ তারাও কম শক্তিশালী নয়। তারা এ দেশের স্বাধীনতা এখনো মেনে নিচ্ছে না। তারা যে মেনে নিচ্ছে না, তার মানে এই দেশের ভেতরে ভেতরে ষড়যন্ত্র বাসা বেধে বসে আছে। সদম্ভে তারা যা খুশি করছে। তাদের মিত্ররাও শক্তিশালী। মিত্রপক্ষ থেকে তারা সমর্থনও পাচ্ছে। এই দেশটাকে তারা পরাধীন অবস্থাতেই রাখতে চায়। ভূ-রাজনীতি, অপরাজনীতির ক্রীড়ানক হিসেবে তারা কাজ করছে।

বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘আমি বাঙালি, আমি মুসলমান, আমি মানুষ’। আমি সেদিক থেকে বলছি, কেউ বলতে পারেন আমি বাঙালি, আমি হিন্দু, আমি মানুষ। বা আমি বাঙালি, আমি খ্রিষ্টান, আমি মানুষ। আমি বাঙালি, আমি বৌদ্ধ, আমি মানুষ। অথবা আমি বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ, কিন্তু, আমরা আমাদের দেশকে ভালোবাসি। ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়নজলে ভাসি’ আমাদের সবার অনুভূতিতে এটা একইরকম কাজ করে। সবার আগে দেশমাতা, দেশের মানুষ। কোনো অপরাজনীতির ক্রীড়নক হয়ে দেশমাতার সঙ্গে বেইমানি করা চলবে না।

আমি মনে করি, একটা নতুন সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা খুবই জরুরি। এ-কথা মাথায় রেখেই আমরা গণজাগরণের শিল্প-আন্দোলন করছি। যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে, বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হবে। এখন আমাদের লড়াইটা কীরকম হবে? আমরা কি বলতে পারব, ঠিক আছে আমরা আবার একাত্তর-পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরে যাব? আমরা আবারও পরাধীন হব?

কিছু মানুষ আছে এ-দেশটাকে আবার পরাধীন বানাতে চায়। তারা বুঝতে পারছে না আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে! তারা কি বিশ্বাস করবে আমরা এখন বাংলাদেশ নয়, পাকিস্তানি ভাবধারায় চলে যাব! বড় এক রাজনৈতিক দলের বড় এক নেতা বলে ফেললেন, পাকিস্তান আমলেই আমি ভালো ছিলাম। এ কথার অনেক অর্থ দাঁড় করানো যায়। আপনি ভাষা-আন্দোলন করেননি, আপনি মুক্তিযুদ্ধ করেননি, তাহলে আপনি কী করে এ কথা বলছেন?

এখন যদি ভাষা-আন্দোলন হতো, মুক্তিযুদ্ধ হতো, আমার বিশ্বাস, আপনি ভাষা-আন্দোলন করতেন, মুক্তিযুদ্ধ করতেন। এখন একই যুদ্ধ চলছে, আপনি সেই যুদ্ধটা করছেন না কেন? সেই যুদ্ধটা হলো, কোনো কিছুই যেন আমাদের পিছিয়ে দিতে না পারে।

ওই যে বাংলা আমাদের ভাষা নয়, ইংরেজি শিক্ষা হারাম এটা বলে কিন্তু আমাদের প্রায় একশ বছর পিছিয়ে দিয়েছিল। আমরা পিছিয়ে পড়েছিলাম। আমাদের মধ্যে শিক্ষার প্রচলন শুরু করেছে ধরতে গেলে আমাদের আগের একটা প্রজন্ম। এর মধ্যে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র অনেক দূর এগিয়ে গেছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বুঝতে হবে এটা অনেক বড় আন্দোলন। সেই আন্দোলনের একজন সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে আমাদের শিল্পীদের আমি বুঝাতে সক্ষম হয়েছি, আমি শিল্পী, আমি আমার নেতা। আমাদের দায়িত্ব অনেক বেশি।

একজন শিল্পী যেখানেই থাকেন সেখান থেকে তার উৎকর্ষ সাধিত হবে। সে বড় হবে। বড় অবদান রাখবে। ‘শিল্প-সাহিত্যের ক্ষমতায়ন, ‘গণজাগরণের শিল্প-আন্দোলন’ এটাই হলো এখন আমার প্রেরণা। এই শক্তি নিয়েই আমি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই। আমার পথচলার সঙ্গী হিসেবে চাই দেশের সব শিল্পীদের।

শিল্পীদের কাজ অনেক বড়। মানুষের সুখ-দুঃখ-হাসি-কান্নাই তো শিল্প-সংস্কৃতি। শিল্পীর কাজ কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের সঙ্গে মেশা, তাদের কষ্টের কথা শোনা, তাদের স্বপ্নের কথা জানা এবং সবাইকে জানানো। শিল্পীদের কাজ স্বপ্ন দেখানো। এ দেশের শিশু, কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষ যা ভাবে তা-ই কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরা ফুটিয়ে তোলেন। রবীন্দ্রনাথ নজরুল মানুষের স্বপ্নের কথা প্রকাশ করেছেন। বঙ্গবন্ধু তাই রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের লেখাকে প্রেরণা হিসেবে নিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু যেভাবে মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতেন, আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও সেই পথই অনুসরণ করছেন। তিনি মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেন। শিল্প-সাহিত্যিকদের দায়বদ্ধতা কী? আমি বিশ্বাস করি শিল্পী-কবি-সাহিত্যিকরা যে যেখানে আছেন তাদের দায়িত্বটা পালন করছেন। তারা তাদের দায়িত্ব পালন করছে বলেই কিন্তু এখনো এ দেশে আলো জ্বলছে।

এখন সবচেয়ে বড় সংকট আমার প্রতিপক্ষ অনেকটা অদৃশ্য। আমি পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি, তখন আমার শত্রু চিহ্নিত ছিল। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তীতেও রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের আমরা চিনেছি, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি; কিন্তু এখন শত্রু চিহ্নিত করা একটু কঠিন হয়ে গেছে।

এখন শত্রু আমার ঘরে বাস করছে। আমার সমাজে বসবাস করছে। শত্রু এখন আমার আত্মীয়-বন্ধুও হতে পারে। আমি নিজেও আমার শত্রু হতে পারি। কারণ আমি দ্বিধান্বিত। দ্বিধান্বিত হয়ে আমি নিজেকে ধ্বংস করছি। এটা এখন একটা বড় সংকট।

এই সংকট মোকাবিলার জন্য আত্মশক্তি, আত্ম-মর্যাদা, আত্ম-উপলব্ধি, আত্মজ্ঞান দরকার। নিজেকে জানা দরকার। সক্রেটিস বলেছিলেন, ‘নো দাইসেলফ’। এই নিজেকে জানা আসলে সহজ কাজ না। বাংলা একটা জনপ্রিয় গান আছে, ‘আমি বা কে আমার মনটা বা কে? আজও পারলাম না আমার মনকে চিনিতে’। এই গানটি যে জনপ্রিয় হয়েছে তার কারণ প্রত্যেকেই নিজেকে সন্ধান করেন; কিন্তু, চিনতে পারেন না। নিজেকে চেনার জন্যও সাধনা প্রয়োজন।

আমরা এখন দেখছি রুচির দুর্ভিক্ষ। এটা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের কথা। তিনি বলেছিলেন, আমি দুর্ভিক্ষের ওপর ছবি আঁকলাম, যাতে দুর্ভিক্ষ দেখতে না হয়; কিন্তু রুচির যে দুর্ভিক্ষ সেটা কী কবে দূর হবে বুঝতে পারছি না।

আমরা এক সময় রাজনৈতিক ভাষণে শুনতাম শ্রেণিবিভক্ত সমাজের কথা। আমি মনে করি এখন আমাদের আরো বড় সংকট হলো ‘রুচি বিভক্ত সমাজ’। রুচিতে মানুষ এত বিভক্ত হয়ে গেছে, ওই যে আমি বলেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের পরে, ১৬ ডিসেম্বরের পরে আমাদের যে অনুভূতিটা হয়েছিল, এখন আমরা একটা পরিবার, এখন কিন্তু আমরা আর একটা পরিবার নাই।

কত পরিবারে যে বিভক্ত হয়ে গেছি! নানানরকম রুচি-কুরুচি মিলিয়ে আমরা দ্বিধাবিভক্ত। আমি আবারও বলব, রুচি বা কুরুচির মাপকাঠিটা কী? মাপকাঠিটা হচ্ছে, আমার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। সবার ওপরে মানুষ সত্য তার ওপরে নাই। সামাজিক সমতা। গণতন্ত্র। জাতীয়তাবাদ। এবং ধর্মনিরপেক্ষতা।

এতদিন পরে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা আমাদের ঢোল বাজিয়ে বলতে হবে কেন? ধর্মনিরপেক্ষ একটা সমাজ-জাতি গঠন করব বলেই তো আমরা লড়াই করলাম হাজার হাজার বছর। ধর্মে ধর্মে লড়াই হয়েছে, সংঘর্ষ হয়েছে, তারপর আমরা হাতে হাত রেখে বলেছি, সবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার ওপর নাই। এটি আমার ধর্ম, এটিই আমার দর্শন।

সেই জায়গাটিতে একটা বড় জাগরণ তৈরি করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি কাজ করছে। বাংলাদেশের প্রায় ৭০ হাজার শিল্পীকে আমরা ঐক্যবদ্ধ করেছি। প্রথম পর্বটি আমরা সমাপ্ত করতে সক্ষমও হয়েছি। আমরা সবাই একমত হতে সক্ষম হয়েছি, এখন যারা যুদ্ধটা করবে তারা গণজাগরণের শিল্পযোদ্ধা। তারা মুক্তিযোদ্ধা না, তারা ভাষাসৈনিকও তারা, তারা গণজাগরণের শিল্পযোদ্ধা। এটি হবে তার পরিচয়।

এর জন্য তাকে কোনো সাংস্কৃতিক সংগঠন করতে হবে, কোনো নেতা মানতে হবে তা না। সে নিজেই নিজের নেতৃত্ব দেবে। আমি কবিতা লিখি, আরও ভালো কবিতা লিখব। আমার কবিতা মানুষকে আলোকিত করবে, মানুষের ভেতরে জাগরণ তৈরি করবে, ওটা হলেই দেশের, রাষ্ট্রের, সমাজের কল্যাণ হবে।

এই আন্দোলনের দ্বিতীয় ধাপ আমরা এখন পালন করছি। সামনে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সুবর্ণ জয়ন্তী। শিল্পী ডাটাবেজ করে এক বছরে এক লক্ষ শিল্পীকে আমরা এক জায়গায় আনার চেষ্টা করব। এই শিল্পীরাই সমাজের অগ্রগতিতে কাজ করবেন। সমস্যা নিয়ে সমাজে শুধু আলোচনা হয়; কিন্তু এসব সমস্যা সমাধানে কেউ এগিয়ে আসে না। আমরা ঠিক করেছি ৩৬৫টি বড় সমস্যাকে প্রথমে চিহ্নিত করব। এই সমস্যাগুলো আমরা সংগ্রহ করছি শিশুদের কাছ থেকে। তাদের চিহ্নিত ৩৬৫টি সমস্যা নিয়ে আমরা একটা কর্মসূচি দেব।

কেন ৩৬৫টি সমস্যা? ৩৬৫ দিনে এক বছর। এই এক বছর আমরা এই সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করব শিশুদের নেতৃত্বে। আমরা শিশুদের পেছনে থাকব। শিশুরা বলবে তাদের কী কী সমস্যা। শিশুদের কথা কেউ ফেলে দিতে পারবে না। বাবা-মাও ফেলে দিতে পারবে না। কারণ, বাবা-মার একমাত্র আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হলো তাদের সন্তান। আর সন্তান যখন বলবে, বাবা, তুমি এই ভুলটা করেছ, বা অন্য একজন করেছে; কিন্তু আমরা এই ভুলগুলো চাই না। কারণ, ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা নির্বিঘ্নে উন্নত দেশে পরিণত হব। এটা আমাদের একটা বড় কাজের জায়গা। আমি সারা বাংলাদেশের সব শিল্পীদের কথাই বলছি। শিল্পীরা কী চায়? গত বছর তারা যে কাজটি করেছে এ বছর তার চেয়ে বড় কাজ করতে চায়। আমরা তাদের পাশে থাকব।

এখন কথা হচ্ছে, প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশে যতগুলো সাংস্কৃতিক সংগঠন আছে তা কি যথেষ্ট? অবশ্যই না। আরো অনেক সংগঠন আমাদের প্রয়োজন। সেই সংগঠনগুলো হতে হবে সৃজনশীল সংগঠন। তারা আত্মসেবা নয়, তারা নিয়োজিত থাকবে জনগণের সেবায়, শিল্পের উৎকর্ষ সাধনে।

তারা নিজেকে উৎসর্গ করবে মানুষের জন্য। যেভাবে উৎসর্গ করেছিলেন আমাদের ভাষাশহীদরা, মুক্তিযুদ্ধের শহীদরা, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের মা-বোনরা। ওরকম বোধ নিয়ে আমাদের একটি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।

আমরা ঝাঁপিয়ে পড়েছি এরই মধ্যে। এটা আরও বেগবান করাই আমাদের কাজ। স্বাধীনতা দিবস বলি, আর যত জাতীয় দিবস বলি, এটাকে বেগবান করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। আগামী ১৭ বছর এই আন্দোলনটা চলবে।

আমরা যে গণজাগরণের শিল্প-আন্দোলন করছি, এখানে গুরুত্ব দিচ্ছি শিশুদের, কিশোরদের, তরুণদের। আমরা সারা দেশের স্কুলে স্কুলে পৌঁছে যাব। তারা সত্য জানতে চায়। তারা দেশকে ভালোবাসতে চায়। তারা দেশের শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে চায়। এরাই আগামী দিনে নেতৃত্ব দিবে।

শিশু সংগঠন, শিল্পীদের ঐক্যবদ্ধ করে আমরা একযোগে কাজ করব। সরকারের যেমন প্রকল্প আছে দেশে শতভাগ শিক্ষা প্রচলনের, সবার ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর, তেমনি শতভাগ মানুষের অন্তরে কীভাবে আলো প্রজ্জ্বলিত হবে সেই চেষ্টাও করতে হবে। একজন মানুষের মধ্যে যখন শৈল্পিক গুণাবলি থাকে তখনই সে সোনার মানুষ হয়।

আগে আমরা কয়লার ইস্ত্রি ব্যবহার করতাম। কয়লার মাঝখানে একটু আগুন জ্বলত, সেখানে পাখা দিয়ে বাতাস দিলে ছোট্ট একটু স্ফুলিঙ্গ থেকে আস্তে আস্তে আগুন ছড়িয়ে পড়ত। সমাজে আমরা সেরকম বাতাস প্রবাহিত করতে চাই।

লেখক: ঋত্বিক নাট্যপ্রাণ ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ