Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

ছেলেবেলার ঈদ

এখন খরচ করাই যেন ঈদের মূল আনন্দ

Afsan  Chowdhury

আফসান চৌধুরী

বুধবার, ১০ এপ্রিল ২০২৪

তদিন পর এ বয়সে এসে ঈদের দিকে তাকালে অনেক পর্যায় দেখতে পাই। দেশ-বিদেশে অনেক সময় দেখতে পাই। দেশের বাইরেও কয়েকটা ঈদ কাটিয়েছি। ছেলেবেলার ঈদের কথা বলতে গেলে ৫০ দশকের ঈদের কথাই মনে পড়ে। আমার জন্ম ১৯৫২ সালে, টিকাটুলিতে। এটা গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে, আমার স্মৃতি ১৯৫৫-এর আগে নেই। তার মানে তিন বছর বয়স থেকে আমার স্মৃতি আছে। তো তিন বছর বয়স থেকে যা মনে পড়ে, তা হলো, পাড়াগুলো পরিবারের মতো ছিল। লোকজন যে নস্টালজিক হয়ে বলে, আহা, আগে পাড়াগুলো কত সুন্দর ছিল, সেসব না। বিষয়টি হচ্ছে আগে পাড়াটা অর্গানিক ছিল। এখন তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হয়ে গেছে। আগে তো সেরকম ছিল না।

টিকাটুলি কাদের পাড়া ছিল, এটা আমি একটু বড় করে বলি। টিকাটুলিতে যারা থাকত তাদের একটা বড় অংশ কলকাতা থেকে চলে এসেছিল। তাদের বড় একটা অংশ ছিল শিক্ষিত। শিক্ষিত মুসলমান বলতে যাদের বোঝায়। যে শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা ভাষা-আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত দেশ গড়ার আন্দোলনটা নিয়ে গেছে। সেটা রাজনৈতিক হোক, সামাজিক হোক, সাংস্কৃতিক হোক, আমি সেই আন্দোলনটার কথা বলছি।

আমি দু-চারজনের নাম বলি তাহলে বোঝা যাবে কেন এটা গুরুত্বপূর্ণ। একজনের নাম বলি, বেগম সুফিয়া কামাল, তিনি টিকাটুলিতে থাকতেন। আমাদের নানি হন। নানি কেন? আমার নানিও থাকতেন তারাবাগে, টিকাটুলির একটু দূরে। নানির ছেলে শামীম মামা, শামীম মামা আমার মামার বন্ধু, তাই শামীম মামা। ফতেহ ভাই (বীর মুক্তিযোদ্ধা ফতেহ আলী চৌধুরী) শাহাদাত ভাই (শাহাদাত চৌধুরী, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং বিচিত্রার সম্পাদক হিসেবে খ্যাত) তারাও ওই পাড়ার মানুষ। আরেকজন ছিলেন খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ- সিকান্দর আবু জাফর। বাংলাদেশের প্রথম সাহিত্য পত্রিকা ‘সমকাল’-এর সম্পাদক।

এ রকম মানুষগুলো ওখানে থাকতেন। যাদের জীবনযাপনের সঙ্গে একটা স্বাভাবিক সংস্কৃতিচর্চা জড়িয়ে ছিল। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, টিকাটুলি থেকে যত মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে, একটা পাড়া থেকে এতসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা খুব কম পাওয়া যাবে। মেজর মতিন, মেজর সালেক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তারা আমাদের বাড়ির উল্টো দিকেই থাকতেন। তারা কলকাতা থেকে এসেছিলেন। নাগরিক সংস্কৃতি যে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, এটা কিন্তু টিকাটুলিবাসীর মাধ্যমে হয়েছে।

সেই পাড়ায় আমি বড় হয়েছি। তখনকার ঈদের দিনের একটা স্মৃতি বলি। তা বললে আমারও মানসিক গঠনটা বোঝা যাবে। তিন বছর পর্যন্ত আমি কখনো মসজিদে যাইনি। আমাদের বাড়িতে ওরকম বিষয়টি ছিল না। তখনকার দিনে খুব অল্প মানুষই মসজিদে যেতেন। তো মসজিদে গিয়ে হঠাৎ আমি শুনলাম হুজুর ওয়াজ করছেন, ‘মুসলমানরা ছাড়া আর কেউ বেহেশতে যাবে না।’ আমার খুব মন খারাপ হয়ে গেল। পাড়ায় যে শুধু মুসলমান থাকত তা তো না। আমাদের বাড়ির পাশে হিন্দুদের একটা মেস ছিল, তারা আমাকে মাঝে মাঝে ডাকতেন, আমি তো ছোট, ডেকে নিয়ে আদর করতেন। তারাও বেহেশতে যাবেন না? বেহেশত কী তাও আমি জানি না। যতটুকু বুঝতে পারছি, সেটা একটা ভালো জায়গা।

বাড়ি এসে আমি মাকে জড়িয়ে ধরে একেবারে কেঁদে দিয়েছি। মাকে আমি বললাম, শুধু নাকি মুসলমানরা বেহেশতে যাবে। হিন্দুরা যাবে না। আমি যে এটা কী বুঝে বলেছি, হয়তো ভেবেছি বাদ পড়ে যাবে। মা আমাকে বললেন, শোন, আল্লাহর কাছে দুধরনের মানুষ আছে। ভালো মানুষ আর খারাপ মানুষ। ভালো মানুষ স্বর্গে যাবে, খারাপ মানুষ যাবে না। এই যে মা আমাকে মুক্তি দিয়ে দিলেন, যে ভালো আর মন্দ, পৃথিবীতে আর কোনো বাছবিচার নেই। এই ভাবনাই আমাকে পরবর্তী জীবনে চালিত করেছে।

পঞ্চাশের দশকে ইফতার খুব জৌলশপূর্ণ ছিল না। আমরা অপেক্ষা করতাম মা কী রান্না করবেন? তখন তো রান্নার যুগ। দোকান থেকে কিনে আনার যুগ না। দোকান থেকে আনলেও খুব কম। বেকারি থেকে কিছু বিস্কিট ও কেকটেক। আমার বাবা বাইরে থেকে খুব বেশি খাবার কিনে আনতেন তা না। ফলে মাকে তখন অনেক বেশি কষ্ট করতে হতো। ইফতারির সময় তখন ছোলা, মুড়ি আর কিছু ফলমুলই খাওয়া হতো। মেহমান আসলে বেগুনিও বানাতেন মা। আমাদের ভাগ্যে খুব একটা জুটত না।

আর ঈদের দিনের খাওয়া ছিল খুব সাধারণ। মুরগি আর বাসমতি চলের পোলাও। আমার স্ত্রী আজও আমাকে বলল, মুরগি আর বাসমতি চাল নিয়ে যাওয়ার জন্য। একশ বছর ধরে বাঙালি মুসলমান ঈদে মুরগি আর পোলাও খাচ্ছে। এখন খাবারে অনেক বৈচিত্র্য এসেছে, আগে অতো বৈচিত্র্য ছিল না। বৈচিত্র্য এলেও মুরগি-পোলাও কিন্তু এখনো আছে।

ঈদের দিনে আরেকটা ব্যাপার ছিল পাড়া বেড়ানো। বেগম সুফিয়া কামালের কথাই বলি। তিনি ছিলেন টিকাটুলির সবচেয়ে মুরব্বি। নানা-নানির বাড়ি ঘুরে আসার পথে ওনার সঙ্গে দেখা করে আসতাম। অনেকেই নানির সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। আড্ডা-গল্পে বেশ একটা জমজমাট সময় কাটতো নানির বাড়ি গেলে; তখন কিন্তু টিকাটুলিতে সেলামির কালচারটা ছিল না। আর টিকাটুলির অধিবাসীরা পুরান ঢাকার লোকজনের কাছ থেকে একটু দূরত্ব বজায় রাখতো। এর একটা কারণ টিকাটুলির লোকজন একটু শিক্ষিত ছিল, তাই একটু নাক উঁচু ব্যাপার ছিল। পুরানা ঢাকা একটু দূরে হলেও, রাস্তা পেরিয়ে ওদিকে কেউ যেতটেত না।

টিকাটুলির সংস্কৃতিটা ছিল একে-অপরের পাশাপাশি থাকার সংস্কৃতিক। হিন্দুরা কিন্তু তখন আস্তে আস্তে চলে যেতে শুরু করেছে। টিকাটুলির সংস্কৃতিটা ছিল সবল শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি পরবর্তীতে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ওপরও প্রভাব বিস্তার করেছে। একাত্তর তো কয়েকটা শ্রেণির যুদ্ধ, গোষ্ঠীর যুদ্ধ। সুশীল যে গোষ্ঠী, আমি সেই অর্থে বলব, টিকাটুলি ছিল একটা সুশীলপাড়া। খুব যে অবস্থাসম্পন্ন তা না, কিন্তু রুচিবান। ওখানে ঈদ খুব বেশি জাঁকজমকের ছিল না। লোক দেখানো ব্যাপারটা ছিল না।

টিকাটুলিতে কোনো বাড়িতে দরজায় নক করার কোনো ব্যাপার ছিল না। দরজা খোলা থাকলে ঢুকে গেলেই হলো। ছোট হলে তো কথাই নেই। অভিনেতা বুলবুল আহমেদ ওই পাড়ায় থাকতেন, আমার মনে আছে, এক দিন তিনি আমাকে কাঁধে নিয়ে হাঁটছিলেন। অনেক দিন পরে তার সঙ্গে দেখা হওয়ায় তিনি বলেছিলেন, কেউ বিশ্বাস করবে এই লোকটাকে আমি কাঁধে নিয়ে হেঁটেছি।

অভিনেতা আলী যাকের থাকতেন ওই পাড়ায়। তাকে সারাজীবন ডেকেছি ছটলু মামা। আমার মামাদের বন্ধু। আমি খুব মামা কালচারের মধ্যে বড় হয়েছি। যেহেতু আমার মামারা ওখানে থাকতেন।

যা হোক, ঈদ বলতে যা বোঝায়, তখন ঈদ খুব জাঁকজকমের ছিল না। তখন বাড়িতে আসত ধোপারা। পুরোনো কাপড়গুলোই ধোপাদের দিয়ে ধোয়ানো হতো। আর বাড়িতে আসতো চুল কাটার একজন শীল। নাপিত। আশির দশকের আগ পর্যন্ত আমি সেলুনে গিয়েছি বলে মনে পড়ে না। দর্জিও কিন্তু তখন বাড়িতে এসে কাপড়ের মাপ নিয়ে যেতেন। দোকানে গিয়ে কাপড় বানানোর চল ছিল না।
একটা স্মৃতি বলে এই লেখা শেষ করি। ঈদে আমার জন্য একটা পাঞ্জাবি বানানো হয়েছে। পাঞ্জাবিটা একটু টাইট হয়ে গেছে। আমার মুখ কালো। বাবা বাড়ি আসার পর আমার মুখ দেখে বললেন, কী হয়েছে? আমি কান্না শুরু করে দিলাম।

তখন আমার বয়স কত হবে? পাঁচ-ছয় বছর হবে। তখন আমরা দিলু রোডে থাকি। ষাট-একষট্টি সালের কথা। আমাদের একটা জিপ ছিল। বাবা আমাদের জিপে করে নিয়ে গেলেন চকবাজার। চকবাজার তো গমগম করছে। বাবা আমাকে নতুন একটা পাঞ্জাবি কিনে দিলেন। আমি তো খুব খুশি। আমরা যখন বেরুচ্ছি, বাবার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা। তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন। বাবা সদরঘাটে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের ম্যানেজার ছিলেন, পরে যেটা সোনালী ব্যাংক হয়েছে। তো ওই ভদ্রলোক তার স্ত্র্রীকে নিয়ে সোনার দোকানে ঢুকছেন। বাবা মাকে বললেন, ঈদের জন্য সোনার গয়না কিনতে আসছে।

এভাবে শুরু হলো, ষাট দশক থেকেই মূলত মানুষের হাতে পয়সা এসেছে। এরপর থেকেই ঈদ উপলক্ষে খরচ করতে শুরু করল। পয়ষট্টি-ছিষট্টি সালের দিকে। এর আগে কিন্তু খরচের ব্যাপারটা তেমন ছিল না। এখন তো খরচ করাই যেন ঈদের মূল আনন্দ। এখনকার মানুষজন পঞ্চাশ-ষাট দশকের ঈদের আমেজটা ঠিক বুঝতে পারবে না।

লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক ও সাংবাদিক

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ