নিনা-নিনোর মাঝে পড়ে দুই যুগ পর ফিরল নাতিশীতোষ্ণ
ষড়ঋতুর বাংলাদেশকে বলা হয় নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর দেশ। এই জলবায়ু হলো ক্রান্তীয় বলয় হতে শুরু করে পৃথিবীর মেরু অঞ্চলসমূহের মধ্যবর্তী এলাকার সমভাবাপন্ন জলবায়ু। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তীব্র শীত কিংবা তীব্র গরম হবে না, বৃষ্টি হচ্ছে স্বাভাবিক; কিন্তু গত প্রায় দুই যুগের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে উধাও নাতিশীতোষ্ণ অনুভূতি। এ সময়ে এখানে বিরাজ করছে চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া। শীত আর গরমের তীব্রতা থাকে চরম। বর্ষায় বৃষ্টি হয় না স্বাভাবিক। বাকি ঋতু আসে-যায়, হয় না কোনো আলাদা অনুভূতি। গ্রীষ্ম এলে তো রাজশাহী অঞ্চলে বইতে শুরু করে মরুর বিপজ্জনক ‘লু’ হাওয়া। তবে এবার প্রায় দুই যুগ পর বাংলায় ফিরে এসেছে নাতিশীতোষ্ণ অনুভূতি। গ্রীষ্মকালেও আছে স্বাভাবিক তাপমাত্রা ও বৃষ্টি। আসছে বর্ষায় বৃষ্টিও হবে স্বাভাবিক, শঙ্কা নেই তীব্র শীতেরও। এমনটাই জানিয়েছেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা। এখন প্রশ্ন হতেই পারে কেন দুই যুগ পর দেশে আবার ফিরে এলো স্বাভাবিক আবহাওয়া।
আবহাওয়া ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশের আবহাওয়া কেমন থাকবে সেটা অনেকটাই নির্ভর করে এই প্রশান্ত মহাসাগরের অবস্থার ওপর। গত কয়েক বছর ওই অঞ্চলে ছিল ‘লা নিনার’ উপস্থিতি। ‘লা নিনা’ হচ্ছে ‘এল নিনো’র ঠিক বিপরীত। এই সময় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পূর্ব থেকে পশ্চিমে বয়ে চলা বাযুর পরিবর্তন ঘটে। তখন উষ্ণ জলস্রোত প্রবাহিত হতে থাকে পশ্চিমের দিকে। লা নিনা চলাকালীন সমুদ্রের গভীর থেকে উঠে ঠান্ডা জল সমুদ্রের উপরিভাগে উঠে যায়। যার ফলে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে ঠান্ডা হয়ে যায়। এল নিনো যেমন তীব্র তাপপ্রবাহের কারণ, তেমনি লা নিনা ঠিক এর উল্টোটা। লা নিনা প্রভাব ফেলতে পারে বর্ষায়। ফলে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণে তারতম্য ঘটে। শুরু হয় প্রবল বর্ষণ। স্বাভাবিক আবহাওয়ার পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে। তবে এবার ভিন্ন সুরে কথা বলছে প্রকৃতি। প্রশান্ত মহাসাগরে থাকা ‘লা নিনা’র পর্ব গত ডিসেম্বরেই শেষ হয়েছে। যে কারণে এবার তীব্র শীত পরেনি বাংলাদেশে। ‘এল নিনো’ শুরু হতেও প্রায় ৯ মাস লেগে যাবে। মাঝের সময়টা ‘নিরপেক্ষ’ই থেকে যাবে প্রশান্ত মহাসাগর। তাই এবার গ্রীষ্মেও নেই তীব্র তাপপ্রবাহ। হচ্ছে বৃষ্টিও অর্থাৎ স্বাভাবিক আবহাওয়াই বিরাজ করছে সারা দেশে। অথচ গত বছরই এপ্রিল মাসের পুরো ৩০ দিনই দেশে ছিল তাপপ্রবাহ। এবার তা নেই। ‘এল নিনো’ আসতে আরও প্রায় পাঁচ মাস বাকি থাকায় আসছে বর্ষায়ও হবে স্বাভাবিক বৃষ্টি। শীতে পরবে না টানা তীব্র শৈত্যপ্রবাহ।
আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ জানান, প্রতিবারই লা নিনা বা এল নিনোর মতো একটা অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় যাওয়ার মাঝে প্রায় আট থেকে নয় মাস প্রশান্ত মহাসাগর ‘নিরপেক্ষ’ থাকে। সমুদ্রের জল ঠান্ডা থেকে স্বাভাবিক হওয়ার পর সেখান থেকে গরম হতে এই সময় লাগবেই। প্রশান্ত মহাসাগরের এমন ‘নিরপেক্ষ’ মুখ অতীতেও দেখা গিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যে কয়েক মাস প্রশান্ত মহাসাগর ‘নিরপেক্ষ’ থাকবে, সেই সময়েই বর্ষার চার মাস পড়ছে। গত ২৫ বছরের মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশ বর্ষায় প্রশান্ত মহাসাগরকে কখনো এমন নিরপেক্ষ পায়নি। হয় লা নিনা না হলে এল নিনো অবস্থায় পেয়েছে। এবার তার ব্যতিক্রম হচ্ছে। প্রশান্ত মহাসাগর নিরপেক্ষ থাকার জন্যই এ বছর ভারতে বর্ষায় স্বাভাবিক বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে। তবে বৃষ্টি স্বাভাবিক হলেও আবহাওয়া বিজ্ঞানের বাকি মাপকাঠিগুলো কেমন থাকবে সে বিষয়টা এখনো অনেকটাই অনিশ্চিত। তবে সমুদ্র নিরপেক্ষ থাকলে অন্য মাপকাঠি অর্থাৎ ঝড়বৃষ্টি, বাতাসের উষ্ণ বা শীত স্রোত এবং অন্য আরও অনেক কিছুই চরম আকার নেবে না।’
আবহাওয়াবিদ খন্দকার হাফিজুর রহমান বলেছেন, ‘দীর্ঘ প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় পর বাংলাদেশের আবহাওয়া লা নিনা ও এল নিনোর মাঝামাঝি একটি নিরপেক্ষ অবস্থানে আছে। এটা বিরল না হলেও সচরাচর দেখা যায় না। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রশান্ত মহাসাগরে লা নিনা ও এল নিনোর উপস্থিতি প্রকট হওয়ার আগের সময়টাতে এমন অবস্থাই ছিল দেশের জলবায়ু। তাইতো বাংলাকে বলা হতো নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল। বহু বছর পর আবার তা ফিরে এসেছে। তাই এবার উষ্ণতম মাস এপ্রিলে এখনো খুব একটা গরম পরেনি। আসছে বর্ষায়ও স্বাভাবিক বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী শীতেও টানা তীব্র শৈত্যপ্রবাহের সম্ভাবনা কম।’ কিন্তু কেন এমনটা হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রকৃতির ওপর কারও হাত নেই। শুধু বলতে পারি এটা আমাদের জন্য স্বস্তির।’
এদিকে পুনের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল মিটিওরোলজির প্রাক্তন জলবায়ু বিশেষজ্ঞ পার্থসারথি মুখোপাধ্যায় বিবিসিকে জানিয়েছেন, ‘প্রতিবারই লা নিনা বা এল নিনোর মতো একটা অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় যাওয়ার মাঝে নয় থেকে ১০ মাস প্রশান্ত মহাসাগর ‘নিরপেক্ষ’ থাকে। এখন তেমনটা আছে। সমুদ্রের জল ঠান্ডা থেকে স্বাভাবিক হওয়ার পর সেখান থেকে গরম হতে এই সময় তো লাগবেই। সুতরাং এর মধ্যে অভিনবত্ব কিছু নেই। যে কয়েক মাস প্রশান্ত মহাসাগর ‘নিরপেক্ষ’ থাকবে, সেই সময়েই গ্রীষ্ম ও বর্ষা ঋতু পড়ছে। গত ২৫ বছরের মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশ প্রশান্ত মহাসাগরকে কখনো এমন নিরপেক্ষ পায়নি। হয় লা নিনা না হলে এল নিনো সক্রিয় অবস্থায় পেয়েছে। এবার এর ব্যতিক্রম। আর এই স্বস্তিদায়ক ব্যতিক্রম প্রায়শই পেতে হলে পরিবেশ রক্ষার সব বাধা আমাদেরই করতে হবে অতিক্রম।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে