আশুলিয়ায় ৬ মাসে ১৫৯ জনের আত্মহত্যা, ৯০ শতাংশ পোশাক শ্রমিক
গত ছয় মাসে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায় আত্মহত্যার হার। জানা যায়, গত ছয় মাসে আশুলিয়া থানায় ১৫৯টি আত্মহত্যার ঘটনার রেকর্ড পাওয়া গেছে। এছাড়াও থানা পুলিশকে অবহিত না করেই দাফন করা হয়েছে বেশ কয়েকজনের মরদেহ।
পুলিশ সূত্র জানায়, প্রতিদিনই এক বা একাধিক আত্মহত্যার খবর আসে থানায়। এদের মধ্যে ৯০ ভাগই হচ্ছেন পোশাক শ্রমিক।
হঠাৎ করে এত পোশাক শ্রমিকের আত্মহত্যার ঘটনায় চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায়, বললেন বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক অ্যান্ড সোয়েটার শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইনবিষয়ক সম্পাদক খাইরুল মামুন মিন্টু।
তিনি ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, পোশাক শ্রমিকদের ওপর এমনই চাপ থাকে। পরিবারের পাশাপাশি কারখানার পরিবেশের একটা চাপ পড়ে তাদের ওপর। তাই পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি কারখানা কর্তৃপক্ষের উচিত তাদের মানসিক চাপ কমাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
আশুলিয়া থানা পুলিশ, স্থানীয় শ্রমিক নেতা, সংবাদ মাধ্যম ও শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা এনজিওগুলোর তথ্য মতে গত এক বছরেই আশুলিয়ায় আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে গেছে। এই তালিকায় পোশাক শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি।
৫ আগস্ট-পরবর্তী পরিস্থিতিতে অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে বহু শ্রমিক বেকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে জীবিকা নির্বাহ করা নিয়ে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। ফলে, আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) থেকে মঙ্গলবার (১১ ফেব্রুয়ারি) এই ২৪ ঘন্টায় আত্মহত্যা করেন চারজন পোশাক শ্রমিক। শ্রমিক দম্পতি- শাওন ও হাফিজা কোনো এক অজানা কারণেই একই রশিতে ঝুলে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। একই দিনে আশুলিয়ার একটি কারখানা থেকে মোস্তফা নামে একজনের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। সেদিনই উদ্ধার করা হয় আশুলিয়ার কাঁঠালবাগান এলাকার ফারজানা বেগম নামে আরেক পোশাক শ্রমিকের মৃতদেহ।
জানা যায়, শিল্পাঞ্চল সাভারে প্রায় ত্রিশ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করেন। এখানে রয়েছে ১৮০০-এর বেশি শিল্পকারখানা, রয়েছে বিভিন্ন জেলা থেকে আগত কারখানা শ্রমিকদের বসতি। আত্মহত্যা করা পোশাক শ্রমিকের ৫৫ শতাংশ নারী ও ৪৫ শতাংশ পুরুষ বলে প্রাথমিক ধারণা দিয়েছে এনজিও ও শ্রমিক সংগঠনগুলো।
তারা জানিয়েছে, এ আত্মহত্যার পেছনে রয়েছে বেশ কয়েকটি কারণ। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে রয়েছে পারিবারিক কলহ, আর্থিক সমস্যা, প্রেম সংক্রান্ত ও মানসিক চাপ।
আত্মহত্যা করেছেন এরকম কয়েকটি পরিবারের সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যারা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন, তাদের অধিকাংশই নারী শ্রমিক। স্বামী কর্তৃক নির্যাতিত হয়ে বা পারিবারিক কলহের জের ধরে তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন মানবাধিকার কর্মীরা। পুরুষদের আত্মহত্যা করার পেছনে প্রধান কারণ বলা হচ্ছে হঠাৎ বেকারত্ব। এছাড়াও রয়েছে পারিবারিক কলহ ও কর্মক্ষেত্রে অত্যধিক মানসিক চাপ।
আত্মহত্যার চেষ্টা করেও বেঁচে ফিরেছেন এমন দুইজন পোশাক শ্রমিকের সঙ্গে কথা হয় ভিউজ বাংলাদেশ-এর। (সামাজিক নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের ছদ্মনাম ব্যবহার করা হলো)
রিয়াদ (২০) আশুলিয়ার জামগড়া বেরন এলাকার একটি পোশাক কারখানার শ্রমিক। গত ২২ ডিসেম্বর তিনি ভাড়া বাসায় নিজ কক্ষে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। কেন এই পথ বেছে নিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত তিন বছর আগে গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জ থেকে আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেন। প্রথমে একটি ফিলিং স্টেশন নিরাপত্তার চাকরি নেন। পরে স্থানীয় একজনের মাধ্যমে চাকরি নেন একটি পোশাক কারখানায়। মাস শেষে বেতনের বড় একটা অংশ বাড়িতে পাঠিয়ে নিজে কোনোরকমে চলেন। এর মাঝে পরিচয় হয় তানিয়া (ছদ্মনাম) নামের আরেক পোশাক শ্রমিকের সঙ্গে। এক মাসের মাথায় নিজেদের পছন্দে পরিবারের সম্মতি ছাড়াই বিয়ে করেন তারা। বিয়ের দেড় বছর পর থেকেই স্ত্রী তানিয়ার সঙ্গে বেতনের টাকা নিয়ে নিয়মিত ঝগড়া লাগতো তার। এদিকে স্ত্রী আরেকটি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে এরকম খবর জানার পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি। নিজের ভাড়া বাসায় আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।
আরেক পোশাক শ্রমিক সোমা (২৬) জানান, পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় তার। শ্বশুরবাড়িতে নানারকম অত্যাচারের শিকার হয়ে স্বামীকে নিয়ে চলে আসেন আশুলিয়ার বাড়ইপাড়া এলাকায়। স্বামী একটি ছোট চায়ের দোকান দিয়ে কোনো রকম সংসার চলতো। তবে দুই মেয়ের পড়াশোনার খরচ জোগাতে তিনি চাকরি নেন ওই এলাকার একটি পোশাক কারখানায়। আয়ের উৎস তৈরি হবার পরে, টাকা-পয়সার জন্য চাপ দিতে থাকেন স্বামী। এরপর অত্যাচার শুরু হয় সোমার ওপর। অবশেষে স্বামীকে রেখে দুই মেয়েকে নিয়ে আলাদা বাসায় উঠেন তিনি। কিন্তু সেখানেও তাকে বিরক্ত করা শুরু করেন স্বামী। ঘরে এবং বাইরের মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন তিনি।
আত্মহত্যার মাঠপর্যায়ের তদন্ত করেন স্থানীয় থানা পুলিশ। সুরতহাল ও প্রাথমিক তদন্তের জন্য কাজ করেছেন উপ-পরিদর্শক জসিম উদ্দিন। তিনি ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘স্থানীয়দের খবরের ভিত্তিতে আমরা লাশ উদ্ধার করি। এদের মধ্যে অধিকাংশই নিম্ন আয়ের মানুষ, বিশেষ করে পোশাক শ্রমিক।’
শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ মমিনুল ইসলাম ভূইয়া ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘অনেকেই বেকারত্ব নিরসনের জন্য গ্রাম থেকে শহরে আসে কাজের সন্ধানে। এমনিতেই নিম্ন আয়ের কারণে তারা মানবেতর জীবনযাপন করেন আবার অনেকেই বাল্যবিয়ে বা নিজেদের পছন্দে বিয়ে করেন। অর্থনৈতিক মন্দার পাশাপাশি যুক্ত হয় পারিবারিক কলহ। এসব কারণগুলো নিয়ে আমরা কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনা বৃদ্ধির কাজ করছি। অনেক সাড়া পাচ্ছি এবং আশা করছি এ অবস্থার দ্রুত উন্নয়ন হবে।’
আত্মহত্যার তালিকায় থাকা বাকিদের মধ্যে বেশিরভাগই শিক্ষার্থী, আবার কেউ কেউ মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় ছিলেন বলে জানা যায়।
পারিবারিক ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, প্রেমে ব্যর্থতা, পড়াশোনায় চাপ, সহপাঠিদের তিরস্কার, বাবা-মার অতিমাত্রার শাসনে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন অনেক শিক্ষার্থী।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, আত্মহত্যার প্রবণতা রোধে দরকার পারিবারিক সচেতনতা। দাম্পত্য জীবনে আরও যত্নশীল হওয়ার এবং সন্তানদের প্রতি আরও সহনশীল হওয়ার পরামর্শ দেন তারা।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে