সরকারি কর্মকর্তাদের অহেতুক বিদেশ সফর বন্ধ করুন
সরকারি কর্মকর্তাদের ‘অহেতুক’ বিদেশ ভ্রমণ দিন দিন উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। ফুল চাষ, মসলা চাষ থেকে শুরু করে গরুর প্রজনন, পুকুর খনন কিংবা নাসার প্রতিযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া বিজয়ী প্রতিযোগীদের সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ শুধু যে ‘অহেতুক’ বলে লোকজন চিহ্নিত করছেন, তা নয়, এই বিষয়গুলো নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে। আশঙ্কার বিষয় গণহারে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশে ভ্রমণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ ফেলছে, যার কারণে ২০২২ সালের মে মাসে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধের বিষয়ে পরিপত্র জারি করে সরকার। তাও যে এ ধরনের ভ্রমণ পুরোপুরি বন্ধ করা গেছে, তা নয়। অভিযোগ আছে, কিছু সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশে ভ্রমণ কাজের চেয়ে আনন্দ-ভ্রমণই বেশি হয়। তাই সুযোগ পেলেই প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্তসংখ্যক কর্মকর্তা বিদেশে ছোটেন।
গত বৃহস্পতিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যমতে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ৯ কর্মকর্তা আগামী ৪ থেকে ৮ মার্চ অথবা কাছাকাছি সময়ে যুক্তরাষ্ট্র সফর করবেন। তারা যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টায় স্বাস্থ্য খাতে নিরাপদ পানি, পয়োনিষ্কাশন ও পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে ‘ওয়াশ ইন হেলথ কেয়ার ফ্যাসিলিটিজ ফর সিনিয়র অফিসিয়ালস’ শীর্ষক সক্ষমতা বাড়ানোর কোর্সে অংশ নেবেন। এই ৯ কর্মকর্তার মধ্যে আছেন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. সরোয়ার হোসেন। আগামী এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহেই তিনি অবসরে যাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে এসে তিনি সর্বোচ্চ ২০ কর্মদিবস পাবেন। প্রশ্ন হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে তার এই প্রশিক্ষণ রাষ্ট্রের কী কাজে লাগবে?
একসময় উন্নত জীবনযাপন করার আকাঙ্ক্ষা, ভ্রমণ ও পড়ালেখার জন্য বিত্তবান বাঙালিরা গাঁটের টাকা খরচ করে বিলেতসহ বিভিন্ন উন্নত দেশে যেতেন। এখন আমাদের দেশের অর্থ ও সামাজিক ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে, বিদেশ ভ্রমণ বর্তমান প্রেক্ষাপটে তেমন কোনো বিষয় নয়। বিদেশ ভ্রমণ, বিশেষতে ইউরোপ-আমেরিকা ভ্রমণ অনেকের সামাজিক মর্যাদাও হয়তো বাড়ায়। সেই বিদেশ ভ্রমণে যদি গাঁটের টাকা খরচ না করে যাওয়া যায়, তবে তো সোনায় সোহাগা। আর এ সুযোগই গ্রহণ করতে দেখা যায় দেশের কিছু মন্ত্রী ও আমলাকে।
কাজের খাতিরে, প্রশিক্ষণের প্রয়োজনে, বিশেষ কোনো বিষয় সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট প্রযুক্তিগত বা ব্যবস্থাপনার জ্ঞান আহরণ করতে অথবা কোনো কিছু ক্রয়ের উদ্দেশ্যে সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর করার বিষয়টি স্বাভাবিক; কিন্তু তাদের এই বিদেশ সফর অনেক সময়ই আপাতদৃষ্টিতে অযৌক্তিক কারণে হয়ে থাকে। আবার অনেক সময় সফরে যাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি হয়। এসব ক্ষেত্রে নানা বিতর্কের জন্ম দেয় সরকারি খরচে ওই সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিদেশ সফর। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ ধরনের সফর নীতিমালা অনুসরণ করেই করা হয়, কিন্তু এসবের প্রয়োজনীয়তা কতটা, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
এ কথা সত্য যে বৈধতা রক্ষা করেই সরকারি কর্মকর্তারা বিদেশ সফরে যান; কিন্তু একজন সরকারি কর্মকর্তার বিদেশ-সফর, হোক তা কোনো প্রশিক্ষণ না সরকারি নীতিমালার প্রয়োজনে, দেশ ও দেশের মানুষের কতটা কাজে লাগবে, তা ভাবতে হবে। এমনো অনেক সময় দেখা যায় কোনো বিশেষ সফরে উন্নত দেশের প্রতিনিধি যোগ দিয়েছেন তিন-চারজন, আর আমাদের দেশের প্রতিনিধি প্রায় ডজনখানেক। তাই সরকারি অর্থ অপচয়ের এই পথ অচিরেই বন্ধ করতে হবে। তা না হলে প্রয়োজনের তাগিদে যেসব কর্মকর্তা বিদেশে সফরে যাবেন একসময় তাদের দিকে আঙুল তুলবে সাধারণ মানুষ। সে ক্ষেত্রে হিতে বিপরীত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
এমতাবস্থায় আমরা বলতে চাই, যেসব কর্মকর্তা ‘অহেতুক’ বিদেশ ভ্রমণে যান এটা তাদের যেমন ঔপনিবেশিক মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ, তেমনি একটা গণতান্ত্রিক জন্য কাঙ্ক্ষিত নয়। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা জনগণের জন্য কাজ করবেন- এমনটিই প্রত্যাশা করা হয়। তারা কখনোই জনগণের প্রভু নন বরং সেবক। তাই তাদের অহেতুক বিদেশ সফর করে রাষ্ট্রের অর্থ খরচ করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তাদের ওপর অর্পিত ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করেন এবং কর্তব্যবোধ ও ন্যায়নীতি অক্ষুণ্ণ রেখে দায়িত্ব পালন করেন, তা নিশ্চিত করা জরুরি। নইলে তাদের কাজের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে