Views Bangladesh Logo

বিদেশি ব্র্যান্ডের ওপর হামলা দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে

সরায়েলের বোমার আঘাতে এখন আর কেবল বাড়ি-ঘর ধ্বংস হয় না, ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনকণার সঙ্গে মানবদেহও আকাশে উড়ছে। অকল্পনীয় ও হৃদয়বিদারক দৃশ্য। ইসরায়েলকে কেউ থামাতে পারল না, পারবেও না। অসহায় সাধারণ মুসলমান অহর্নিশ সৃষ্টিকর্তার করুণা ভিক্ষা করছে, দোয়া করছে, প্রার্থনা করছে বিগত ৭৬ বছর ধরে। ছিয়াত্তর বছর ধরে ভিটেবাড়ি ছাড়া ফিলিস্তিনিরা, ২০ লাখ অধিবাসীর গাজা বিগত পনেরো মাস ধরে আমেরিকা আর ইসরায়েলের বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হচ্ছে, প্রতিদিন লোক মরছে, আহত হচ্ছে, অসংখ্য লাশ ভবনের নিচে চাপা পড়ে আছে, খাবার নেই, বিদ্যুৎ নেই, পানি নেই। এত লাশ, কবর দেয়ার জায়গা নেই। স্বজন, সম্পদ, আশ্রয় সব হারিয়ে নিঃস্ব গাজাবাসী। এমন রোমহর্ষক দৃশ্য দেখেও জগতবাসী নির্বিকার। মনে হচ্ছে ফিলিস্তিনিরা মানুষ পদবাচ্য নয়, মানুষ হলে শত শত শিশুর মৃত্যুতে যুদ্ধ এতদিনে থেমে যেত। জগতে সৃষ্ট প্রজাতির মধ্যে মানুষ হচ্ছে সবচেয়ে হিংস্র প্রাণী, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে দিয়ে তা প্রমাণ করা সহজ।

অবশ্য এই হিংস্র মানুষটিকে উন্মাদ করে দিয়েছে হামাস। নিজের শক্তি সম্পর্কে অতিরিক্ত আস্থা ও বিশ্বাস থাকায় হামাস ইসরায়েলের অভ্যন্তরে হঠাৎ আক্রমণ করে বেসামরিক ইসরায়েলিদের হত্যা করেছে, নিপীড়ন করেছে, জিম্মি করেছে। প্রতিশোধ নিতে গিয়ে গাজার অভ্যন্তরে যেখানেই নড়াচড়া চোখে পড়েছে, সেখানেই গুলি করে ইসরায়েলের সেনারা তা স্তব্ধ করে দিচ্ছে। ইসরায়েলের সেনাদের কথাবার্তায় কোনো রাখঢাক নেই, ২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাস যোদ্ধারা তাদের মেরেছে, এখন তারা ফিলিস্তিনিদের মারছে। এক সেনার উক্তি, ‘আমরা তাদের মারতে এসেছি। আমরা তাদের স্ত্রী, সন্তান, কুকুর, বিড়াল- সবকিছুই মারছি।’

জগতবাসী ধরে নিয়েছে, ফিলিস্তিনিদের হত্যার অধিকার ইসরায়েলের রয়েছে; কারণ আমেরিকার প্রেসিডেন্টের বদল হলেও ইসরায়েলের পক্ষে আমেরিকার সমর্থনের কোনো পরিবর্তন হয় না। মুসলিম সমাজের হম্বিতম্বি শুধু নিজেদের মধ্যে। তাদের আনন্দের সীমা থাকে না যখন পাকিস্তান এটম বোমা বানায়, তাদের খুশির খুশবো ছড়ায়, যখন মুসলমানের সংখ্যা বাড়ে; কিন্তু সংখ্যা বাড়িয়ে কী লাভ! ২০০ কোটি মুসলমান দেড় কোটি ইহুদির কাছে মার খাচ্ছে। লাঠি আর তলোয়ারের যুদ্ধ হলে অবশ্য মুসলমানদের জয় ঠেকিয়ে রাখা যাবে না; কিন্তু সর্বাধুনিক প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তলোয়ার অকেজো। যুদ্ধ শুধু অস্ত্রে হয় না, গোয়েন্দা তথ্য মুখ্য। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি তৈরি করার ক্ষেত্রে ইসরায়েল শ্রেষ্ঠ। বিজ্ঞান বিমুখ মুসলমান জাতি অতীতমুখী, অতীতের অহঙ্কার নিয়ে বর্তমান জয় করতে চায়।

মুসলিম বিশ্বের খলিফা হওয়ার বাসনা পোষণ করে তুরস্ক এবং সৌদি আরব। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানকে হতাশাগ্রস্ত মুসলিমের ত্রাতা হিসেবে ভাবা হচ্ছিল, গাজাবাসীদের নির্মূল অভিযানে তার নিষ্ক্রীয়তায় সবাই হতাশ। ইরানের বিরাট বিরাট গোলাবারুদ দেখে আমরা আশান্বিত হয়েছিলাম; কিন্তু ইরানের ওপর ইসরায়েলের আক্রমণের নমুনা দেখে ইরান একেবারেই নিশ্চুপ হয়ে গেছে। ইরানের নিক্ষিপ্ত তিনশত ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের মধ্যে মাত্র তিনটি ইসরায়েলের মাটিতে পড়েছে, বাকিগুলো আকাশেই ধ্বংস হয়ে গেছে।

হামাসের জন্য দুঃখজনক হচ্ছে, ইরানের নিক্ষিপ্ত বোমা ধ্বংস করেছে মুসলিম দেশ জর্ডান। মুসলিম দেশগুলোর একটি ফোরামের নাম ‘আরব লীগ’। ইসরায়েল কর্তৃক গাজা আক্রমণের পর কয়েকবার এই ফোরামের বৈঠক হয়েছে, কেন বৈঠক করেছে, তা কেউ জানে না। ৫৬টি মুসলিম দেশের অবস্থাও তথৈবচ, এরা কেউ কারও কর্তৃত্ব মানে না, এরা মানে আমেরিকা বা রাশিয়ার কর্তৃত্ব। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো সমৃদ্ধশালী দুটি দেশ ইরাক এবং লিবিয়াকে আমেরিকার সঙ্গে এক হয়ে ধ্বংস করেছে, ধ্বংস করছে সিরিয়া আর ইয়েমেনকে। ইয়েমেনের হুতি, লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইরান ছাড়া বাকি মুসলিম দেশগুলো হামাসের ধ্বংস চায়; কারণ হামাসেরা মিশরের ব্রাদারহুড সংগঠনের শিষ্য। ব্রাদারহুড উগ্রপন্থি, নির্বাচনে জয় লাভ করেও আমেরিকার বিরোধিতার কারণে তারা ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। মধ্যপ্রাচ্যের রাজা-বাদশাহরা মনে করে হামাসের চেয়ে ইসরায়েল তাদের রাজত্বের জন্য অনেক বেশি নিরাপদ।

ফিলিস্তিনিদের এমন দুর্দশা কেন হচ্ছে তা সবাই ভালো জানেন। তাই আমাদের ধৈর্য ধারণ করা উচিত; কিন্তু আমরা তা না করে দেশের অভ্যন্তরে বিদেশি বিনিয়োগ নষ্ট করছি। আমরা কেএফসি, বাটাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হামলা করছি, ভাঙচুর করছি, লুটতরাজ করছি। হাজার হাজার লোক এসব প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে, এসব প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশের বিনিয়োগ রয়েছে, এগুলো ধ্বংস করলে ইসরায়েলের কী ক্ষতি হবে? কেএফসির খাবার হারাম হলে লুট করে বাসায় নিয়ে খেলে কি হালাল হয়ে যাবে? বাটার জুতা ইহুদিদের হলে লুট করে আমরা তা বাসায় নিচ্ছি কেন? ভারতের জিনিসও বয়কট করার স্লোগান দিয়েছিলাম, ভারতীয় পণ্য অপাঙক্তেয় হলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও অপাঙক্তেয় হওয়ার কথা; কিন্তু তার সঙ্গে মিলিত হওয়ার এত আগ্রহ কেন? কোকা-কোলা বয়কটের উন্মাদনায়ও আমরা কিছুদিন মাতোয়ারা ছিলাম, যদিও কোকা-কোলার সঙ্গে ইসরায়েল বা ইহুদিদের কোনো সম্পর্ক নেই।

মুসলমানদের একটা ভালো গুণ আছে, জগতের সব বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েও আল্লাহর কাছে ন্যায়বিচার পাওয়ার প্রত্যাশা করে। সান্ত্বনা লাভের জন্য প্রতিটি ঘটনার কার্যকারণ খোঁজে, মিয়ানমারের ভূমিকম্পকে বলে ‘আল্লাহর গজব’, আর তুরস্কের ভূমিকম্প বা গাজার ধ্বংসলিলাকে বলে ‘আল্লাহর পরীক্ষা’। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েও গাজার ফিলিস্তিনিরা মনে করে ইসরায়েলের পতন একদিন হবেই। ইসরায়ালের পতন নিশ্চিত জেনেও গাজাবাসী প্রাণভয়ে এখন পালাচ্ছে, এই পালানোর দৃশ্য দেখলে বোঝা যায় জীবনের মায়া কত বেশি। প্রাণ রক্ষার্থে পালায়নপর অগণিত গাজাবাসীর মধ্যে চার বা পাঁচ বছরের একটি শিশু রাস্তায় হতবিহ্বল হয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, তার মা-বাবা হারিয়ে গেছে, তাকে কোলে তুলে নিয়ে কেউ দৌড়ানোর গরজ বোধ করছে না, এমন কী তার দিকে কারও তাকানোর সময়ও নেই। আরেকটি দৃশ্য আরও করুণ, এক নারী পথিমধ্যে পরিত্যক্ত দুধের একটি শিশুকে কোলে তুলে নিয়ে দৌড়াচ্ছেন। গাজাবাসীর দুর্দশার এই চিত্র আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় একাত্তরকে।

একাত্তরে পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের দোসর রাজাকাররা মিলে ইসরায়েলের সৈন্যদের মতো বোমা মেরে, গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে আমাদের নির্যাতন, নিপীড়ন ও হত্যা করেছে। ইসরায়েলের সৈন্যরা ধর্ষণ করছে এমন কথা এখনো শুনিনি; কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যরা ২ লাখ মতান্তরে চার লাখ মা-বোনকে ধর্ষণ করেছে, ফাঁস দিতে পারে এই ভয়ে ধৃত মেয়েদের বাঙ্কারের ভেতর উলঙ্গ করে রেখেছিল। বিজয় লাভের দুই দিন পূর্বে পাকিস্তানি সৈন্যদের সহযোগী রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসরা ঘরে ঘরে তল্লাশি করে দেশের বুদ্ধিজীবীদের ধরেছে, চোখ আর হাত বেঁধে তাদের অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্যাতন করেছে। বাংলাদেশে গুম আর অপহরণ তখন থেকেই শুরু হয়েছে। বিজয় লাভের পর ঢাকার রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে দেখা গেল এক করুণ দৃশ্য, বুদ্ধিজীবীদের পচাগলা লাশ নিয়ে টানাটানি করেছে শেয়াল আর কুকুর। ইসরায়েলের বর্বরতার জন্য ইহুদিদের পণ্য বর্জন হলে, একাত্তরে পাকিস্তানিদের নৃশংসতার জন্য তাদের পণ্যের বর্জন হবে না কেন? ইসরায়েলের পণ্যের ন্যায় পাকিস্তানের পণ্যও হারাম হওয়া উচিত। আমেরিকা অসন্তুষ্ট হতে পারে বিধায় তারেক রহমানের পরামর্শে বিএনপি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একটি বিবৃতিও দেয়নি।

ইসরায়েলকে বয়কট করার নামে দেশে একটি অস্থিরতার পরিবেশ সৃষ্টি করাই কিছু লোকের উৎসবে পরিণত হয়েছে। এই উৎসবে ইহুদি পণ্য ‘ফেসবুক’ ব্যবহার করে ইহুদি পণ্যের নামে বাংলাদেশের সম্পদ বাটা, কেএফসি, কোকা-কোলা ধ্বংস করার ডাক দেয়া হয়। তারা কম জ্ঞানী এই কথা কিন্তু বলা যাবে না, কারণ এখন মেধার যুগ; কিন্তু বয়কট করার পণ্য নির্ধারণে মেধার ঘাটতি আমাদের হতাশ করে। বাটা, কেএফসি বা কোকা-কোলা কোনোটাই ইসরায়েলের পণ্য নয়। অন্যদিকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাটা শু কোম্পানির প্রোডাকশন ম্যানেজার উইলিয়াম এ এস ওডারল্যান্ড, বীরপ্রতীক শুধু নিজে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেননি, তার জুতা প্রস্তুতের কারখানা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।

ইসরায়েলকে মদদ দিচ্ছে আমেরিকা, আমেরিকাকে বয়কট করার ক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে তুষ্ট রাখার জন্য রিপাবলিকান প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ইলন মাস্কের স্টারলিঙ্ক ইন্টারনেট সেবা ত্বরিতগতিতে আনা হয়েছে। আমেরিকাকে তুষ্ট রাখার জন্য প্রয়োজনে আরও আনা হবে। যখন ভাঙচুর ও লুটপাট চলছিল তখন ৫০টি দেশের বিভিন্ন বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের পাঁচ শতাধিক প্রতিনিধি ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে অবস্থান করছিলেন। বাংলাদেশে বিনিয়োগে বিরাজমান স্থবিরতা কাটানোর এমন একটি ব্যয়বহুল উদ্যোগে বিদেশি ব্র্যান্ডের ওপর হামলা দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। দেশ এবং জাতির মঙ্গলে এদের থামানো উচিত, নতুবা দেশের ভাবমূর্তি নোবেল বিজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনূসের পক্ষেও রক্ষা করা সম্ভব হবে না।

জিয়াউদ্দীন আহমেদ: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ