Views Bangladesh Logo

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির অপপ্রয়াস ও সত্যের অমোঘ বাস্তবতা

৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গভীর রাতে ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের এক সেনা মেজর ওয়্যারলেসে বার্তা পাঠিয়েছিলেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে: ‘বিগ বার্ড ইন কেজ, স্মল বার্ডস হ্যাভ ফ্লোন।’ এই সংক্ষিপ্ত বার্তাটির অর্থ ছিল স্পষ্ট— বড় পাখিটিকে (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) খাঁচায় বন্দি করা হয়েছে, আর ছোট পাখিগুলো (অন্যান্য নেতা ও আওয়ামী লীগের কর্মীরা) উড়ে গেছে। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ নিশ্চিন্ত হয়েছিল, ভেবেছিল যে বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতারই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সমাপ্তি টানবে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, শুধু একজন নেতাকে বন্দি করলেই আন্দোলন থেমে যায় না। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং বিশ্বের অন্যান্য ঐতিহাসিক আন্দোলন প্রমাণ করে যে, নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতে জনগণের সংগ্রাম আরও প্রবল হয়ে ওঠে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকায় 'অপারেশন সার্চলাইট' শুরু করে। এই সুপরিকল্পিত সামরিক অভিযানের লক্ষ্য ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে চিরতরে দমন করা। নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতন এবং গ্রেফতার চলতে থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে করাচির জেলে পাঠানো হয়। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ ভেবেছিল, স্বাধীনতার মূল প্রতীককে সরিয়ে ফেললেই মুক্তিযুদ্ধের আগুন নিভে যাবে। কিন্তু তাদের এই ধারণা ছিল সম্পূর্ণ ভুল। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে বাঙালি জনগণ তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যায়। পুরো নয় মাস ধরে দেশের আপামর জনসাধারণ, ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযোদ্ধারা একসঙ্গে মিলে লড়াই চালিয়ে গেলেন। তাদের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মাধ্যমেই জন্ম নিল স্বাধীন বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মতো বিশ্বের অন্যান্য ঐতিহাসিক আন্দোলনেও দেখা গেছে, নেতাকে সরিয়ে দিলেও জনগণের লড়াই থামে না— বরং আরও প্রবল হয়ে ওঠে। ১৯৪২ সালের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের সময় মহাত্মা গান্ধীসহ কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা গ্রেপ্তার হন। প্রথমে সাধারণ মানুষ কিছুটা হতবাক হলেও, অচিরেই তারা সংগঠিত হয়ে আন্দোলন চালিয়ে যান, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে তোলেন। একইভাবে, ১৯৬০-এর দশকের আমেরিকার ‘সিভিল রাইটস মুভমেন্ট’-এ মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রকে বার্মিংহামের কারাগারে আটকে রাখা হয়েছিল। কিন্তু কারাগার থেকেই তিনি লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত ‘লেটার ফ্রম বার্মিংহাম জেল’, যা সাধারণ মানুষকে আরও অনুপ্রাণিত করেছিল।

দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে নেলসন ম্যান্ডেলাকে ২৭ বছর কারাবন্দি রাখা হয়েছিল। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে তাঁর অনুপস্থিতিতে জনগণই আন্দোলন চালিয়ে যায়, যা অবশেষে বর্ণবাদী শাসনের অবসান ঘটায়। এসব উদাহরণ প্রমাণ করে যে, সত্যিকারের নেতা মানেই কেবল একজন ব্যক্তি নন— তিনি একটি আদর্শের প্রতীক। এবং যখন জনগণ সেই আদর্শে বিশ্বাস করে, তখন নেতার শারীরিক অনুপস্থিতি আন্দোলনকে দমিয়ে রাখতে পারে না। তাহলে কি নেতৃত্বহীনভাবেই আন্দোলন সফল হয়? ইতিহাস বলবে, বিষয়টি অতটা সহজ নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জনতার বিপুল অংশগ্রহণ থাকলেও, যদি শক্তিশালী নেতৃত্ব না থাকে, তাহলে অনেক আন্দোলন ব্যর্থও হয়েছে। নেতা কেবল নির্দেশ দেন না, তিনি জনগণের জন্য অনুপ্রেরণার বাতিঘর হয়ে ওঠেন। তিনি তাঁদের স্বপ্ন দেখান, লড়াইয়ের পথ দেখান, ঐক্যবদ্ধ রাখেন। সঠিক নেতৃত্বের অভাবে অনেক আন্দোলন দিকভ্রান্ত হয়েছে, বিভক্ত হয়েছে, অথবা শক্তিশালী প্রতিপক্ষের কাছে পরাজিত হয়েছে। তবে যখন নেতৃত্বের অনুপ্রেরণা ও জনতার দৃঢ়সংকল্প একসঙ্গে কাজ করে, তখন ইতিহাস সৃষ্টি হয়।

আবার নেতার প্রভাব নেতিবাচক দিকেও যেতে পারে। হিটলারের সময় জার্মানিতে জনগণও এক অভূতপূর্ব জাতীয়তাবাদী উন্মাদনায় গা ভাসিয়েছিল, কিন্তু তার পরিণতি হয়েছিল ভয়াবহ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল, এবং ইতিহাসে এক অন্ধকার অধ্যায় রচিত হয়েছিল। তাই নেতার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি নয়, আসল বিষয় হলো নেতৃত্বের গুণাবলি এবং তা কিভাবে জনগণের মধ্যে প্রভাব ফেলে। ‘বিগ বার্ড ইন কেজ, স্মল বার্ডস হ্যাভ ফ্লোন’— পাকিস্তানিরা মনে করেছিল, তারা বড় পাখিটিকে বন্দি করে ফেলেছে, কিন্তু তারা বোঝেনি যে ছোট পাখিরা স্বাধীনতার বার্তা নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর, সেই ছোট পাখিগুলোই স্বাধীনতা এনেছিল। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা— নেতা বন্দি হতে পারেন, কিন্তু আদর্শ ও জনগণের সংগ্রাম কখনো থামে না।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরের বেশি সময় পার হলেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার অপচেষ্টা আজও থেমে নেই। নানা কৌশলে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসকে বিতর্কিত করার প্রয়াস নেওয়া হচ্ছে। যে নেতারা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যাদের দিকনির্দেশনায় মুক্তিসংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল, তাঁদের অবদানকে খাটো করার চেষ্টা চলছে। এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন পরিচয় নিরূপণের মাধ্যমে ইতিহাসের প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের চেষ্টা করা হচ্ছে; কিন্তু প্রশ্ন হলো—ইতিহাস কি ইচ্ছেমতো বদলানো সম্ভব?

ইতিহাস কেবল কিছু তথ্য বা ঘটনাপ্রবাহের সমষ্টি নয়; এটি একটি জাতির অস্তিত্বের দলিল, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের প্রতিচ্ছবি। কোনো রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক প্রয়োজনে ইতিহাসের নির্যাস বদলানোর প্রচেষ্টা হয়তো কিছু সময়ের জন্য কার্যকর হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা টিকে থাকতে পারে না। কারণ প্রকৃত সত্য কখনোই চিরতরে গোপন রাখা সম্ভব নয়। ইতিহাস তার নিজস্ব গতিতে সামনে আসে, কারণ এটি শুধু কাগজে লেখা কোনো তথ্য নয়—এটি লক্ষ লক্ষ মানুষের স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বাস্তবতা।

মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ করার বা তাঁদের পরিচয় পুনর্নির্ধারণের যে কোনো প্রচেষ্টা আত্মপরিচয়ের ওপর আঘাতের শামিল। মুক্তিযোদ্ধারা এই দেশকে স্বাধীন করেছেন তাঁদের রক্ত, জীবন ও ত্যাগের বিনিময়ে। কোনো প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত বা রাজনৈতিক স্বার্থ তাদের ভূমিকার গুরুত্ব কমিয়ে দিতে পারে না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—একটি জাতির স্বকীয়তা ও আত্মপরিচয় টিকে থাকে তার অতীতের শক্ত ভিতের ওপর। যদি সেই ভিত্তি দুর্বল করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বিভ্রান্ত হবে এবং স্বাধীনতার মূল চেতনা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে।

মনে রাখতে হবে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ কেবল একটি সামরিক যুদ্ধ ছিল না; এটি ছিল একটি জাতির স্বপ্ন, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মহাকাব্য। এই যুদ্ধ কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না; এটি ছিল বাঙালির শত বছরের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে জাগরণের চূড়ান্ত রূপ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব, তাজউদ্দীন আহমদের বিচক্ষণ কৌশল এবং লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধার আত্মনিবেদনই এ যুদ্ধকে বিজয়ের পথে নিয়ে গিয়েছিল। এসব সত্যকে অস্বীকার করার মানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নস্যাৎ করা, জাতির ইতিহাসকে বিকৃত করা।

ইতিহাসের সত্যকে কেউ মুছে ফেলতে পারে না, কারণ এটি কেবল কাগজে লেখা ঘটনা নয়—এটি মানুষের হৃদয়ে গেঁথে থাকে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ইতিহাসের সত্যতা প্রবাহিত হয়, আর তাই ইতিহাস বিকৃতির যে কোনো প্রয়াস একসময় ব্যর্থ হতে বাধ্য। সত্য চিরস্থায়ী, মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে কোনো কৃত্রিম ইতিহাস দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে না। আমাদের দায়িত্ব হলো ইতিহাসের প্রকৃত রূপ সংরক্ষণ করা, যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বিভ্রান্ত না হয় এবং আমাদের স্বাধীনতার ভিত্তি কখনো দুর্বল না হয়।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়; এটি একটি সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা, যা একদিকে স্বাধীনতার চেতনাকে দুর্বল করতে পারে, অন্যদিকে জাতিকে বিভক্ত করতে পারে। মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখা যেমন জরুরি, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী জাতীয় নেতাদের ভূমিকা খর্ব করার চেষ্টা ইতিহাসের প্রতি অবিচার। স্বাধীনতার মূল চেতনা রক্ষা করতে হলে সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো এবং ইতিহাসকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে সংরক্ষণ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। ইতিহাস নিয়ে ছিনিমিনি খেলা ক্ষণিকের জন্য রাজনৈতিক সুবিধা এনে দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি একটি জাতির ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়। অতএব, ইতিহাসকে বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করা শুধু মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো নয়, বরং এটি একটি স্বাধীন জাতির অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইও বটে।

চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ