Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

নির্মম অত্যাচারেও বাবা শত্রুর কাছে মাথা নত করেননি

Shawan  Mahmud

শাওন মাহমুদ

শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪

দুদিন পরই বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫৪ বছরে পদার্পণ করবে। গত ৫৩ বছরে এই স্বাধীন ভূখণ্ডে একাত্তরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ বুদ্ধিজীবী, বীরাঙ্গনা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ পরিবারের স্বজনের দৃঢ় অঙ্গীকার, আবদার, সম্মান, শ্রদ্ধা, রাজনৈতিক বলয়ে ঘুরপাক খেয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ কতটুকু জানতে পেরেছেন সেই সব দুঃসাহসী বীরত্বগাথা! কতটুকু ধারণ করছেন লাল-সবুজ পতাকাটা! কতটুকু উপলব্ধি করতে পারেন শহীদদের স্বজনদের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের ব্যথা! মানুষের হৃদয়কে কতটুকু ছুঁয়ে যায় বীরাঙ্গনার অপমান আর উপেক্ষা! আমরা যতটুকু বলতে বা পৌঁছাতে পেরেছি তাদের হৃদয়ে, ঠিক ততটুকুই। আরও কত কথা রয়ে গেছে জানার, জানানো হয়নি।


আজ শুধু একজন শহীদ বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযোদ্ধা এবং ভাষাসৈনিক আলতাফ মাহমুদকে অল্প করে জানানোর চেষ্টা করব। কাশবনে ঘুরে বেড়ানো ছোট্ট সহজ কিশোরটি ধাপে ধাপে দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করতে শুরু করেছিলেন। ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ৫৬ হাজার বর্গমাইলে হেঁটে চলেছেন সুরের পথ ধরে। ১৯৩৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর বরিশালের মুলাদী থানার পাতারচর গ্রামে আমার বাবা আলতাফ মাহমুদের জন্ম। আমার দাদা নেজাম আলী এবং মাতা কদবানুর একমাত্র সন্তান ছিলেন তিনি। ছেলেবেলা থেকেই বাবার জীবনযাপন ছিল সুরের মধ্যেই।

১৯৪৮ সালে বাবা ঢাকায় আসার পর ধূমকেতু সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হন। তিনি একাধারে বাঁশি, বেহালা, হারমোনিয়াম, তবলা বাজাতে পারতেন এবং সেগুলোর সঙ্গে কণ্ঠে বাঁধতেন গান। ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বাবা বাংলার আকাশে-বাতাসে জীবনযাপন করেছেন এক আলোকিত সুরের ধূমকেতু হয়ে। শত্রুকে ঘায়েল করেছেন সুরের মোহে। গণমানুষকে সুরের মূর্চ্ছনায় মুগ্ধ করে রেখেছেন রাতভর। গ্রাম হোক বা শহর, কাঁধে হারমোনিয়াম বেঁধে হাঁটতে হাঁটতে গেয়ে চলেছেন গান। বাংলার বাতাসে ছড়িয়ে দিতেন গণসংগীত, আকাশে পৌঁছাতেন আমাদের প্রতিবাদের ভাষা।

১৯৫৩ সালে বাবার যখন ২১ বছর বয়স তখন, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ গানটির সুর তৈরি করেন। তার পরের বছর প্রভাতফেরি থেকে সেই সুর প্রবাহিত হয়ে ভেসে বেড়ায়। এখন সারা বিশ্বে, নানা ভাষায়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস একুশে ফেব্রুয়ারিতেও ভেসে বেড়ায় এই সুর। তুমুল চাওয়া বা পাওয়া থেকে সেই সুর তিনি করেননি, ভাই হারানোর ক্ষতে বুকে টকটকে লেলিহান শিখায় পুড়তে পুড়তে গেয়ে গেছেন অবিস্মরণীয় এই গানটি।

১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে বাবা নিজ এলাকা মুলাদী থেকে মুসলিম লীগ প্রার্থী নিজের পিতা নেজাম আলীর বিরুদ্ধে নির্বাচনে দাঁড়ানো যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছিলেন। রাজপথে মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পিকেটিং থেকে শুরু করে সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যঙ্গ করে প্যারোডি এবং বিদ্রূপাত্মক গান বেঁধে স্ট্রিট মিটিংগুলোতে পরিবেশন করতেন। তার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে মিছিল করত তরুণ-কিশোরের দল।

ষাটের দশকে বাবা চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালক হিসেবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তানহা, বেহুলা, সুয়োরানী দুয়োরানী, সপ্তডিঙা, ক খ গ ঘ ঙ, জীবন থেকে নেয়া, লেট দেয়ার বি লাইটসহ আরও অনেক জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে ছিল তার সরব উপস্থিতি। এত ব্যস্ততাতেও তিনি কখনো কোনো প্রতিবাদী বা স্মরণসভা-মিছিল, অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকতেন না।

১৯৭১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাবা সবসময়ই থেকেছেন তার সহযোদ্ধাদের সঙ্গে। এমনকি ছায়ানটের প্রতিটি অনুষ্ঠানে তিনি অংশগ্রহণ করতেন। সময় বের করে রিহার্সেল করাতে যেতেন। তাকে কখনো দেখা যেত গলায় গামছা দিয়ে ঝোলানো হারমোনিয়াম নিয়ে দাঁড়িয়ে, পিচঢালা তপ্ত রাজপথে, শহীদ মিনারের পাদদেশে কিংবা পল্টন ময়দানে। এমনকি অনেকেরই অজানা যে, ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধের প্রতিবাদে বা ১৯৭০ সালে লেলিনের জন্মশতবার্ষিকী স্মরণে তাকে দেখা গেছে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো। সে সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে সফল চলচ্চিত্র সংগীত পরিচালক আলতাফ মাহমুদ নিজ আদর্শ, নীতি এবং দেশপ্রেমকে অন্যান্য সফলতা থেকে এগিয়ে রেখে কাজ করে গেছেন। তিনি প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, রাজনৈতিক দাবির সঙ্গে কঠিন সাংস্কৃতিক আন্দোলন যুক্ত না হলে রাজনৈতিক আন্দোলনের দাবি সুদৃঢ় হয় না, সফলতার মুখ দেখতে পায় না। অথচ সেই সময়কার আয়ুবী-মোনায়েম শাসনামলে বাংলাদেশকেন্দ্রিক দেশাত্মবোধক বা গণসংগীত পরিবেশন শাসক মহলে গর্হিত বা এক ধরনের দেশদ্রোহিতার শামিল বলে মনে করা হতো। আলতাফ মাহমুদ থেমে থাকেননি। তার সুর বেজেই গেছে সময়ের হাত ধরে, মানুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে।

অথচ আমরা সেসব পথ আর প্রত্যাশা থেকে যোজন যোজন দূরে সরে গিয়েছি। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন দিয়ে শুরু হয়েছিল আমাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের দাবি। সংস্কৃতির প্রথম ধাপ, ভাষা। প্রথম সোপান থেকেই একটি স্বাধীন জাতির জন্ম-ইচ্ছার শুরু। এবং সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ঐতিহ্য রক্ষায় সংগঠিত হয়েছিল। একটি স্বাধীন ভূখণ্ডে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধ ধর্মের সমন্বয়ে আদিবাসী, নারী-পুরুষ এবং শ্রেণিনির্বিশেষে সব লিঙ্গের মানুষ এবং তাদের ভাষা, আচার, উপাসনা, উৎসব স্বাধীনভাবে পালন করার লড়াই ছিল একাত্তর।

মুক্তিযুদ্ধ যুদ্ধের সময় বাবা এক দিনের জন্যও ৩৭০, আউটার সার্কুলার রোডের বাড়ি ছেড়ে আর অন্য কোথাও আশ্রয় নেননি। পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দুর্গবাড়ি গড়ে তুলেছিলেন সেখানেই। যুদ্ধের প্রথম থেকেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য গান তৈরি করে মেলাঘরে পাঠাতেন। এবং একসময় ঢাকার গেরিলা বাহিনী ক্র্যাক প্লাটুনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত হয়ে যান। ঢাকায় অবস্থিত গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের যোগাযোগ, আশ্রয়, গেরিলা মিটিং এবং মেলাঘরের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান সেই বাড়িতেই সংঘটিত হতো। তার দুর্গবাড়ি ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য হয়ে উঠেছিল সবচেয়ে নির্ভরশীল জায়গা। গেরিলাদের অস্ত্র জমা করতেন তিনি। আগামী অপারেশনে কাজে লাগবে তাই। আগস্টের ৩০ তারিখে আলতাফ মাহমুদ দুই ট্রাংক ভর্তি অস্ত্রসহ ধরা পড়েন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে। তাকেসহ অন্য গেরিলাদের ওরা ধরে নিয়ে যায় অজানার উদ্দেশ্যে। পরে জানা গিয়েছিল, দিনে নাখালপাড়া এমপি হোস্টেলের টর্চার সেলে রাখা হতো এবং রাতে রমনা থানায়।

৩০ আগস্ট, এমপি হোস্টেলের টর্চার সেলে ক্ষত-বিক্ষত আলতাফ পানি চেয়েছিল, তার মুখে পেশাব করেছিল পাকিস্তানি সেনারা। অত্যাচারের পালা শেষ হলে ছোট বাথরুমটায় গাদাগাদি করে ঢুকিয়ে দিত অনেকের সঙ্গে। একটা পানির কল ছিল, শক্তি ছিল না সেটা ছেড়ে পানি খাওয়ার মতো। সঙ্গের সাথিরা একজন অন্যজনের জন্য সাধ্যমতো করতেন। আজলা ভরে পানি খাইয়েছিলেন তাদেরই কেউ। রাত ১০টার পর সবাইকে ট্রাকে করে রমনা থানায় পাঠানো হয়। সেখানে সাধারণ কয়েদিরা তাদের ভাগের শুকনো রুটি আর ডাল খেতে দিয়েছিলেন সে রাতে। সেদিন আর আলতাফের খাওয়া হয়নি, ব্যথায় কোঁকাতে কোঁকাতে জ্বরের ঘোরে ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন।

পরের দিন ৩১ আগস্ট সকালে আবার রমনা থানা থেকে নাখালপাড়ার এমপি হোস্টেলের টর্চার সেলের ইন্টারোগেশন চেম্বারে। মুখ খোলাবার জন্য বাবাকে কয়েক ঘণ্টা পর পর টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। একসময় অধৈর্য হয়ে পাকিস্তানি সেনারা তার পা ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে বেধড়ক পেটায়। আর তখনই হাঁটু, কনুই আর পাঁজর ভেঙে যায় বাবার। একটা নাম, শুধু একটা নাম চেয়েছিল ওরা। একেবারেই বেঁকে বসা দীর্ঘদেহী সুঠাম শরীরের আলতাফ মুখ খোলেননি, শেষ পর্যন্তও না। এভাবেই রাত হয়েছিল। ১০টায় আবার রমনা থানায় পাঠানোর আগেই পাকিস্তানি সেনারা ঠিক করে ফেলেছিল, এদের মধ্যে কাকে ছাড়বে, আর কাকে নয়। নির্মম অত্যাচারেও বাবা শত্রুর কাছে মাথা নত করেননি, পালিয়ে থাকা সহযোদ্ধার নাম বলেননি। সবার আগে দেশ, এই পরিকল্পনা নিয়েই দেশকে ভালোবেসে, আমাদের ভালো থাকার জন্য তারা নিজেরাই হারিয়ে গিয়েছেন। তাদের কবর হয়নি, মৃত্যু দিনের তারিখ কারও জানা নেই।

স্বাধীনতার ৫৩ বছরে এসে শুধু একটি কথা চাই, বাংলাদেশের মানুষ মনে রেখো আমাদের কথা। এই পতাকা, পরিচয়, ভূমির জন্ম–দুই প্রজন্মের আত্মত্যাগের বিন্দুমাত্র অনুভব করার চেষ্টা কর। উগ্র মৌলবাদে বিশ্বাসী হওয়া, সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দেয়া বা মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করার আগে শহীদের রক্তে মিশে থাকা মাটির কথা মনে রেখ। বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডটি, যার মাটিতে হেঁটে বেড়াও, তা ৩০ লাখ শহীদের রক্তঋণে পাওয়া, মনে রেখ।

লেখক: শহীদ বুদ্ধিজীবী আলতাফ মাহমুদের কন্যা

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ