মোবাইল ইন্টারনেটের দাম বাড়ানোর অপচেষ্টা, কোনোভাবেই অপারেটরদের কাছে কাম্য নয়
অবশ্যই মোবাইল নেটওয়ার্ক তৈরি, পরিচালনা এবং সেবাদানের ক্ষেত্রে বড় একটা বিনিয়োগ এবং ব্যয় আছে। কিন্তু সেই ব্যয়ের বিপরীতে কোন মানদণ্ডে সেবার বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ করা হচ্ছে, সেটা সাধারণ গ্রাহকের কাছে অজানা এবং অস্পষ্ট। সেটা ভয়েস কল এবং মোবাইল ইন্টারনেট, দুই ক্ষেত্রেই। ভয়েস কলের ক্ষেত্রে একটা মানদণ্ডের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করা হলেও মোবাইল ইন্টারনেট প্যাকেজের ক্ষেত্রে অপারেটরদের সর্বোচ্চ লাভের অঙ্ক ছাড়া আর কোনো মানদণ্ড আছে কি না, সেটা এখনও অজানা। মোবাইল ইন্টারনেটের ক্ষেত্রে ‘কস্ট মডেলিং’-এর জন্য টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি একাধিকবার উদ্যোগ নিলেও শেষ পর্যন্ত সেটা সফল হয়নি। কেন এই উদ্যোগ সফল হলো না, সে বিষয়টিও পরিষ্কার নয়।
এই ‘কস্ট মডেলিং’ না হওয়ার কারণেই মোবাইল ইন্টারনেট প্যাকেজ নির্ধারণের ক্ষেত্রে এক ধরনের অরাজকতার সুযোগ নিয়েছে মোবাইল অপারেটররা। বিশেষ করে স্বল্প মেয়াদের ছোট ছোট প্যাকেজ এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে যে, গ্রাহকদের কাঙ্ক্ষিত সেবা নিশ্চিত হোক বা না হোক, অপারেটরদের আয় নিশ্চিত থাকবে।
কয়েক দিন আগে বিটিআরসি মোবাইল ইন্টারনেটের ক্ষেত্রে ৩ এবং ১৫ দিনের মেয়াদের প্যাকেজ তুলে দেওয়ার সময় একাধিক মোবাইল অপারেটরদের কর্মকর্তারা দাবি করেন, তাদের মোট ইন্টারনেট গ্রাহকের প্রায় ৭০ শতাংশই তিন দিনের প্যাকেজ ব্যবহার করছেন। এখানে একটা কথা বলে রাখি, বিটিআরসি প্রতি মাসেই দেশে মোবাইল অপারেটরদের কার কত গ্রাহক সে সংখ্যাটা প্রকাশ করে। একইভাবে দেশে মোবাইল এবং ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের কত গ্রাহক সেটাও প্রকাশ করে। কিন্তু সেখানে মোবাইল অপারেটরদের ইন্টারনেট বা ডেটা প্যাকেজ গ্রাহকের পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয় না। মোবাইল অপারেটররা তিন মাস প্রান্তিকে আয়-ব্যয়ের যে হিসেব দেন সেখানেও ডেটা গ্রাহকদের সংখ্যা এখন পর্যন্ত এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। এড়িয়ে যাওয়ার কারণটাই হচ্ছে, ডেটা প্যাকেজের মূল্য নির্ধারণে অরাজকতার হিসেব থেকে কম সময়ে বেশি মুনাফার বিষয়টি আড়াল করা।
যাই হোক, আসুন বিটিআরসি’র প্রকাশিত পরিসংখ্যান থেকেই একটা হিসেব করে দেখি, তিন দিনের প্যাকেজের ব্যবসা বন্ধ হওয়ায় মোবাইল অপারেটরদের এত হাহাকার কেন? বিটিআরসির সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত দেশে মোট মোবাইল ইন্টারনেটের গ্রাহকের সংখ্যা ছিল ১১ কোটি ৯৭ লাখ ৭০ হাজার। যেহেতু কোন অপারেটরের কত ডেটা প্যাকেজ গ্রাহক রয়েছে তার হিসেব নেই, সে কারণে আমরা মোট মোবাইল ইন্টারনেট গ্রাহকের এই হিসেবটাকে এখানে সাধারণ মানদণ্ড হিসেবে উপস্থাপন করছি।
ধরুন, মোবাইল ইন্টারনেটের ক্ষেত্রে তিন দিনের মেয়াদে যদি এক জিবি প্যাকেজের দাম ২০ টাকা হয়, মোবাইল অপারেটর কর্মকর্তাদের দাবি অনুযায়ী ৭০ শতাংশ ডেটা প্যাকেজ গ্রাহক তিন দিনের প্যাকেজের গ্রাহক হলে ১১ কোটি ৯৭ লাখ ৭০ হাজার গ্রাহকের মধ্যে আট কোটি ৩৮ লাখ ৩৯ হাজার গ্রাহকই তিন দিনের প্যাকেজে আছেন। হিসেবটা সহজে বোঝার জন্য আমরা আরও কম গ্রাহক সংখ্যা ধরি। ধরুন, তিন দিনের মেয়াদে ২০ টাকায় এক জিবি প্যাকেজের গ্রাহক সংখ্যা পাঁচ কোটি। তাহলে প্রতিদিন দিনে পাঁচ কোটি গ্রাহক মোবাইল ইন্টারনেটের জন্য ১০০ কোটি টাকা ব্যয় করছেন বা মোবাইল অপারেটরকে দিচ্ছেন। এই হিসেবে মাসে ১০ বার ১০০ কোটি টাকা আয়ের হিসেব করলে মোবাইল অপারেটরদের মাসে এক হাজার কোটি টাকার নিশ্চিত আয় তিন দিনের প্যাকেজ থেকেই আসছে। আর তিন দিনের প্যাকেজ ১০ বার কেনার জন্য গ্রাহকরা ১০ জিবি প্যাকেজ বাবদ ২০০ টাকা ব্যয় করেছেন। এখন তিন দিনের মেয়াদের পরিবর্তে ৩০ দিনের মেয়াদে ১০ জিবি ডাটার জন্য ২০০ টাকার প্যাকেজ দেওয়া হলেও সরল অঙ্কে মোবাইল অপারেটরদের আয় কিন্তু এক হাজার কোটি টাকাই হতো। কিন্তু অঙ্ক সহজ নয়, জটিলতা আছে।
তিন দিনের প্যাকেজের ক্ষেত্রে মোবাইল অপারেটররা তিন দিনের মধ্যেই অন্তত ১০০ কোটি টাকা তাদের অ্যাকাউন্টে নিশ্চিত করতে পারছেন। তিন দিনে গ্রাহক এক জিবি ডেটা ব্যবহার করুক কিংবা না করুক, গ্রাহকের কোনো দাবি থাকে না। তিন দিনের প্যাকেজে দৃশ্যত মূল্য কম দেখানোর কারণে বেশিরভাগ গ্রাহক মোটামুটি চিন্তা-ভাবনা না করেই প্যাকেজটা নিয়ে নেন।
কিন্তু মাসের হিসেবে ২০০ টাকার প্যাকেজ মূল্য হলে সেটা নেওয়ার ক্ষেত্রেও অনেক গ্রাহকই হিসেব করবেন। কারণ সংসারে মাসের হিসেবটাই সবচেয়ে জটিল। যেমন আপনি পরিবার নিয়ে ভালোমানের কোনো রেষ্টুরেন্টে একবেলা খেতে একসঙ্গে ১০ হাজার টাকার বিল দিতে খুব বেশি ভাবেন না। কিন্তু মাসের বাজার করতে গিয়ে কাঁচাবাজারে একসঙ্গে পাঁচ হাজার টাকা খরচ করতেও অনেক বেশি কাতর হয়ে পড়েন!
এই মনস্তত্ত্বটাকে খুব ভালোভাবে পড়েছে মোবাইল অপারেটররা। যে কেউ প্রয়োজন মনে করলেই কম টাকার কারণে তিন দিনের প্যাকেজ চট করে কিনে ফেলতে পারেন। কিন্তু মাসিক প্যাকেজের ক্ষেত্রে গড়ে গ্রাহকরা হুট করে কিনবেন না। এক মুহূর্ত চিন্তা-ভাবনা করে হলেও হয়তো বেশি ডেটা কিংবা আরও কম ডেটার প্যাকেজ নেবেন। এ কারণে মোবাইল অপারেটরদেরও তিন দিনে ১০০ কোটি টাকার নিশ্চিত ব্যবসার পরিবর্তে মাসে এক হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয় নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তার ভেতরেই থাকতে হবে। অতএব বুঝতেই পারছেন, তিন দিনের প্যাকেজ বন্ধ হওয়াতে কেন এত আর্তনাদ মোবাইল অপারেটরদের! আর একটা সুবিধা আছে তিন দিনের প্যাকেজের। ২০ টাকার প্যাকেজের অব্যবহৃত ডেটা ফেরত দেওয়া নিয়ে গ্রাহকের কোনো অভিযোগ থাকে না। কিন্তু মাসে ২০০ টাকার প্যাকেজের অব্যবহৃত ডেটা ফেরত দেওয়া নিয়ে গ্রাহক অবশ্যই সচেতন থাকেন। সেটা বাড়তি আরেকটা চাপ অপারেটরদের জন্য।
যদিও “কোনো গ্রাহকের ইন্টারনেটের মেয়াদ শেষ হলেই স্পেশাল অফারের” কিছু প্যাকেজ সামনে চলে আসে এবং যেগুলোর প্রতিটির শর্ত হচ্ছে অব্যবহৃত ডেটা যোগ হবে না। কোনো কিছুতে ‘স্পেশাল অফার’ লেখা থাকলেই মনটা কেমন যেন আনচান করে। কী শর্ত আছে সেদিকে তাকাতে ইচ্ছা করে না, বিনা বাক্যব্যয়ে কিনে ফেলি। আবার নিয়মিত প্যাকেজে অব্যবহৃত ডেটা যোগ করা নিয়েও তো ‘আনুবীক্ষণিক’ হরফে পৃথক শর্ত লেখা থাকে। অতএব আপনি শর্তের বেড়াজালের কথা ভুলে গিয়ে ‘স্পেশাল অফার’কেই গুরুত্ব দিচ্ছেন।
তিন দিনের এবং ১৫ দিনের প্যাকেজ তুলে দিয়ে, ৯৫ থেকে প্যাকেজের সংখ্যা ৪০টিতে নামিয়ে এনে বিটিআরসি যথার্থ অর্থেই গ্রাহকবান্ধব সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন গ্রাহক ধরে রাখতে চাইলে এক মাস মেয়াদের জন্যই যৌক্তিক প্যাকেজ দিতে হবে অপারেটরদের। যারা কম মেয়াদের চান, তারা সাত দিন মেয়াদের প্যাকেজ নিতে পারেন।
দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, তিন দিনের প্যাকেজের হরিলুটের ব্যবসা বন্ধ হওয়ার কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি টেলিটক ছাড়া অন্য তিন অপারেটর কৃত্রিমভাবে মোবাইল ইন্টারনেটের দাম বাড়ানোর মতো অনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা দিনের প্যাকেজের ডেটার পরিমাণ সাত দিনের মেয়াদে নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে দিনের হিসেব সমন্বয় করে দাম বাড়িয়েছেন। এটা করা হয়েছে শুধুমাত্র সাধারণ গ্রাহকদের ক্ষেপিয়ে তোলার জন্য, যেন গ্রাহকদের চাপে বিটিআরসি তিন দিনের প্যাকেজ আবারও চালু করতে বাধ্য হয়। বাস্তবে সাধারণ গ্রাহকরা বিটিআরসির এই পদক্ষেপে খুশি হয়েছেন আর ক্ষোভ বেড়েছে উল্টো মোবাইল অপারেটরদের ওপরই। কারণ, তিন দিনের প্যাকেজের অধিকাংশ গ্রাহকই তরুণ। অপারেটরদের দুর্দান্ত ঝানু কর্মকর্তারা এ প্রজন্মের এখন পর্যন্ত অর্জিত ‘স্মার্টনেস’-এর উচ্চতাকে কেন বুঝতে ভুল করলেন, সেটাই আমাকে বিস্মিত করছে।
আমরা জানি এবং স্বীকার করতেই হবে, ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় মোবাইল অপারেটরদের অবদান অসামান্য। সরকার নানাভাবে ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে। সেই ক্ষেত্রকে ব্যবহার করে দেশজুড়ে ডিজিটাল নেটওয়ার্ক মোবাইল অপারেটররাই তৈরি করেছে। কিছু ক্ষেত্রে জটিলতার মুখোমুখিও হতে হয়েছে। যেমন- উচ্চমূল্যের বেতার তরঙ্গ, অনিশ্চয়তার কর ব্যবস্থাপনা- এসব কিছুর মধ্যেও বিদেশি বিনিয়োগে পরিচালিত তিনটি মোবাইল অপারেটর দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠায় পিছপা হয়নি। আর এই মোবাইল নেটওয়ার্কের ওপর দাঁড়িয়েই দেশে মুঠোফোনে আর্থিক লেনদেন সুবিধার মতো যুগান্তকারী ডিজিটাল সেবা তৃণমূলে পৌঁছে গেছে। সরকারি নানা ধরনের সেবা মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। মোবাইল অপারেটরদের পৃষ্ঠপোষকতায় তথ্য-প্রযুক্তিতেও দক্ষ জনবল তৈরি হয়েছে, হচ্ছে। সেজন্য মোবাইল অপারেটেরদের প্রশংসা করতেই হবে। এর আগেও সরকারি অনেক সিদ্ধান্ত মোবাইল অপারেটরদের ব্যবসার জন্য প্রতিকূল হয়েছে। সে সময়ও তারা সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য যুক্তি তুলে ধরেছে। বিশেষজ্ঞ, বিশ্লেষকরাও তাদের সেই যুক্তির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধানও হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, এবার তিন দিনের প্যাকেজ ফিরিয়ে আনার জন্য অযৌক্তিকভাবে সাত দিনের প্যাকেজের দাম বাড়িয়ে গ্রাহক খেপিয়ে তোলার অপচেষ্টা চালিয়েছে তিনটি মোবাইল অপারেটর, যা মোটেও কাম্য হতে পারে না।
একটা কথা মনে রাখতে হবে, মোবাইল ইন্টারনেটের জন্য যৌক্তিক ‘কস্ট মডেলিং’ করতে হবে। এ দায়িত্ব নিয়ন্ত্রক সংস্থার। কোনো মেয়াদ বেঁধে না দিয়ে এক জিবি ডেটা কিংবা আনলিমিটেড ডেটার জন্য এক দিনের হিসেবে মূল্যহার নির্ধারণ করা হলে মোবাইল অপারেটরদের এ ধরনের অপচেষ্টার আর কোনো সুযোগ থাকবে না। আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের দামে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলে মোবাইল ইন্টারনেটের প্যাকেজের ক্ষেত্রে কেন নয়?
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে