Views Bangladesh Logo

ফের উত্তপ্ত হওয়ার শঙ্কায় আশুলিয়া-সাভার শিল্পাঞ্চল

ইনক্রিমেন্ট ৯ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাবনা এবং বার্ষিক ছুটির আর্থিক পাওনা নিয়ে তৈরি জটিলতা নিরসনসহ বেশ কিছু দাবিতে ফের আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন সাভার-আশুলিয়ার পোশাক শ্রমিকরা। বিশেষ করে বেশি শ্রমিক অধ্যুষিত এবং ছোট ছোট কারখানাগুলোতে অসন্তোষ তৈরি হচ্ছে। এতে দীর্ঘ অস্থিরতার পর বর্তমানে স্বাভাবিক থাকা শিল্পাঞ্চলের পরিস্থিতি আবারও উত্তপ্ত হওয়ার শঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।

সূত্র জানায়, ডিসেম্বর মাসে কার্যকর হওয়া ৯ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট ইস্যুতে নতুন বছরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মাঠে নামতে চান আশুলিয়ার শত শত কারখানার শ্রমিকরা। এখন জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের বেতন পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন তারা।

বিভিন্ন কারখানার শ্রমিক, ফেডারেশনের নেতা ও শিল্পপুলিশ কর্মকর্তারাও বলছেন, শিল্পাঞ্চল সাভার-আশুলিয়ার পরিস্থিতি মাসখানেক ধরে স্বাভাবিক মনে হলেও আশঙ্কা রয়েছে অস্থিতিশীলতা তৈরির। এর পেছনে কারখানা মালিকদের গাফিলতিকেই দুষছেন তারা।

তাদের মতে, নয় শতাংশ বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট বৃদ্ধির কথা বলেও এক বছরের শর্ত জুড়ে দিয়েছেন কারখানার মালিকরা। এতেই ক্ষুব্ধ বিশেষত এক বছরের নিচে কর্মরত শ্রমিকরা। বর্তমান বেতনের সঙ্গে বর্ধিত ইনক্রিমেন্ট না পেলে আন্দোলনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। এসব সমস্যার সমাধান এখনই করা না হলে আশুলিয়া-সাভার থেকে অসন্তোষ ছড়িয়ে যেতে পারে পুরো দেশের পোশাক খাতে।

বেতন বৃদ্ধিজনিত অসন্তোষ থেকে গত বছরের জুন থেকে শুরু করে জুলাই-আগস্টে কোটা সংস্কারের আন্দোলন চলাকালে উত্তপ্ত ছিল শিল্পাঞ্চল। সরকার পতনের পরের তিন মাসে নিত্যনতুন দাবি নিয়ে একেকদিন একেক কারখানায় পালাক্রমে চলেছে আন্দোলন। এমনকি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক-মহাসড়ক আটকে টানা দুই-তিন দিন পর্যন্ত বিক্ষোভ করেছেন পোশাকশ্রমিকরা।

পরে দাবিগুলো যাচাই-বাছাই এবং দফায় দফায় বৈঠকে টিফিন ও হাজিরা বোনাস বাড়ানোসহ বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা দেয় পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। হাজিরা বোনাস মাসে অতিরিক্ত ২২৫ টাকা ও টিফিন বিল দৈনিক অতিরিক্ত ১০ টাকার পাশাপাশি নাইট বিল ন্যূনতম ১০০ টাকা করা হয়। নিজ নিজ উদ্যোগে আরও কিছু যৌক্তিক দাবি মেনে নেয় বিভিন্ন কারখানা কর্তৃপক্ষ।

এতে নভেম্বরের শেষ নাগাদ আন্দোলন কিছুটা কমলেও ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে নিত্যনতুন দাবি তুলছেন শ্রমিকরা। এরই মাঝে পোশাকশিল্পের বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ৯ শতাংশের সুপারিশ করে ‘বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট বৃদ্ধির সক্ষমতা ও করণীয় বিষয়ক’ কমিটি। কিন্তু চাকরির মেয়াদকাল নিয়ে শর্ত জুড়ে দেয়ায় মালিকপক্ষের সঙ্গে শ্রমিকদের তৈরি হয়েছে নতুন জটিলতা। শর্ত অনুসারে, বর্তমান কর্মস্থলে যেসব শ্রমিক এক বছরের বেশি সময় ধরে কর্মরত, তারাই শুধু রয়েছেন ইনক্রিমেন্টের তালিকায়। এক বছরের কম সময় ধরে কর্মরতদের কোনো ইনক্রিমেন্ট হচ্ছে না।

সূত্র আরও জানায়, কমিটির পঞ্চম সভা শেষে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে বৈঠক করেই ইনক্রিমেন্ট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হলেও অনেক কারখানার নেই সক্ষমতা। আবার নতুন বছর থেকেই ইনক্রিমেন্ট বৃদ্ধি কার্যকর করা কারখানা মালিকদের বিরুদ্ধে উঠেছে ইনক্রিমেন্ট জটিলতা বাড়ানোর অভিযোগও।

শ্রমিকদের দাবি, যারা এক বছরের নিচে কর্মরত, তাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই যেন এ জটিলতার সমাধান করা হয়।

ক্ষোভ প্রকাশ করে গিলডেন বাংলাদেশ লিমিটেড কারখানার পোশাকশ্রমিক তানজিলা ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘যারা এক বছর ধরে বর্তমান কর্মস্থলে কাজ করছেন তারা ইনক্রিমেন্ট পাবেন নয় শতাংশ। আর আমরা যারা এক বছরের কম, তারা কিছুই পাবো না। আমরা চাই, আমরা যারা এক বছরের কম তাদের যেন কিছু দেয় বা অর্ধেক দেয়। এতেই আমরা খুশি। বাজারে জিনিসপত্রের যে দাম বেড়েছে, সেটাতে তো সরকার বলছে, কম নেয়া হোক। উল্টো বাড়ছে। কীভাবে চলবো আমরা?’

আঞ্জুমান গার্মেন্টস লিমিটেড কারখানার শ্রমিক সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘শুনেছি, বেতন বাড়বে। তবে আমরা যারা ছয় মাস, সাত মাস ধরে কারখানা পরিবর্তন করেছি, তাদের বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা আসেনি। এখন তাদের বেতন বাড়লেই বাজারে দাম বাড়বে, বাসাভাড়া বাড়াবেন বাড়িওয়ালারাও। তারা তো বলবেন না যে, ওদের এক বছর হয়নি, ওদের কাছ থেকে বেশি দাম বা ভাড়া নেয়া হবে না। বিজিএমইএ যেন আমাদের বিষয়টিও বিবেচনা করে’।

গার্মেন্টস শ্রমিক অ্যান্ড সোয়েটার শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইনবিষয়ক সম্পাদক খাইরুল মামুন মিন্টুও শ্রমিকদের দাবির সঙ্গে একমত।

তিনি বলেন, ‘২০২৩ সালের পর এই প্রথম ইনক্রিমেন্ট বেড়েছে। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর ৫ হাজারেরও বেশি কারখানা রয়েছে আশুলিয়া-সাভারে। সব কারখানায় নতুন ইনক্রিমেন্ট বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জের। বছরের শুরুতে শ্রমিকদের বার্ষিক ছুটির টাকাও বড় বিষয়। প্রতিটি কারখানায় ইনক্রিমেন্ট ও ছুটির টাকা যথাযথভাবে দেয়ার উদ্যোগ নিতে সরকারকে আহ্বান জানাই। শ্রমিকদের অন্য দাবিগুলোও অতি দ্রুত মেনে নিতে বিজিএমইএ ও কারখানা মালিকদের অনুরোধ জানাচ্ছি। যেন কোনোভাবেই শিল্পাঞ্চলে আবারও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি না হয়।’

জাতীয় গার্মেন্টস ফেডারেশন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও আশুলিয়া থানা কমিটির সভাপতি ফরিদুল ইসলামের শঙ্কা, ‘আশুলিয়ার পরিবেশ শান্ত রয়েছে। আশা করি, থাকুক সব সময়। তবে কিছুটা সংশয় কাজ করছে। সেটা হলো, চলতি সপ্তাহের বেতনের পর পরই নয় শতাংশ ইনক্রিমেন্ট ইস্যুতে কিছু কিছু কারখানায় অসন্তোষ দেখা দিতে পারে। বিজিএমইএ ও কারখানা মালিকদের বলবো, তারা যেন এক বছরের নিচে কর্মরত শ্রমিকদের নিয়েও পুনর্বিবেচনা করেন। অথবা তাদের সঙ্গে এখনই আলোচনা ও সংকটের নিরসন করেন। নয়তো বেতনের পর যখন দেখা যাবে, অসংখ্য শ্রমিকের কোনো ইনক্রিমেন্ট আসেনি, তখনই শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেবে।’

আশুলিয়ার জামগড়ার প্রাইম ক্যাপ বিডি লিমিটেড কারখানার প্রশাসনিক কর্মকর্তা ফারুক আহমেদের দাবি, গত কয়েকদিন আগে আসা বিজিএমইএর ঘোষণাটি জটিলতা তৈরি করবে বলে মনে হচ্ছে না। একসঙ্গে ইনক্রিমেন্ট বাড়লে অনেকের বেতন দ্বিগুণ হয়ে যাবে। এ ছাড়াও শ্রমিকদের বেতন-বোনাস কাঠামো তৈরির পাশাপাশি বিজিএমইএর নির্দেশনা অনুসারে প্রতিটি কারখানায় স্বল্পমূল্যে টিসিবির পণ্য বিক্রি হচ্ছে। এতে বাজার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি কমানো যাবে। তবে বাড়িওয়ালারা একটু সহনশীল হলে শ্রমিকদের খারাপ পরিস্থিতিতে পড়তে হয় না।’

তবে গার্মেন্টস শ্রমিক অ্যান্ড সোয়েটার শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইনবিষয়ক সম্পাদক খাইরুল মামুন মিন্টু বলেন, ‘বিজিএমইএ যে ইনক্রিমেন্টের কথা বলছে, তা মেনে নেবেন না অধিকাংশ শ্রমিক। মালিকদেরও দাবি, একেকজন শ্রমিকের বেতন দ্বিগুণ হয়ে যাবে। এখানেই ফাঁকি দিচ্ছেন তারা। কারণ, কর্মকাল এক বছর হলেই কেবলমাত্র শ্রমিকের বেতন ৯ শতাংশ বাড়বে। বেশিরভাগ শ্রমিকই ঘন ঘন কর্মস্থল বদলাতে বাধ্য হওয়ায় এর বাইরে থেকে যাবেন। তাহলে যাদের বাড়বে না, তারা কি করবেন? তাই আমাদেরও দাবি, যার এক বছর হয়নি, তাকে এখন কিছু দেয়া হোক। পরবর্তীতে এক বছর পূর্ণ হলে ৯ শতাংশ দেবেন।’

এই শ্রমিক নেতারও শঙ্কা, ‘মালিকপক্ষ জটিলতা তৈরি করলে আবারও শ্রমিকরা ক্ষেপে গিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে যাবেন।’

শিল্পপুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ মমিনুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, ‘পরিস্থিতি এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। এ অবস্থা কতদিন থাকবে বলা যাচ্ছে না। একটা ঝুঁকি রয়ে গেছে। কেননা, প্রতিদিনই কোনো না কোনো কারখানায় হাজিরা বোনাস ও ইনক্রিমেন্ট নিয়ে সমস্যার খবর পাচ্ছি। ধারণা করছি, খুব তাড়াতাড়ি আবারও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তাহীনতার অজুহাতে মালিকরা সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসছেন না। তবে আমরা কাজ করে যাচ্ছি, মালিকপক্ষের সঙ্গে কথা বলছি, শ্রমিকপক্ষের সঙ্গেও আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি।’

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ