ব্যালন ডি’অর: ব্রাজিলের ১৭ বছরের অপেক্ষা ঘুচাবেন ভিনি?
সময়টা ২০০৭ সালের ২ ডিসেম্বর! ব্রাজিলের চতুর্থ খেলোয়াড় হিসেবে ব্যালন ডি’অর পুরস্কার হাতে তুলেন রিকার্ডো কাকা। কাকার আগে ফুটবলের ‘অস্কার’ খ্যাত এই পুরস্কার জিতেন রোনালদো নাজারিও, রিভালদো ও রোনালদিনহো। কাকার ব্যালন ডি’অরের পর কেটে গেছে ১৭টি বছর। দীর্ঘ এই সময়ে আর কোনো ব্রাজিলীয়র হাতে ওঠেনি সেরাদের সেরার এই পুরস্কার। কিংবদন্তি পেলেকে টপকে ব্রাজিলের সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়া নেইমারেরও এনে দিতে পারেননি কোনো ব্যালন ডি’অর। তবে সেলেসাওদের সেই খরা কাটানোর দারুণ সুযোগ এবার ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের হাতে।
ব্যালন ডি’অর কী:
ব্যালন ডি’অর হলো ফুটবলে সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তিগত পুরস্কার, যা ফ্রান্স ফুটবল সাময়িকী প্রতি বছর বিশ্বের সেরা পারফর্ম করা খেলোয়াড়কে প্রদান করে। এটি প্রথম চালু হয় ১৯৫৬ সালে এবং পুরস্কারটি মূলত ইউরোপীয় খেলোয়াড়দের জন্য ছিল, তবে ১৯৯৫ সাল থেকে এটি বৈশ্বিক পরিসরে সব খেলোয়াড়ের জন্য উন্মুক্ত হয়। ২০১০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ফিফা এবং ফ্রান্স ফুটবল একসঙ্গে ‘ফিফা ব্যালন ডি’অর’ নামে এই পুরস্কারটি প্রদান করত। কিন্তু ২০১৬ সালে এই যৌথ উদ্যোগ শেষ হয়, এবং ব্যালন ডি’অর আবারও ফ্রান্স ফুটবল কর্তৃক আলাদাভাবে পরিচালিত হতে থাকে। ফিফা তখন থেকে আলাদা করে ‘ফিফা দ্য বেস্ট’ পুরস্কার প্রদান শুরু করে। তবে এখনো ‘ফিফা দ্য বেস্ট’-এর চেয়ে ব্যালন ডি’অর এর মর্যাদাই বেশি।
পুরস্কারটি সবচেয়ে বেশি ৮ বার জিতেছেন আর্জেন্টাইন মহাতারকা লিওনেল মেসি। গত দেড় যুগের বেশির ভাগ সময়জুড়ে মেসি ও পর্তুগিজ তারকা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর হাতেই ঘোরাফেরা করেছে ব্যালন ডি’অর। দেড় দশকে মেসি-রোনালদোর বাইরে একবার করে পুরস্কারটা জিতেছেন লুকা মদরিচ ও করিম বেনজেমা। গত ২১ বছরের মধ্যে এবারেই প্রথম মেসি ও রোনালদোর কেউই নেই ব্যালন ডি’অর পুরস্কারের জন্য করা ৩০ জনের তালিকায়।
ভিনির সঙ্গে আলোচনায় যারা:
২০২৪ ব্যালন ডি’অরের জন্য ৪ সেপ্টেম্বর ৩০ জনকে মনোনীত করে এই পুরস্কারের আয়োজক ফ্রান্স ফুটবল। তখন থেকেই আলোচনায় ছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গার ভিনিসিয়ুস, তার ক্লাব সতীর্থ জুড বেলিংহাম, কিলিয়ান এমবাপ্লে ও ম্যানচেস্টার সিটির স্প্যানিশ মিডফিল্ডার রদ্রি।
এবার ব্যালন ডি’অর পুরস্কার দেওয়ার ক্ষেত্রে গত বছরের ১ আগস্ট থেকে এ বছরের ৩১ জুলাই পর্যন্ত পারফরম্যান্স বিবেচনা করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে ভিনিসিয়ুস ব্রাজিল জাতীয় দলের জার্সিতে খুব একটা ভালো সময় পার না করলেও রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে দুর্দান্ত একটা মৌসুম কাটিয়ে ছিলেন তিনি। ক্লাবটির হয়ে লা লিগা, স্প্যানিশ সুপার কাপ ও উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা জিতেছেন। ক্লাবটির হয়ে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে গত মৌসুমে করেছেন ২৪ গোল, সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেন ১১টি।
ভিনির সতীর্থ জুড বেলিংহামও রয়েছে ব্যালন ডি’অরের দৌড়ে। ক্লাব পর্যায়ে ভিনির সমান ট্রফি জিতেছেন। রিয়ালের হয়ে করেছেন ২৩টি গোল ও ১৩টি অ্যাসিস্ট। লা লিগার সেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতিও পেয়েছেন এই ইংলিশ তারকা। জাতীয় দল ইংল্যান্ডকেও নিয়ে গিয়েছিলেন ইউরো-২০২৪ জয়ের দ্বারপ্রান্তে। তবে স্পেনের বিপক্ষে ফাইনালে শেষ মুহূর্তে গোল খেয়ে শিরোপা হাতছাড়া করে ইংল্যান্ড। ইউরো জিতে গেলে ব্যালন ডি’অর লড়াইয়ের হিসাবটা অন্যরকমই হতো।
পিএসজি থেকে রিয়াল মাদ্রিদে পাড়ি জমানো কিলিয়ান এমবাপ্পেও রয়েছে ব্যালন ডি’অর জয়ের রেসে। দলীয় অর্জন খুব বড় না হলেও ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স বিবেচনা করলে এই এমবাপ্পেই এখন বিশ্বসেরা ফুটবলার। ২০২৩-২৪ মৌসুমেও ক্লাব পর্যায়ে তিনি করেছেন ৪৪টি গোল, পাশাপাশি রয়েছে ১০টি অ্যাসিস্ট। রিয়ালের দুই বড় তারকা ভিনিসিয়ুস জুনিয়র ও জুড বেলিংহাম মিলে করেছেন ৪৭ (২৪+২৩) গোল। এতেই বোঝা যায়, কেমন ফর্মে রয়েছেন এমবাপ্পে! ফরাসি তারকার গত মৌসুমের ক্লাব পিএসজি ঘরোয়া লীগে দাপট দেখালেও ব্যর্থ হয়েছিল চ্যাম্পিয়নস লীগে। আর জাতীয় দল ফ্রান্সও বাজে খেলেছে ইউরোতে। এ জন্যই ব্যালন ডি’অর জেতার আশা ক্ষীণ হয়ে গেছে এমবাপ্পের।
আলোচনায় আছেন রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে এরই মধ্যে ৬টি চ্যাম্পিয়নস লীগ জেতা দানি কারভাহালও। ডিফেন্ডার হওয়ায় এমবাপ্পেদের মতো গোল-অ্যাসিস্ট তার নাই। তবে নিজের কাজটা ঠিকই করে গেছেন তিনি। রক্ষণভাগ সামলানোর পাশাপাশি দলের প্রয়োজনে গোলও করেছেন। গত চ্যাম্পিয়নস লীগের ফাইনালে ভিনিসিয়ুসের আগে তিনিই বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের জালে বল পাঠান। গত মৌসুমে রিয়ালের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লীগের পাশাপাশি তিনি জেতেন লা লিগা ও স্প্যানিশ সুপার কাপও।
শুধু ক্লাবের জার্সিতেই নয়, দেশের জার্সিতেও তার ঈর্ষণীয় সাফল্য। জিতেছেন ২০২৪ সালের ইউরো। ব্যালন ডি’অরের রেসে যে শুধু ভিনিসিয়ুসের সতীর্থরাই রয়েছেন তা কিন্তু নয়। আছেন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনার লাউতারো মার্টিনেজও। ইন্টার মিলানের হয়ে জিতেছেন সিরি‘এ’এর শিরোপা ও ইতালিয়ান সুপার কাপ। মৌসুমে করেছেন ২৭ গোল, হয়েছেন সিরি‘এ’এর সর্বোচ্চ গোলদাতাও। তবে লাউতারো যেন তার আসল ক্যারিশমা তুলে রেখেছিলেন কোপা আমেরিকার জন্য।
২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা শিরোপা জিতলেও মার্টিনেজ হয়েছিলেন সুপার ফ্লপ। পুরো আসরে একটি গোলও করতে পারেননি তিনি। এ জন্য ব্যাপক ট্রলের শিকারও হয়েছেন এই ফরোয়ার্ড। তবে এবার যেন মার্টিনেজ নেমেছিলেন সব অপবাদ ঘুচিয়ে দিতে। পাঁচ গোল করে হয়েছেন কোপার সর্বোচ্চ গোলদাতা। এমন কি ফাইনালে মেসি কেঁদে কেঁদে মাঠ ছাড়ার পর গোল করে আর্জেন্টিনাকে শিরোপা এনে দেন লাউতারোই।
রেকর্ড আটবারের ব্যালন ডি’অর বিজয়ী মেসি মনে করেন, এবার ব্যালন ডি’অর পাওয়ার দাবি রাখেন লাউতারো। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, ‘তার (লাউতারো) চমৎকার একটি বছর কেটেছে, কোপা আমেরিকার ফাইনালে গোল করলো, সেই ছিল সর্বোচ্চ স্কোরার। ব্যালন ডি’অরের জন্য অন্য যে কারো চেয়ে বেশি যোগ্য সে।’ আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনি বলেন, ‘আমার মনে হয় না ব্যালন ডি’অরের জন্য লাউতারো মার্তিনেজের চেয়ে যোগ্য আর কেউ আছে। নিশ্চিতভাবে এখন না পেলেও, ভবিষ্যতে এটা সে পাবে। তার সামনে এখনো দারুণ ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে।’
ভিনির সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী
ভিনির সঙ্গে সবচেয়ে বড় লড়াইটা বোধহয় হবে রদ্রির। গত মৌসুমে ম্যানসিটির এই স্প্যানিশ মিডফিল্ডারের রয়েছে ১২টি গোল ও ১৫টি অ্যাসিস্ট। চ্যাম্পিয়নস লিগ না জিততে পারলেও তিনি জিতেছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, উয়েফা সুপার কাপ ও ক্লাব বিশ্বকাপ। শুধু ক্লাবের হয়ে নয়, জাতীয় দল স্পেনের হয়েও তিনি খেলেছেন দুর্দান্ত। স্পেন জিতেছে ইউরো আর রদ্রি জিতেছে ইউরোর 'টুর্নামেন্ট সেরা' পুরস্কার। এমবাপ্পে-রদ্রি-বেলিংহামের পরিসংখ্যান যতই ভালো হোক না কেন ফুটবল বিশেষজ্ঞদের মতে, ভিনিসিয়ুসের ব্যালন ডি’অর জেতাটা এখন শুধুই সময়ের ব্যাপার।
আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটাই যা বাকি। মূলত বড় ম্যাচগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে জ্বলে উঠার কারণে এই ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গারকে এগিয়ে রাখছেন সবাই। সোমবার (২৮ অক্টোবর) রাতে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের থিয়েটার ডু শ্যাটেলেটতে ব্যালন হাতে নেওয়ার পাশাপাশি ভিনির প্রতি আরও একটা প্রত্যাশা থাকতে পারে ব্রাজিলীয় সমর্থকদের। সেটি হলো - পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দলটিকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে, সেই শৈল্পিক ফুটবল ফিরিয়ে এনে, বিশ্বমঞ্চে ফের নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব কায়েম করা।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে