ট্রাম্পকে হত্যার চেষ্টা কি একক সন্ত্রাসীর কাজ?
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন পেনসিলভেনিয়াতে নির্বাচনি প্রচারণায় বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখন ২০ বছর বয়সী এক তরুণ তাকে মারার জন্য গুলি ছুড়েছিল। এই ঘটনা এখন কেবল যুক্তরাষ্ট্রে নয়, বিশ্বজুড়েই আলোচিত বিষয়। ৭৮ বছর বয়সি সাবেক প্রেসিডেন্টের কানে গুলি লাগে বলে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। বন্দুকধারীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হত্যা করেছে। এ ঘটনায় উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে দুজন মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন এবং একজন মারা গেছেন।
এখন একটা প্রশ্নই সবার মনে ঘুরছে: এটা কি কেবল একক সন্ত্রাসীর কাজ? বিখ্যাত মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই এখন এর তদন্ত করছে। যদিও মার্কিন বিচারবিভাগ এখনো অক্ষত। এই আইনবিভাগ যারা প্রথমে গড়ে তুলেছিল, তাদের কাছে এর সম্মান ও মূল্য ছিল; কিন্তু এখন দেশটি প্রায় দ্বিজাতি রাষ্ট্রে রূপ নিচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক অংশ, যারা রিপাবলিকান দলের সমর্থক, এখন মনে করছে যে, ২০২০ সালের নির্বাচনে সরাসরি না হলেও গোপনে কারচুপি করা হয়েছিল। ফলে, নির্বাচনের দুমাস পর, নির্বাচনি ফলাফল বাতিল করার জন্য ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি রিপাবলিকান সমর্থকরা যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল বিল্ডিংয়ে জড়ো হয়েছিলেন।
মাঠ গরম ও জল ঘোলা করার জন্য ডেমোক্র্যাটরা তখন ট্রাম্পকে দায়ী করেছিলেন। আধুনিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এমন ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেনি। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, আগামী নভেম্বরে নির্বাচনে ট্রাম্প আবার প্রেসিডেন্ট হোক, এটা কোনোভাবেই ডেমোক্র্যাটরা চায় না। তারা মনে করেন, ট্রাম্প এলেই দেশে আবার বিশৃঙ্খলা শুরু হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির সঙ্গে ইউরোপিয়ানদেরও গভীর সম্পর্ক আছে। তারা চায় ডেমোক্র্যাটরাই আবার ক্ষমতায় আসুক। এ লেখায় তার অনেক কিছু নিয়ে খোলাখুলি কথা বলা হবে। ইউক্রেনের ২০১৪-এর বিপ্লব পরবর্তী ইউক্রেনীয় ইয়াতসেনিউক সরকারকে ২০১৪ সালে কূটনৈতিক সহায়তা দেয়ার চেষ্টা করছিল ওবামা প্রশাসন। তখনকার ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সেই প্রচেষ্টার সম্মুখে ছিলেন।
বাইডেনের পুত্র হান্টার বাইডেন তার পর পরই ২০১৪ সালের ১৮ জুলাই ইউক্রেন জ্বালানি কোম্পানি বুরিসমা হোল্ডিংসের পরিচালনা পর্ষদে যোগ দিয়েছিলেন। জো বাইডেন নিজে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ সফর করেছিলেন ২০১৪ সালের ২১ এপ্রিল। ইউক্রেন সরকারকে তখন তিনি অনুরোধ করেছিলেন রাশিয়া থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি কমানোর জন্য। হান্টার তখন বোয়েস শিলার ফ্লেক্সনারের একজন অ্যাটর্নি। বুরিসমা হোল্ডিংস যেন করপোরেট জগতের সর্বোত্তম স্থানে যেতে পারে সে লক্ষ্যেই নিয়োগ করা হয়েছিল তাকে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা হেরে যায় এবং রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হন।
ট্রাম্প এবং তার শুভানুধ্যায়ীরা অনুমান করেছিলেন যে হান্টার বাইডেন ইউক্রেনের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ইউক্রেনের নতুন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে বিষয়টি তদন্ত করার জন্য চাপ দিয়েছিলেন, কিন্তু পরে তাতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। তখন থেকেই বোঝা যাচ্ছিল ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেনের বিষয়ে ততটা আগ্রহী নন। গত জুন মাসে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেন বিষয়ে একটা বোম ফাটালেন। তিনি জানিয়েছেন, যদি পুনরায় নির্বাচিত হন, তাহলে এর এবার একটা বিহীত করবেন। ট্রাম্প বলেছেন, ‘সে (জেলেনস্কি) আমেরিকায় আসে আর ডলার নিয়ে যায়। চার দিন আগে এসে ৬০ বিলিয়ন ডলার নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছে, বলে গেছে আরও ৬০ বিলিয়ন ডলার লাগবে। তার চাওয়া শেষ হয় না।’
সুতরাং এতে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে, পশ্চিম ইউরোপের ন্যাটো-সদস্য মিত্ররা যখন ইউক্রেনকে সহায়তা দেয়ার চেষ্টা করছে, ট্রাম্প পুনরায় ক্ষমতায় এলে তাতে বাধা পড়বে, মার্কিন সাহায্য কমে যাবে। ইউরোপীয়রা ভালো করেই জানে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি সরে যায়, তাহলে ইউরোপীয়দের জন্য কপালে শনি আছে, তাদের রাশিয়ার খপ্পরে পড়তে হবে, যা তাদের সম্পূর্ণ দুমড়ে-মুচড়ে দিবে। তাই পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো, যেমন- যুক্তরাজ্য, জার্মানি এবং ফ্রান্স মরিয়া হয়ে ডেমোক্র্যাটদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মার্কিন রাজনীতিতে বিভাজন রেখা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। এ প্রতিবেদনে জানা গেছে, ডেমোক্র্যাট আর রিপাবলিকানদের মতভেদ আজ যতটা, তা গত ৫০ বছরেও দেখা যায়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘নিজেদের মতাদর্শের ব্যাপারে দুই দলই এখন অনেক বেশি বেপরোয়া। ক্যাপিটল হিলে এখন মাত্র দুই ডজন মধ্যপন্থি ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান অবশিষ্ট রয়েছে। ১৯৭১-৭২ সালে ছিল ১৬০ জনেরও বেশি।’ আন্তর্জাতিক শান্তির জন্য কয়েক মাস আগে কার্নেগি এনডাউমেন্ট বলেছিলেন, ‘দল ও প্রার্থীরা এখন স্পষ্টতই বিশ্বাস করেন যে যত বেশি তারা মেরুকরণ করবেন ততই তাদের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাদের নিজেদের ভবিষ্যদ্বাণী হচ্ছে, বিপক্ষ দলের বিষোদ্গার করে যারা বক্তৃতা দেন তাদের জনপ্রিয়তাই এখন ভোটারদের কাছে বেশি, বিশেষ করে প্রাথমিক ভোটারদের মধ্যে যাদের পরিচয় কেবল মেরুকরণেই আবদ্ধ। এটাই তাদের এখন দলগত পরিচয়।’ এতে বলা হয়েছে, আমেরিকানরা এখন অন্য দলের লোকজনদের প্রায় ঘৃণা করে।
এরকম এক পরিবেশে এটা বলা সহজ না যে, মাত্র ২০ বছর বয়সী একটি ছেলেকে হত্যা প্রচেষ্টায় উদ্ভূত করতে এর পেছনে কারও হাত নেই। এই হত্যা প্রচেষ্টার পর পরই, ১৩ জুলাইয়ের পর, বিশ্বজুড়ে সংবাদ মাধ্যমগুলো পূর্ববর্তী এরকম ঘটনাগুলো সামনে আনছে। আমাদের মনে রাখা উচিত, প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন চারজন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে হত্যা করা হয়েছে, এবং তাদের সবাইকে গুলি করেই মারা হয়েছে। জন উইলকস বুথ ছিলেন একজন আমেরিকান মঞ্চ অভিনেতা। ১৮৬৫ সালে তিনি ১৬তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনকে গুলি করে হত্যা করেন। ওয়াশিংটন ডিসির ফোর্ড থিয়েটারে ‘আওয়ার আমেরিকান কাজিন’ নাটক দেখছিলেন আব্রাহাম লিঙ্কন। বুথ প্রেসিডেন্ট বক্সে ঢুকে লিঙ্কনের মাথায় গুলি করেন। আমেরিকান গৃহযুদ্ধ যখন প্রায় শেষের পথে, ঠিক তখনই এ ঘটনা ঘটেছিল। বুথ এবং তার সহ-ষড়যন্ত্রকারীরা লিঙ্কনকে একজন অত্যাচারী হিসেবে দেখতেন।
তাদের মতে, লিঙ্কন সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন এবং সংবিধান লঙ্ঘন করেছিলেন। ১৯০১ সালে লিওন চোলগোস মার্কিন প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ম্যাককিনলিকে হত্যা করেছিলেন নিউইয়র্কের বাফলোতে। ১৯৬৩ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে হত্যা করেছিলেন লি হার্ভে অসওয়ার্ল্ড। কেনেডি তখন তার স্ত্রী জ্যাকলিনকে নিয়ে টেক্সাসের ডালাসে একটি উন্মুক্ত গাড়িতে ছিলেন। এ ছাড়াও আরও ছয়জন প্রেসিডেন্টকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল, ভাগ্যক্রমে তারা বেঁচে যান। ১৮৩৫ সালে প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্র জ্যাকসন ওয়াশিংটন ডিসিতে একটি কংগ্রেসনাল অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যাচ্ছিলেন রিচার্ড লরেন্স নামে এক আততায়ী তখন লুকিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। রিচার্ড ছিলেন একজন বেকার চিত্রশিল্পী। জন ফ্লাম্যাং শ্র্যাঙ্ক ছিলেন একটি সরাইখানার মালিক, ১৯১২ সালে তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্টকে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন। ভাগ্যক্রমে রুজভেল্ট হত্যা প্রচেষ্টা থেকে বেঁচে যান। জুসেপ্পে জাঙ্গারা ছিলেন একজন ইতালীয় অভিবাসী। বেকারদশায় ঘুরছিলেন। ১৯৩৩ সালে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টকে হত্যা করেছিলেন।
রুজভেল্ট তখন ফ্লোরিডার মিয়ামি বে ফ্রন্ট পার্কে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। জাঙ্গারা পাঁচলি গুলি বসিয়ে দেন প্রেসিডেন্টের বুকে। পুয়ের্তো রিকান দুই স্বাধীনতাপন্থি কর্মী অস্কার কোলাজো এবং গ্রিসেলিও টরেসোলা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫তম প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যানকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন ১৯৫০ সালে। লিনেত্তে ফ্রোম ক্যালিফোর্নিয়ার স্যাক্রামেন্টোতে প্রেসিডেন্ট ফোর্ডকে গুলি করার চেষ্টা করেছিলেন। গুলি করার আগেই সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টদের দ্বারা তাকে থামানো হয়েছিল। ওয়াশিংটন ডিসির হিলটন হোটেল থেকে বের হওয়ার সময় প্রেসিডেন্ট রিগান ও তার নিরাপত্তারক্ষীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছিলেন জন হিনকলি জুনিয়র। রিগান মারাত্মকভবে আহত হয়েছিলেন এবং ১২ দিন হাসপাতালে কাটিয়েছিলেন।
লেখক: সাংবাদিক ও লেখক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে