Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

মশার কামড় এড়িয়ে চলাই ডেঙ্গু প্রতিরোধের মোক্ষম উপায়

ABM  Abdullah

এ বি এম আব্দুল্লাহ

শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪

লতি বছর সারা দেশে বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগের পরিস্থিতি ভয়াবহতার আভাস দিচ্ছে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ছুটে যাচ্ছেন। জলবায়ু পরিবর্তনে রাজধানীসহ সারা দেশে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বৃষ্টির ধরন পালটে যাওয়া এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণসহ নানা কারণে ডেঙ্গুর ঝুঁকি বাড়ছে।

বৃষ্টির জন্য ডেঙ্গু মৌসুম দীর্ঘায়িত হচ্ছে। সাধারণভাবে মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত থাকে ডেঙ্গু মৌসুম। তবে ডেঙ্গু আর মৌসুমি রোগ নয়, বছরব্যাপী কমবেশি ডেঙ্গুর আক্রান্তের হার বেড়েই চলছে; কিন্তু এবারের আবহাওয়া অন্যরকম। বৃষ্টি থামছে না। তাই এ বছর ডেঙ্গুর সংক্রমণ হয়তো আরও বাড়তেই থাকবে আগামী শীত আসার আগ পর্যন্ত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, এ বছর এ পর্যন্ত ৩৯ হাজারের ওপর মানুষের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। আর প্রায় ২০০ জন ডেঙ্গুর কারণে মারা গেছেন। সামনে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

এবার বর্ষা মৌসুমের আগেই থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে যত্রতত্র পানি জমছে। ভবন নির্মাণ এলাকায় দিনের পর দিন পানি জমে থাকছে। মানবসৃষ্ট কারণে মারাত্মকভাবে পরিবেশ বিপর্যয় হচ্ছে। ফলে এডিসের লার্ভার বংশ বিস্তারের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। সারা দেশে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা ছড়িয়ে পড়ছে। মশা বাড়লে মানুষকে কামড়াবে এটাই স্বাভাবিক; কিন্তু এবার ডেঙ্গুর চারটি ধরনের মধ্যে ডেন-২ বেশি দেখা যাচ্ছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত অধিকাংশ ব্যক্তির শক সিনড্রম দেখা দিচ্ছে। শকে চলে যাওয়া রোগীর রক্তচাপ অতিদ্রুত কমে যায়, রক্তের অণুচক্রিকা কমে যায়, শারীরিক অবস্থা দ্রুত খারাপ হয়। অনেক রোগী মারাও যায়।

জ্বর হলেই কি ডেঙ্গু? শুরুতে অনেকে জ্বরকে তেমন গুরুত্ব দেয় না। এটা ঠিক যে, এই সময় ডেঙ্গু ছাড়াও ফ্লু, নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, প্যারাটাইফয়েড ও অন্যান্য সংক্রমণও অনেক হচ্ছে। হাসপাতালে বা চিকিৎসকের কাছে আসা সব রোগীরই যে ডেঙ্গু, তা নয়; কিন্তু মনে রাখতে হবে, বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব চলছে এবং এখনো শনাক্তের হার নিচে নামেনি। তাই এ সময় জ্বর হলে ডেঙ্গুর আশঙ্কার কথা বাদ দেওয়া যাবে না। যদিও নানা রকম উপসর্গ দেখে চিকিৎসকরা জ্বরের কারণ কিছুটা আন্দাজ করতে পারেন; কিন্তু যতক্ষণ না পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে যে, এটি ডেঙ্গু নয়, ততক্ষণ কিন্তু ডেঙ্গুর আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

তাহলে কি পরীক্ষা করাতে হবে? আমাদের মতো ডেঙ্গুপ্রবণ দেশে ডেঙ্গুর মৌসুমে জ্বর হলেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করানো উচিত। সাম্প্রতিককালে ডেঙ্গু ভাইরাস প্রতিবছরই ধরন পাল্টাচ্ছে। ডেঙ্গুর যে ক্ল্যাসিক্যাল উপসর্গ, তার অনেকগুলোই আজকাল অনুপস্থিত থাকছে। যেমন আগে ডেঙ্গু হলে উচ্চ মাত্রার জ্বর হতো, বর্তমানে বলা হয় জ্বর তীব্র না-ও হতে পারে। তীব্র মাথাব্যথা, চোখব্যথা, পেশিব্যথা আজকাল অনেকেরই দেখা যাচ্ছে না। আবার আগে বলা হতো জ্বরের পাঁচ দিন পরে গিয়ে জটিলতা হয়, এখন দেখা যাচ্ছে অনেকের একেবারে শুরুর দিকেই বা দুই তিন দিন পরেই জটিলতা দেখা যাচ্ছে। তাই আগের মতো চিকিৎসকরা উপসর্গ ও লক্ষণ মিলিয়ে ডেঙ্গু শনাক্ত করতে পারছেন না। অনেক ক্ষেত্রেই রোগী চিকিৎসকের কাছে আসছেন জটিলতা নিয়ে, দেরি করে। তাই এ সময় জ্বর হলেই উচিত ডেঙ্গু পরীক্ষা করে ফেলা। এতে রোগ সম্পর্কে আগেভাগেই জানা যাবে এবং সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নেওয়া যাবে।

কখন কী পরীক্ষা? ডেঙ্গু শনাক্ত করতে হলে জ্বর আসার প্রথম বা দ্বিতীয় দিন ডেঙ্গু এনএসওয়ান পরীক্ষা করে ফেলা ভালো। তবে মনে রাখবেন, এই টেস্ট নেগেটিভ হলেও ডেঙ্গু হতে পারে। সে ক্ষেত্রে এর সঙ্গে একটা কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট বা সিবিসি করে ফেলা ভালো। পরবর্তী সময়ে হিমাটোক্রিট বা প্লাটিলেটের কোনো পরিবর্তন দেখা দিলে এই প্রথম সিবিসির সঙ্গে তুলনা করার দরকার পড়বে। যদি জ্বরের ৪ বা ৫ দিন অতিবাহিত হয়ে যায়, তবে এনএসওয়ান অ্যান্টিজেন আর পরীক্ষা করার দরকার নেই। তখন করতে হবে ডেঙ্গু আইজিজি ও আইজিএম পরীক্ষা। সাম্প্রতিক সংক্রমণে ৯-১০ দিন পর্যন্ত আইজিএম পজিটিভ থাকে, তারপর ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এর বাইরে প্রয়োজন অনুসারে চিকিৎসক আপনাকে আরও কিছু পরীক্ষা করাতে দিতে পারেন। যেমন যকৃতের এসজিপিটি পরীক্ষা বা পেটের আলট্রাসনোগ্রাম বা বুকের এক্স-রে।

ডেঙ্গু ধরা পড়লেই কি হাসপাতালে যেতে হবে? ডেঙ্গু পরীক্ষা পজিটিভ হলে আতঙ্কিত না হয়ে প্রথমে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। বাড়িতে বিশ্রাম নিন, প্রচুর তরল ও পানি পান করুন। নিজেকে পরিবারের অন্যদের থেকে আলাদা করে রাখুন ৪ থেকে ৬ দিন। যাতে তার মাধ্যমে পরিবারের বা অন্যদের ডেঙ্গু ছড়াতে না পারে। তবে কেউ যদি খেতে না পারে বা বমি ও পাতলা পায়খানা অথবা অন্য কোনো রোগ থাকে যেমন হাই ব্লাডপ্রেসার, ডায়াবেটিস, কিডনি, হার্ট, লিভার ও ক্যান্সারের রোগী অথবা গর্ভবতী মহিলা, তাদের হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয়াই ভালো।

প্রতিরোধে করণীয়
ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা প্রজননের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ায় প্রতিদিন সারা দেশে অসংখ্য মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে, হাসপাতালে ছুটছে। অনেকে দ্রুত শক সিনড্রমেও চলে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে হলে সবার আগে মশকনিধনে জোর দিতে হবে। প্রয়োজনের তুলনায় মশা নিধনের উদ্যোগ কম মনে হচ্ছে। ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ রোধে সবার আগে মশা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব দিতে হবে। এ জন্য মশা নিধনে নিয়োজিত দপ্তরগুলোকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে এবং এ কাজে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। উড়ন্ত মশা মারার ব্যবস্থা করতে হবে। জোর দিতে হবে লার্ভা নিধন, অফিস আদালতের আঙিনা ও বাড়িঘরে মশা জন্মে এমন জায়গা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। মশার হটস্পট খুঁজে সেখানে অভিযান চালাতে হবে। কীটতত্ত্ববিদদের পরামর্শ নিয়ে বিশেষ বিশেষ জায়গায় এখনই চিরুনি অভিযান শুরু করতে হবে। বিভাগীয় শহর থেকে শুরু করে সব সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পর্যায়ে মশা নিধনের সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নিয়মিত এডাল্টিসাইডিং, লার্ভিসাইডিং, ফগিংসহ মশা মারার কার্যকর ওষুধ ছিটাতে হবে।

মশা নিধনে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, বেসরকারি সংস্থাসহ পেশাজীবী ও স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে সামাজিক আন্দোলন করে তুলতে হবে। স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান এবং কেউ মশার উৎপত্তিস্থল সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি করলে ওই ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

ব্যক্তিগত সতর্কতা
মশার কামড় এড়িয়ে চলাই ডেঙ্গু প্রতিরোধের মোক্ষম উপায়। মশার কামড় থেকে বাঁচতে হলে সচেতন হতে হবে। প্রয়োজনে ফুলহাতা জামা-প্যান্ট পরিধান করতে হবে। দিনে বা রাতে ঘুমানোর আগে মশারি টানাতে হবে। কারও সাধারণ জ্বর, সর্দি-কাশির মতো সামান্যতম লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হবে। এতে রোগ নির্ণয় ও সঠিক চিকিৎসা নেয়া সহজ হবে। রোগীর ব্যবস্থাপনায় পরিবার থেকে শুরু করে হাসপাতাল সব জায়গায় শতভাগ প্রস্তুতি থাকতে হবে। তবে সবার আগে এডিস মশার আবাসস্থল ধ্বংস করতে হবে। এজন্য মানুষকে সচেতন হতে হবে।

বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই পরিস্থিতি দিন দিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে জরুরি ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে পারে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। তখন প্রকৃত অর্থেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে, আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তেই থাকবে অস্বাভাবিকভাবে।

ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ: মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও ইমেরিটাস অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ