ইট পড়ে মৃত্যু
দুর্ঘটনার দায় কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে
কার যে কোথায় কখন কী দুর্ঘটনায় মৃত্যু হবে, কেউ জানেন না। গত সোমবার (২৭ মে) ভোরে বাবার বুকজুড়ে ঘুমাচ্ছিল ছোট মেয়েটি, সুরাইয়া তার নাম, যার অর্থ সুন্দর, হঠাৎ গজবের মতো টিনের চাল ভেদ করে মাথার ওপর পড়ল এক স্তূপ ইট, পাশের নির্মাণাধীন বহুতল ভবন থেকে ইটের স্তূপ ধসে পড়েছে, মাথায় প্রচণ্ড আঘাত লেগে মেয়েটি দুদিন অজ্ঞান, গত বুধবার (২৯ মে) ১১টার দিকে তার প্রাণ চলে গেল। এ খবর এখন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে, মানুষ জেনে হাহাকার করছেন ছোট মেয়েটির জন্য; কিন্তু কার কী করার আছে!
এরকম খবর তো প্রায়ই আসে পত্রিকায়। গত ১১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় অফিস শেষে বাসায় ফিরছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা দিপু সানা। রাজধানীর মগবাজারে ফুটপাত ধরে হেঁটে যাওয়ার সময় আকস্মিক তার মাথার ওপর একটি ইট পড়ে এবং তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান। মৃত্যুর এক মুহূর্ত আগেও কী দিপু সানা ভেবেছিলেন, এভাবে ইটের আঘাতে তার মৃত্যু হবে? মাথায় ইট পড়ে দিপু সানার মৃত্যুর ঘটনার আগেও ২০২২ সালের ২৮ অক্টোবর মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যানের ৪ নম্বর সড়কে নির্মাণাধীন একটি বহুতল ভবন থেকেও ইট পড়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী রবিউল ইসলাম জিহাদ নিহত হয়। তা ছাড়া রাজধানীর উত্তরায় বিআরটি প্রকল্পে যথাযথ সুরক্ষা ও নিরাপত্তা না থাকায় ২০২২ সালের ১৫ আগস্ট গার্ডার পড়ে পাঁচ যাত্রী নিহত হওয়ার মর্মান্তিক ঘটনাটি দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় তুলেছিল। এমন অপঘাতে মৃত্যুর ঘটনার অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে।
ভিউজ বাংলাদেশে প্রকাশিত গত ১৭ জানুয়ারির সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল, এভাবে অপঘাতে মৃত্যুর সারি কি বাড়তেই থাকবে! বাংলাদেশে নির্মাণকাজে নিরাপত্তার বিষয়ে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না, এমন অভিযোগ বহু পুরোনো। তাই নির্মাণাধীন ভবন থেকে সরঞ্জাম পড়ে প্রাণহানি বাড়লেও দেখার কেউ নেই। যাদের দেখভাল করার কথা, তারা নির্বিকার। আবার কিছু ঘটনায় মামলা হলেও শেষ পর্যন্ত বিচার পান না নিহতের স্বজনরা। অথচ আইন ও ভবন নির্মাণ বিধিমালায় পথচারীসহ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
ওই সম্পাদকীয়র কথাগুলো যে সত্য ছিল, তার প্রমাণ আরেকটি ছোট মেয়ের মর্মান্তিক প্রাণহানি। রাজউকের আওতার বাইরে দক্ষিণখানে ১৪তলা ভবন নির্মাণ হচ্ছিল, পাশেই যে একটি টিনের বাড়ি সে খেয়ালও ছিল না ভবন মালিকদের, নেয়া হয়নি প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা, মানা হয়নি কোনো আইন, তা না হলে ৬তলার বেশি অনুমতি না থাকা সত্ত্বেও সেখানে ১৪তলা বিল্ডিং কীভাবে তৈরি করে? ভবন মালিকদের ভুলে যে প্রাণপ্রিয় সন্তানের প্রাণ গেল, তার ক্ষতিপূরণ কে দিবে? কী সে তার ক্ষতিপূরণ হবে?
বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডে বলা আছে, নির্মাণকাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নাইলনের জাল দিয়ে পুরো ভবন ঢেকে দিতে হবে। সড়কে কমপক্ষে ১ দশমিক ৫ মিটার দূরত্বে নির্মাণাধীন ভবনকে অবশ্যই ২ দশমিক ৪ মিটার বেষ্টনী দিয়ে রাখতে হবে। ভবনের চারদিকে টিন দিয়ে অস্থায়ী ছাদ বানানোর কথাও বলা আছে; কিন্তু বেশির ভাগ ভবন মালিক ও নির্মাণকারী সংস্থা সেগুলো মানেন না। অনেক সময় অর্থ বাঁচাতে অদক্ষ শ্রমিক ব্যবহার ও অবহেলায় দুর্ঘটনা ঘটছে। এগুলো দেখভালের জন্য সরকারের যে দপ্তর বা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তারাও উদাসীন।
আমরা দেখেছি, এ ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে এবং দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। গঠন করা হয় বড় বড় তদন্ত কমিটি। দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়; কিন্তু মামলায় গতি আসে না এবং দায়ীদের যথাযথ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না। কেউ কোনো দায়দায়িত্ব স্বীকার করে না, যা দেশের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের। এসব দুর্ঘটনাকে স্রেফ দুর্ঘটনা বলে চালালে হবে না, এগুলো একধরনের হত্যাকাণ্ড। তাই অভিযুক্তকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে