বিএনপি ছাড়া আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো দল নেই
আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে আর বিএনপি প্রত্যাখ্যান করেছে। আমেরিকা নির্বাচনের আগে শর্তহীন আলাপ-আলোচনার সূত্রপাত ঘটাতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টিকে আহ্বান জানিয়ে চিঠি দিয়েছিল। আলাপ-আলোচনার জন্য পর্যাপ্ত সময় না থাকায় আওয়ামী লীগ আমেরিকার প্রস্তাব নাকচ করে প্রত্যুত্তর দিয়ে দিয়েছে।
আওয়ামী লীগ বা সরকারের সঙ্গে বিএনপি কখনো আলাপ-আলোচনা করতে চায়নি। শুধু তাই নয়, বিএনপি নির্বাচন কমিশনের ডাকেও সাড়া দেয়নি। বিএনপি ঠিকই করেছে; কারণ বিএনপি আওয়ামী লীগ সরকার এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে অবৈধ মনে করে, অবৈধ সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করলে বিএনপির নৈতিক পতন হতো। তাদের একটা দাবিই ছিল, অবৈধ সরকারের পদত্যাগ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। বিএনপির কোনো দাবি আপাতত পূরণ হচ্ছে না। ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সংবিধান সংশোধন করে আদালতের আদেশের বাস্তবায়ন করে; অথচ নব্বইয়ের দশকে আওয়ামী লীগ ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান দাবিদার। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে আওয়ামী লীগ খুশি; কারণ ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করার মজা আলাদা। ক্ষমতায় থাকলে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বিএনপিও খুশি হতো।
ক্ষমতায় থাকাকালে ১৯৯৫ সালে হাইকোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ বলে রায় দিলে বিএনপিও খুশি হয়েছিল। খুশি হয়েছিল বলেই বিএনপি ১৯৯১-৯৫ মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন-সংক্রান্ত বিল সংসদে উত্থাপন করেনি। এই অবস্থায় আওয়ামী ও জামায়াত ১৯৯৩ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত দুটি বিল সংসদে উপস্থাপন করে। বিএনপি তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক ও অবাস্তব বলে ঘোষণা করে। খালেদা জিয়া বলতে থাকেন, একমাত্র পাগল ও শিশু ছাড়া আর কোনো মানুষের পক্ষে নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব নয়। অথচ এখন বিএনপি বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবেই না।
বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা না করেই তাদের পাঁচ বছরের শাসনামল শেষ করে এবং বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণ ব্যতিরেকেই ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা হন বঙ্গবন্ধুর খুনি কর্নেল আবদুর রশীদ। অবশ্য ২০১৪ সালেও অনুরূপ একটি নির্বাচন করেছে আওয়ামী লীগ। এই উভয় নির্বাচনেই বহু প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে সাংসদ হন। নির্বাচনের পরও বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন চলতে থাকে, তীব্র আন্দোলনের মুখে বিএনপি ১৯৯৬ সালেই ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে যোগ করতে বাধ্য হয়। যে সরকারব্যবস্থাকে বিএনপি তাদের ১৯৯১-৯৫ মেয়াদে অসাংবিধানিক বলে আখ্যায়িত করেছিল, সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সুপ্রিম কোর্ট ২০১১ সালে অবৈধ ও অসাংবিধানিক বলে রায় প্রদান করে বিএনপির কথার সমর্থন দিয়েছে। বিএনপি আওয়ামী লীগ আমলের বিচার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উত্থাপন করলেও আওয়ামী লীগ আমলের প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অথচ বিচারপতি এসকে সিনহা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন।
সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ৪:৩ ভোটে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করে। বিচারপতি এসকে সিনহা বাতিলের পক্ষে না থাকলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হতো না। এ মামলায় কয়েকজন আইনবিদ আদালতে উল্লেখ করেছিলেন যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার না থাকলে একটি বড় রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না; জবাবে বিচারপতি এসকে সিনহা বলেন, সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে অসামঞ্জস্য কোনো বিধান দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পছন্দ-অপছন্দের হিসেব করে আদালত রায় দিতে পারে না। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো সমর্থন করলেই অসাংবিধানিক কোনো কিছু সাংবিধানিক হয়ে যায় না।
২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপি বিচারকদের অবসর গ্রহণের বয়স বৃদ্ধি করায় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী লেফট্যানেন্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানের ভায়রা ভাই বিচারপতি কে এম হাসানের প্রধান উপদেষ্টা হওয়া নিশ্চিত হয়। তীব্র আন্দোলনের মুখে বিএনপির পছন্দের বিচারপতি কে এম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করলে বিএনপি সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি অপকর্ম করে বসে। বিচারপতি কে এম হাসানের অপরাগতায় সংবিধান অনুযায়ী তার আগের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে দায়িত্ব নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানোর কথা এবং এভাবে চারটি বিকল্পে কেউ দায়িত্ব না নিলে সর্বশেষ ধাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার কথা রাষ্ট্রপতির; কিন্তু বিচারপতি কে এম হাসানের অপরাগতা প্রকাশ করার পর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ বাকি বিকল্পে প্রধান উপদেষ্টা না খুঁজে নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে বসেন। বিএনপিদলীয় রাষ্ট্রপতি প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পরও আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য বিরোধী দল আপত্তি করেনি, কিন্তু রাষ্ট্রপতির সব কর্মকাণ্ড যখন বিএনপির দ্বারা পরিচালিত হতে থাকে, তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে চার সদস্য পদত্যাগ করেন। শুরু হয় নতুন সংকট।
এভাবে বিএনপি বারবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমাদের মতো দেশে সরকার যেমন বিরোধী দল সহ্য করতে পারে না, তদ্রূপ বিরোধী দলও রাস্তায় নেমে ভাঙচুর করা ছাড়া থাকতে পারে না। অবশ্য নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির গুরুত্ব কোনো সরকারই দেয় না; জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণের জন্য তাই আগুন লাগাতে হয়, ভাঙচুর করা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। সরকারও চায় কিছু ভাঙচুর হোক, যাতে মামলা দিয়ে হয়রানি করা সম্ভব হয়। বিএনপি এখন এই ফাঁদে পড়ে দিশেহারা। বিএনপির দাবি, বর্তমান সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে, নতুবা পালানোর পথ পাবে না। পদত্যাগ করলে বা দেশ থাকে পালালে শূন্যতা পূরণ হবে কীভাবে? বিএনপি দখল করে নেবে?
নির্বাচনকালীন সরকারের কোনো ফর্মূলা বিএনপি আজ পর্যন্ত দেয়নি। সুপ্রিম কোর্টের বাতিল করা অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর কখনো ফিরে আসবে না, সুপ্রিম কোর্ট ইতোমধ্যে যা যা বাতিল করেছে, তা কখনো ফেরত আসেনি এবং ভবিষ্যতেও আসবে না। বিএনপির সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ না করলে নির্বাচিত সাংসদদের নিয়ে একটা সাংবিধানিক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সুযোগ ছিল।
বিএনপি মনে হয় আমেরিকার ওপর পরিপূর্ণ নির্ভরশীল; আমেরিকার কাছ থেকে কী ধরনের আশ্বাস পেয়েছে, তা আমাদের জানা নেই। আমেরিকা এবং ইউরোপের চাপে এবারের নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে; কিন্তু নির্বাচন সুষ্ঠু হলে আওয়ামী লীগ বিপদে পড়বে। কারণ বিএনপি ছাড়া আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো দল নেই, সুষ্ঠু নির্বাচনে অধিকাংশ আসন পেয়ে যাবে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের ফলাফলে হতাশ হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলো তখন একজোট হয়ে বলবে, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। এই সমস্যা সমাধানের কোনো পথ নেই। নির্বাচন যে সুষ্ঠু হয়েছে তা প্রমাণ করতে আওয়ামী লীগের কিছু প্রার্থীকে অবশ্যই হারতে হবে। নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য করতে এরশাদ সাহেব তার প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের ছেলে জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী ব্যারিস্টার জিয়াউর রহমান খানের পরাজয় নিশ্চিত করেছিলেন।
আওয়ামী লীগকে আরেকটি কাজ করতে হবে এবং তা হচ্ছে বৃহদাংশ ভোটারের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। তাই বলে বুথ দখলপূর্বক ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করা চলবে না। উৎসাহী কর্মীদের এমন অপকর্ম রোধ করতে ব্যর্থ হলে আওয়ামী লীগ নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনবে। বিগত নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগের একচেটিয়া বিজয় তাদের কর্মীদের অলস করে দিয়েছে, ভোটের দিন ঘরে বসে তারা আরাম আয়েশ করে টিভি দেখে আর মোবাইল ঘেটে দিন কাটায়, ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার সামান্যতম তাগিদও অনুভব করে না; কারণ তাদের বিশ্বাস আওয়ামী লীগ জিতবেই। কর্মীদের এমন ধারণা থাকলে আওয়ামী লীগ জিতেও হারবে, নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে, বিএনপি বহির্বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সমর্থ হবে, পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ বেড়ে যাবে, আন্তর্জাতিক চাপ আওয়ামী লীগের জন্য অসহনীয় হয়ে ওঠবে, আমেরিকার বদান্যতায় বিএনপি সর্বশক্তি নিয়ে আন্দোলনে নামবে, ক্রমাগত সংঘাতে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি বিধ্বস্ত হবে।
লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, টাকশাল।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে